ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

সন্তানকে বোঝাতে হবে ফেসবুক সব না

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১৯, ১৭ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সন্তানকে বোঝাতে হবে ফেসবুক সব না

রুহুল আমিন : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের প্রায় ৯৯ শতাংশ ব্যবহার করছে ফেসবুক। অন্যসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তেমন একটা ব্যবহার করছে না।

শহর বন্দর গ্রামের শিক্ষিত অর্ধ শিক্ষিত, ক্ষেত্র বিশেষে অল্প শিক্ষিতরা ফেসবুক ব্যবহার করছে। দেশে দিন দিন ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। দৈনন্দিন জীবনে অন্যসব কাজকর্মের পাশাপাশি ফেসবুক ব্যবহারও যেন রুটিন হয়ে গেছে। যে যেখানেই থাকুক না কেন ফেসবুকে উপস্থিত হতেই হবে। সারা দেশের চেয়ে রাজধানী ঢাকায় ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

গত শনিবার একটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারী হিসেবে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। ঢাকায় দুই কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ সক্রিয়ভাবে ফেসবুক ব্যবহার করছেন। সক্রিয় ব্যবহারকারী হিসেবে জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকার স্থান ছিল তৃতীয়। তবে এপ্রিলে এসে ঢাকা এক ধাপ এগিয়ে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে। প্রতিবেদনটিতে ঢাকার সীমানা নির্দিষ্ট করা হয়নি। ঢাকা ও এর আশপাশ অঞ্চলকে ধরা হয়েছে। 

যুক্তরাজ্যে নিবন্ধিত সামাজিক যোগাযোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উই আর সোশ্যাল’ এবং কানাডার ডিজিটাল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ‘হুটস্যুট’ এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ খাতের বিভিন্ন বিষয়ে যৌথভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠান দুটি।

বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে প্রায় দুই কোটি ৩৩ লাখ মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করছে। তাদের মধ্যে এক কোটি ৭০ লাখ পুরুষ আর ৬৩ লাখ নারী। আর ৯৩ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে। এর মধ্যে মোবাইল ডিভাইস থেকে দুই কোটি ২৬ লাখ মানুষ ফেসবুকে ঢুকছে।

রোববার বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় একটি জাতীয় দৈনিকের অনলাইনে ভার্সনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে ফেসবুক ব্যবহার করে এমন দুই কলেজছাত্রের মা তাদের সন্তানদের ফেসবুক আসক্তির বিষয়ে কথা বলেছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুজন নারী ওই পত্রিকার কার্যালয়ে এসে তাদের কলেজপড়ুয়া ছেলেদের ফেসবুকে আসক্তির কথা বলেছেন। তাদের আসক্তি এত প্রবল যে ইন্টারনেট ব্যবহারের টাকা না পেলে মা-বাবাকে মারতে আসে। ফেসবুকে আসক্ত ওই দুই তরুণই দেশসেরা দুটি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। ঢাকার গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে ভালো ফল নিয়ে পাস করেছিল। কলেজে ঢোকার পর থেকে তাদের আচরণে পরিবর্তন ঘটতে থাকে।

এক মা জানান, যোগাযোগের জন্য ছেলেকে তিনি একটা বেসিক ফোনসেট কিনে দিয়েছিলেন। ছেলে টাকা জমিয়ে পরে একটি ‘টাচ মোবাইল’ফোনসেট কেনে। তারপর থেকেই ছেলের আচরণে পরিবর্তন হয়। ছেলেকে টিফিনের জন্য টাকা দেন, ছেলে ইন্টারনেটে সে টাকা খরচ করে। সারা রাত জেগে থাকে। কিছু বললেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। আত্মহত্যার হুমকি দেয়। কলেজের প্রথম পরীক্ষার রেজাল্ট তেমন ভাল না। টাকা না দিলে ভাঙচুর করে। ছেলের কারণে তার দাম্পত্য জীবনেও দেখা দিয়েছে সমস্যা। ছেলের কারণে স্বামী তালাকের হুমকি দিয়েছেন।

আরেক মা জানান, ছেলের কারণে মাস খানেক আগে স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। ছেলেকে পুলিশে সোপর্দ না করলে ফিরবেন না বলে জানিয়েছেন। আর ছেলে হুমকি দিয়েছে, পুলিশে সোপর্দ করলে ফিরে এসে সে ‘ঐশীর মতো’ কাণ্ড ঘটাবে। ছেলে আজকাল টাকার জন্য মাকে মারধরও করে।

বছর দুয়েক আগে মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ফেসবুক ব্যবহারের ফলে অন্য ব্যবহারকারীর প্রতি ঈর্ষা বা হিংসার জন্ম নিলে তা থেকে বিষণ্নতাবোধের জন্ম হতে পারে। পরিচিত কেউ অর্থনৈতিকভাবে কতটা ভাল আছে বা পুরনো কোন বন্ধু তার সম্পর্ক নিয়ে কতটা সুখে আছে, তা দেখার জন্য যারা ফেসবুক ব্যবহার করেন, তাদের মধ্যে ঈর্ষা বা হিংসার জন্ম নিতে পারে। এর ফলে তাদের মধ্যে ক্রমেই বিষণ্নতাবোধের সৃষ্টি হতে পারে।

অনেকে বন্ধু বান্ধব, পরিচিতজনদের ‘নজরদারি’ করার জন্য ফেসবুক ব্যবহার করেন। আর এই নজরদারির কাজে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে বন্ধু বা পরিচিত কারও বিলাসী ছুটির দিন, নতুন গাড়ি বা বাড়ি, এমনকি সুখী সম্পর্ক নিয়ে করা ফেসবুক পোস্টের ফলে ঈর্ষা বা হিংসার বোধ জন্মায়। এ বোধের ফলে ক্রমেই বিষণ্নতাবোধের শিকার হন ওই ব্যবহারকারীরা।

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ সাধরণত নজরদারির মনোভাব নিয়েই ফেসবুক ব্যবহার করে। অপরের ভাল মন্দ দেখার মনোভাব নিজের ক্ষতি করছে এই ব্যাপারটি সম্পর্কে আমরা সচেতন না। ফেসবুকে অতিরিক্ত ছবি পোস্টও মানসিকতার উপর বিরুপ প্রভাব ফেলে। যারা ফেসবুকে আসক্ত তাদের কাছে লাইক ও কমেন্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। যে কারণে নিজের পোস্ট করা কোনো স্ট্যাটাস বা ছবিতে তুলনামূলক লাইক কমেন্ট কম পড়লে বিষাদে ভুগতে থাকে ব্যবহারকারী ব্যক্তি। কারণ, এক ফেসবুক আর এতে লাইক ও কমেন্ট ছাড়া ওই ব্যক্তির জীবনে ভাল কোনো বন্ধু নেই। ফেসবুকের হাজারো অন্তর্জালিকবন্ধুর ভিড়ে বাস্তবে হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ একা, নিঃসঙ্গ। কোনো বন্ধু থাকে না।

আর একটি ব্যাপার হলো স্ট্যাটাস এবং ছবিতে লাইক ও কমেন্টে কেউ কেউ জনপ্রিয় হওয়ার ফ্যান্টাসিতে ভোগে। তারা সম্পূর্ণ ফেসবুককেন্দ্রীক জীবন যাপন করে। হয়তো কেউ কেউ জীবন ধারনের জন্য চাকরি বাকরি করে। কিন্তু তাতে যতটুকু সময় প্রয়োজন তা যেন মেপে দিয়ে কোনোরকম পার পেলেই বাঁচে। অফিস চলাকালীনও ফেসবুক ব্যবহার করে। আর অফিস শেষে ফেসবুকে পুরোপুরি ডুব মারা। নিয়ম করে স্ট্যাটাস দেওয়া, নিয়ম করে পোস্ট দেওয়া। কমেন্টের রেসপন্স করা। কখনো যদি প্রত্যাশার চেয়ে কম প্রাপ্তি ঘটে তখনই বিষণ্নতা ভর করে।

এ ছাড়া ফেসবুকে মানুষ তার একটি নিজস্ব ইমেজ তৈরি করে। কিন্তু ব্যক্তি জীবনের নানা প্রভাব সে ইমেজকে ভাঙতে পারে না। ভাঙতে দেয় না ব্যবহারকারী। অন্তত ফেসবুকে ভাঙতে চায় না সে। আবার সেতো সমাজেও বাস করে। পরিবার আছে। ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের কিছু কথা থাকে যা ফেসবুকে বলা যায় না। আর ফেসবুকে অতিরিক্ত সময় দিয়ে, অনেক চেষ্টা করে একটা ইমেজ তৈরি করে এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় যে বাস্তবে তার কোনো ভাল বন্ধু বা পরিবারের কারো সাথেও তেমন সম্পর্ক তৈরি হয় না। যার কাছে মনের অব্যক্ত কথা বলবে। ধীরে ধীরে সে আরো বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। একটা সময় পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যদিও সে বসবাস করে মানুষের কোলাহলে। কিন্তু প্রকৃত অর্থেই সে একা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

সেলফির মতো একা একা সব করতে করতে ধীরে ধীরে এমন এক অবস্থা তৈরি হয় যে, একা সব করে জীবনের সাথে আর পেরে উঠতে পারে না। হাপিয়ে ওঠে। আলো ঝলমলে প্রতিটি সেলফির ভেতর বুনতে থাকে নিজের একাকিত্বের বীজ। প্রযুক্তির হাহাকারময় এই শূন্যতার ছোবলে ছোবলে সে জর্জরিত হয়ে যায়। অনেক সময় বেছে নেয় অস্বাভাবিক কোনো পথ।

ফেসবুকে সস্তায় জনপ্রিয় হওয়া যায়। আছে বিভিন্ন ভুয়া ভুল তথ্য দিয়ে মানুষকে ধোকা দেওয়া। মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা। এমনকি অফিসে সহকর্মীদের মধ্যেও ফেসবুক নিয়ে আছে বিভিন্ন ধরনের ঘটনা। অধীনস্তের লাইক কমেন্ট নিয়ে বস লেভেলে আছে দ্বন্দ্ব। কোনো কোনো করপোরেট অফিসে এই অবস্থা আরো ভয়াবহ। এমন ঘটনাও জানা যায় যে, প্রতিপক্ষের লোকদের স্ট্যাটাসে লাইক দেওয়ায় চাকরি চলে গেছে।

আমাদের সবচেয়ে বেশি ভাবা দরকার তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে। কারণ, সরকারি হিসাবেই ফেসবুক ব্যবহারকারীর ৯৩ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে। ফেসবুক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে তাদের আটকানো যাবে এমনটা বিশ্বাস হয় না। কিংবা প্রকৃতপক্ষেই কতটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে তাও সময়সাপেক্ষ। কিন্তু অভিভাবক, শিক্ষক, সেলিব্রেটি, সমাজে প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তিরা এই ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে পারেন। জোর করে ছেলে মেয়েদের ফেসবুক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে বেকে বসতে পারে তারা। তার চেয়ে তাদেরকে ফেসবুক ব্যবহারের ভাল দিকগুলো বেছে নেওয়ায় উদ্বুদ্ধ করা ও খারাপ দিকগুলো বর্জন করার পরামর্ম দেওয়া যেতে পারে। সময়ের গুরুত্ব সম্পর্কে তাদের অবগত করতে হবে। ফেসবুক ব্যবহার করে নিজের পরিবার ও পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখা, জীবনের মজার ও গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করার পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ফেসবুক কখনো অপরের সঙ্গে নিজের জীবনযাপনের তুলনার জন্য ব্যবহার করা যাবে না, এই বিষয়টি তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে। অতি ফেসবুক নির্ভরতার অন্ধকার দিকটাকে সামনে তুলে ধরতে হবে। ফেসবুক ব্যবহারে একটা পরিমিতিবোধ তৈরির জন্য সর্বোপরি সবার মধ্যে সচেতনতা জরুরি এই সময়ে। সন্তানকে বোঝাতে হবে ফেসবুক সব না, জীবনের আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ এপ্রিল ২০১৭/রুহুল/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়