ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

মাশরাফি, এক অসাধারণ নেতা, একজন ভালো মানুষ

জাহাঙ্গীর আলম বকুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ১২ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
 মাশরাফি, এক অসাধারণ নেতা, একজন ভালো মানুষ

জাহাঙ্গীর আলম বকুল : অনেকটা আকস্মিকভাবে জাতীয় দলের টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট থেকে বিদায় জানালেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। তার ভক্ত, ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে বিদাযের ঘোষণা আকস্মিক হলেও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কয়েকজন কর্মকর্তা, সিনিয়র খেলোয়াড় এবং মাশরাফির নিজের কাছে আকস্মিক ছিল না। তার বিদায়ের পটভূমি তৈরি হচ্ছিল বেশ কিছু দিন ধরেই। 

যারা আকস্মিকভাবে ঘোষণাটি শুনেছেন, স্বাভাবিকভাবে তারা হোঁচট খেয়েছেন। মাশরাফি অন্য অনেকের থেকে ব্যতিক্রম- একজন খোলোয়াড় হিসেবে, একজন মানুষ হিসেবে। অদম্য লড়াকু এ মানুষটি সচেতনভাবে ঝুঁকি নিয়ে খেলে যাচ্ছেন দেশের হয়ে। তিনি দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। তিনি দলের মধ্যে শ্রদ্ধা এবং বন্ধুত্বের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন, দলকে জয়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছেন। তার নেতৃত্বে দল পরাজয়ের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে একের পর এক শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে হারিয়েছে। তিনি এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি সব মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আদায় করতে পেরেছেন। তার বিদায়ের ঘোষণায় ভক্ত-দর্শকরা মর্মাহত হবেন, এটা অনুমেয়।

মাশরাফির বিদায় প্রক্রিয়ার শুরু নাকি প্রধান কোচ চন্দিকা হাথুরুসিংহের অন্য পছন্দ থেকে। বেশ কিছুদিন আগে তিনি বিসিবির কর্তাদের জানিয়েছেন, মাশরাফি, তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিমকে তিনি টি-টোয়েন্টি দলে জরুরি মনে করছেন না।

নিউজিল্যান্ড সফরেও খবরের শিরোনাম হয়েছিল মাশরাফির অবসর। দল নিউজিল্যান্ডে, কিন্তু বিসিবি প্রধান দেশে বসে সংবাদ মাধ্যমে ঘোষণা দিয়েছিলেন আর টি-টোয়েন্টি খেলবে না মাশরাফি। সেটি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। অবাক হয়েছিলেন স্বয়ং মাশরাফিও। পরে অবশ্য সুর পাল্টান বোর্ড প্রধান পাপন। টি-টোয়েন্টি ছাড়া নিয়ে ভেতরে ভেতরে আলোচনা আগে থেকেই ছিল। ওয়ানডে ফরম্যাটে মাশরাফির ভূমিকা নিয়ে কথা উঠেনি।

গণমাধ্যমে সংবাদ বের হয়েছে, সর্বশেষ শ্রীলংকায় ওয়ানডে সিরিজ শেষে কোচ আবার বিসিবি কর্তাদের পরামর্শ দেন, টি-টোয়েন্টি নিয়ে মাশরাফির সঙ্গে কথা বলতে। পরে নাজমুল হাসান পাপন দলের সিনিয়র চার ক্রিকেটারকে ডেকে কথা বলেন। বোর্ডের মনোভাবের কথা আবার স্মরণ করিয়ে দেন- তিন সংস্করণে তিন অধিনায়ক চায় বিসিবি। এরপর টি-টোয়েন্টি ছাড়ার ঘোষণা দেন মাশরাফি।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ সব তথ্যের যে ভিত্তি রয়েছে, সেটার প্রমাণ পাওয়া যায়- মাশরাফির অবসর ঘোষণার পর বিসিবি প্রধানের বক্তব্যে।

তিনি বলেছেন, ‘ওয়ানডে আর টেস্ট দলে ১০ জনের জায়গা প্রায় নিশ্চিত। তাই টি-টোয়েন্টি ছাড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার অপশন নেই। ঝুঁকি নিতে হলে টি-টোয়েন্টিতেই নিতে হবে। ওয়ানডেতে র‌্যাঙ্কিংয়ে প্রভাব খুব গুরুত্বপূর্ণ। টেস্টেও অভিজ্ঞতার দরকার আছে। সেক্ষেত্রে ওখানেও হাত দেওয়া যাবে না। একমাত্র টি-টোয়েন্টিতেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায়। ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো করাদের সেখানেই দেখে নেওয়া যায়।’

মাশরাফির অবসর ঘোষণার পর তিনি সম্ভাব্য পরবর্তী অধিনায়কের নাম জানিয়েছেন, সাকিব আল হাসান। ‍যিনি দলের চারজন সিনিয়র খেলোয়াড়ের অন্যতম। তিন ফরম্যাটে তিনজন সিনিয়র খেলোয়াড় নেতৃত্বে থাকছেন।

মাশরাফির অবসর ঘোষণা আকস্মিক হয়নি। কোচের পরামর্শ, বোর্ডের চাওয়া এবং মাশরাফির সঙ্গে বোর্ডের আলোচনার ভিত্তিতেই হয়েছে। সেটাই যথার্থ হয়েছে। মাশরাফি দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে অত্যন্ত সমাদৃত এবং জনপ্রিয়। তিনি কার্যকরী খেলোয়াড় এবং বিশেষ করে ওয়ানডে দল ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা- সব মিলিয়ে মাশরাফি যে উঁচ্চতায় আছেন, তার সঙ্গে অন্যায্য আচরণ করে ফেললে সেটা যে কতটা খারাপ হতো, তা আর কেউ আন্দাজ করতে না পারলেও, ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক ঘরের সন্তান নাজমূল হাসান পাপন ঠিকই জানেন। তাছাড়া যতদূর জানি, বিসিবিও চায় না অসম্মান প্রক্রিয়ায় কেউ সরে যাক। মাশরাফির বিদায় প্রক্রিয়া সম্মানে ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে হয়েছে এবং মাশরাফির জন্য সঠিক সময়ে হয়েছে। তিনি ওয়ানডে ফরম্যাটে অধিনায়ক হয়েই থাকছেন।

এখন প্রশ্ন আসে- টি-টোয়েন্টি থেকে মাশরাফিকে সরিয়ে দেওয়া কতটা সঠিক হয়েছে? মাশরাফির জায়গায় সকিব আল হাসানকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে মাশরাফির চেয়ে সাকিবের অভিজ্ঞতা এবং সাফল্য দুর্দান্ত। সারা বিশ্বে এ ফরম্যাটে খেলার অভিজ্ঞতা তার রয়েছে। তিনি সফল খোলোয়াড়ের মতো, দলকে কতটা সফল করতে পারবেন, দলের সব খেলোয়াড়ের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আদায় করে সত্যিকারের অভিভাবক হতে পারবেন কি না- সেটা সময়ই বলে দেবে। যেটা পেরেছিলেন মাশরাফি।

টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট নিয়ে বিসিবির ভাবনার কথা জানিয়েছেন পাপন, যে কারণে মূলত মাশরাফিকে সরে দাঁড়াতে হয়েছে। অভিজ্ঞতা, র‌্যাঙ্কিংয়ের কারণে টেস্ট ও ওয়ানডে দলের ভাঙা-গড়া সুযোগ কম এবং এ দুই ফরম্যাটে ১০-১২ জন করে খেলোয়াড়ের ওপর বোর্ড আস্থা রাখছেন (যার মধ্যে মাশরাফি অন্যতম)। নতুন খেলোয়াড়দের যাচাই-বাচাই করে নেওয়ার জন্য টি-টোয়েন্টি ফর‌ম্যাটকে বেছে নিয়েছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো করাদের সেখানে সুযোগ দিতে চেয়েছে। আমাদের অত্যন্ত অভিজ্ঞ-দক্ষ এবং সফল কোচরা, বোর্ডের কর্মকর্তা সেটাই ভালো মনে করেছেন, আমাদের সেটাকে সম্মান দেখানো উচিত, যেমনটি দেখিয়েছেন মাশরাফি।

গত দেড়-দু বছরে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের দুর্দান্ত সাফাল্যের নেপথ্যে যে কয়জন ছিলেন, তাদের অন্যতম হাথুরু সিংহে। তিনি এমন সময় দলের কোচিংয়ের দায়িত্বে আসেন, যখন দলের সামর্থ্য থাকার পরও হারের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছিল না।  ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে তিনি দলের দায়িত্ব নেন। তিনি যে কতটা কার্যকরী তার প্রমাণও তিনি দিয়েছেন। তাকে সম্মানের সঙ্গে কাজ করতে দিতে হবে এবং আস্থা রাখতে হবে। যে দায়িত্ব আমরাই তাকে দিয়েছি। আমরা আবেগী জাতি, যাকে ভালোবাসি পরিপূর্ণভাবেই বাসি, সাফল্যে উদ্বেলিত হই, বিফল হলেই সমালোচনায় মুখর। নিকট-অতীতের সাফাল্যের কারিগরও ছুঁড়ে ফেলি। কিন্তু সব সম্পর্ক হওয়া উচিত আস্থার এবং সম্মানের। বিদায়টা অবশ্যই সৌহার্য্যের-সম্মানের সঙ্গে।

মাশরাফির টি-টোয়েন্টি থেকে বিদায়টা সঠিক সময়ে এবং এক বিচারে দেশের ওয়েনডে ক্রিকেটের জন্য ভালো হয়েছে। মাশরাফিকে একদিন বিদায় নিতেই হতো। মাশরাফি আর কেন নই- এই অবস্থায় বিদায়-ই সঠিক এবং উত্তম হয়েছে। ফর্ম সবাই সব সময় থাকে না। সেটা মাশরাফির ক্ষেত্রেও হতো। মাশরাফি আর কেন- এই অবস্থায় বিদায়টা তার জন্য নিশ্চয় সম্মানের হতো না।

২০০১ সালের জাতীয় দলে অভিষেক হওয়ার পর দলের খুব গুরুত্বপূর্ণ খেয়োয়াড় হওয়ার পর চোটের কারণে বেশিরভাগ সময় মাশরাফিকে দলের বাইরে থাকতে হয়েছে। বিশ্বে মাশরাফিই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি ১১ বার হাঁটুতে অস্ত্রোপচার হওয়ার পরও সচেতনভাবে ঝুঁকি নিয়েই খেলে যাচ্ছেন। তিনি একজন বোলার হিসেবে এবং একজন অধিনায়ক হিসেবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কতটা দৃঢ় মনোবল এবং দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করলে সেটা সম্ভব, তা মাশরাফিই দেখিয়েছেন। তিনি দলের ভেতরে সমীহ-শ্রদ্ধা আদায় করতে পেরেছেন, ১১ জন খোলোয়াড়কে একটি দল হয়ে মাঠে খেলাতে পেরেছেন- যার ফল ধারাবাহিক জয়। আমরা এই মাশরাফিকে দলে দীর্ঘদিন চাই। তার জন্য তার ফিট থাকাটা অপরিহার্য। সেই দিক থেকে বিচার করলে টি-টোয়েন্টি থেকে অবসব তার ওপর চাপ কমবে। ফিট থাকাটা তার জন্য সহজ হবে।

বিশ্বের গ্রেট খেলোয়াড়দের তালিকায় হয়ত থাকবেন না মাশরাফি। (ওয়ানডে- ১৬৩ ম্যাচে ২০৮ উইকেট, রান ১৪৫০; টি-টোয়েন্টি- ৪৯ ম্যাচে ৩৯ উইকেট, রান ৩৬৬)। তবে এই পরিসংখ্যান দ্বিগুণ হতে পারত যদি তিনি নিয়মিত খেলতে পারতেন। তিনি বার বার চোট পেয়ে ছিটকে পড়েছেন, আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তিনি গ্রেট না হলেও তিনি দেশের মানুষের কাছে এবং দলের খেলোয়াড়দের কাছে তিনি সত্যিকারের হিরো। ভালো খেলোয়াড়ের পাশাপাশি তার চরিত্রের অসাধারণ কিছু গুণ তাকে এ অবস্থানে নিয়ে এসেছে। এ অর্জন অসামান্য এবং অসাধারণ।

নিজের উচ্চতা ধরে রাখলেন ঘোষণার পর সংবাদ সম্মেলনেও। তার অবসর নিয়ে অন্তরমহলে ঠিক কী ঘটেছিল- সেই বিষয়ে সাংবাদিকরা তার কাছে জানতে চাইলে মাশরাফি সত্যিকারের অভিভাবকের মতো আচরণ করলেন। বলেন, ‘আমার মনে হয়, এই সময় বিতর্ক তৈরি না করে আমাদের ক্রিকেটের উন্নতির জন্য কাজ করা উচিত। আমাদের ক্রিকেট এগিয়ে যাক। আমার কাছে মনে হয় না, এইসব নিয়ে আলোচনা করার কিছু আছে।’- এটাই আমাদের মাশরাফি।

মাশরাফি অসাধারণ হয়েও সাধারণ মানুষের মধ্যে তিনি খুব সাধারণ। এ গুণটি তাকে নিয়ে গেছে উচ্চতায়। তিনি পেরেছেন দলটিকে এক সুরে বাঁধতে এবং জয়ের জন্য খেলাতে। সদা নিরংকার মানুষটি যখন প্রয়োজন পড়েছে প্রতিপক্ষকে আঘাত হানার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন, আবার সুযোগ নিজে কাজে না লাগিয়ে জুনিয়রদের পথ তৈরি করে দিয়েছেন। দলের সব খেলোয়াড়ই গুরুত্বপূর্ণ- এই বিশ্বাসে সবাইকে সম্মান করেছেন। সহযাত্রীরাও তার প্রতিদান দিয়েছেন। নেতা হলে যতটা বিনয়ী এবং দৃঢ়চেতা হতে হয়, তার সবটুকুই অর্জন করেছেন।

মাশরাফি যতটা জনপ্রিয় হয়েছেন, আর কোনো খেলোয়াড় হতে পারবেন কি না সন্দেহ। দলে তার চেয়েও ভালো খেলোয়াড় আছে এবং আরও আসবে- কিন্তু ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে এতটা প্রিয় হওয়া কঠিন হবে। সবাই তাকে ‘বস’ বলেই শ্রদ্ধা করে। ‘বস’ হওয়া সত্যিই কঠিন। কতটা বিনয়ী, কতটা দায়িত্ববান ও নির্ভীক হলে, কতটা দেশপ্রেম থাকলে- মানুষের ‘বস’ হওয়া যায়, সেটা নতুন প্রজন্মকে মাশরাফির কাছ থেকে শিখতে হবে।

মুশফিকুর রহিম যথার্থই বলেছেন, ‘আপনি সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন।’ তামিম ইকবালের কাছে ‘অনুসরণীয় একজন, আমার মতে মাশরাফি একজন জীবন্ত কিংবদন্তি।’ মাহমুদউল্লাহর কাছে ‘আপনি একজন যোদ্ধা, একজন অসাধারণ নেতা, অধিনায়ক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খুব ভালো একজন মানুষ। ম্যাশ, আমরা সবাই আপনাকে ভালোবাসি।’ আমরা ক্রিকেট অনুরাগীরাও- এই ভালো মানুষটিকে সত্যিই ভালোবাসি।





রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ এপ্রিল ২০১৭/বকুল/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়