ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

এরদোয়ানের তুরস্ক : পূণ্যভূমি।। মার্ক লোয়েন

রাসেল পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০৪, ১৭ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ১৬:৪৭, ১ নভেম্বর ২০২০
এরদোয়ানের তুরস্ক : পূণ্যভূমি।। মার্ক লোয়েন

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

(কী হচ্ছে তুরস্কে? কী আছে তার ভাগ্যে? তুরস্ককে কোথায় নিতে চাইছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান? এসব জানতে পড়ুন বিবিসির তুরস্ক প্রতিনিধি এমি অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত সাংবাদিক মার্ক লোয়েনের বিশ্লেষণাত্মক লেখা আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব ভাষান্তর করেছেন রাসেল পারভেজ)

রোববার অনুষ্ঠিত তুরস্কের গণভোটে সামান্য ব্যবধানে জয়ী হয়েছে এরদোয়ানের পক্ষ। এই জয়ের ফলে যেসব সাংবিধানিক পরিবর্তন আসতে পারে, তা হলো : প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত করে দুই-তিনজন ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দেওয়া, সরকার ও রাষ্ট্রের প্রধান হবেন প্রেসিডেন্ট এবং রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও তার সম্পৃক্ততা থাকবে, জরুরি অবস্থায় ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ পাবেন, যেমন- ফরমান জারির মাধ্যমে আইন প্রয়োগ ও পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করতে পারবেন, পার্লামেন্ট কোনো মন্ত্রীকে নিয়োগ দিতে পারবে না, প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে তদন্ত ও অভিশংসন করার সীমিত সুযোগ থাকবে পার্লামেন্টের।

তুরস্কের সংবিধানের আমূল পবির্তনের এই আত্মবিশ্বাস কোথা থেকে পেলেন এরদোয়ান? মার্ক লোয়েনের বিশ্লেষণের দিকে তাকানো যাক।

তুরস্কের কৃষ্ণসাগর উপকূলে তার নিজ শহর রিজে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেসিডেন্টের প্রতিমূর্তি জ্বলজ্বল করছে। জীবিত কোনো নেতার নামে প্রতিষ্ঠানের নামকরণের মতো ‘ব্যক্তিপূজা’ নিয়ে সেখানে কথা হয় খুব কম।

২২ বছর বয়সি তরুণী হ্যাটিস ইলদিজ মধ্য-ক্যাম্পাসে বেঞ্চে বসে আছেন। কাঠের তৈরি বেঞ্চে স্বাভাবিকভাবেই এরদোয়ানের নাম খচিত রয়েছে।

ইংরেজি সাহিত্যের এই শিক্ষার্থী বললেন, ‘আমি আমার প্রেসিডেন্টের জন্য গর্বিত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নিয়েও আমি গর্বিত।’ তিনি আরো বলেন, ‘তিনি সত্যিই একজন ভালো নেতা- বিশ্বনেতা।’

২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম প্রেসিডেন্টের নামে রাখা হয়েছে পাঁচ বছর আগে এবং বর্তমানে এর শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০ হাজার। বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ফ্যাকাল্টিগুলো রিজ শহরজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। রিজ একটি ছোট শহর। জৌলুসহীনভাবে গজিয়ে উঠেছে বড় বড় দালান। তবে এর চারপাশে রয়েছে সুন্দর পাহাড়।

এই অঞ্চলটি তুরস্কের রক্ষণশীল ও  ধর্মীয় দিক হিসেবে তুর্কি জাতীয়তাবাদের পূণ্যভূমি, যা কয়েক বছর মানুষ ভুলেই গিয়েছিল। তবে মনে করা হয়, রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের হাতেই এর রক্ষা হবে।

এখানকার অনেকে প্রাচীন ধারার অসম্প্রদায়িক এলিটদের প্রভাবের নিচে চাপা পড়ে ছিল। তুরস্কের জাতির জনকের নীতির আলোকে ১৯২৩ সালের শুরু থেকে এই এলিটরা তুর্কি প্রজাতন্ত্র গঠনে ভূমিকা রাখছে। আতাতুর্ক ছিলেন পশ্চিমা ভাবধারার, অসম্প্রদায়িক এবং ইসলামি মধ্যপ্রাচ্যের উত্থানের বিরোধিতা করতেন।

আনাতোলিয়ার মুসলিমদের প্রায়ই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের কাতারের মনে হয়। তাদের ‘কৃষ্ণাঙ্গ তুর্কি’ বলে ডাকা হয়। রক্ষণশীল ‘শ্বেতাঙ্গ তুর্কি’-দের তুলনায় তাদের ছোট মনে করা হয়।



সরকারি প্রতিষ্ঠানে তাদের জন্য হেডস্কার্ফ পরা নিষিদ্ধ ছিল। রক্ষণশীল মুসলিম হিসেবে এরদোয়ান ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত তা বহাল ছিল। তিনিই তুরস্কের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যার স্ত্রী হেডস্কার্ফ পরে থাকেন। ২০১৩ সালে তার সরকার হেডস্কার্ফ পরায় নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে।

এ বিষয়ে ইলদিজ বলেন, ‘আমার মা বলেন, তাদের সময়ে এটি খুবই বাজে নিয়ম ছিল।’ রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইলদিজ নিজেও হেডস্কার্ফ পরেন।

ইলদিজ আরো বলেন, ‘ছেলেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারত, কিন্তু পর্দা করায় মেয়েরা তা পারত না। একজন মানুষ চাইলে তিনি যেকোনো স্থানে যেতে পারেন- এটি ধর্ম বা ব্যক্তির বাহ্যিকতার বিষয় হওয়া উচিত নয়। এরদোয়ানের আগ পর্যন্ত পরিস্থিতি এমনই ছিল। তবে তিনি এসব আইন বাতিল করেছেন।’

এরদোয়ানের প্রতি ব্যাপক সমর্থনের নেপথ্যে রয়েছে মুসলিমদের বিষয়গুলো নিয়ে তার প্রচারাভিযান। এরদোয়ানের এই মুসলিমপ্রীতি এবং নাড়ির টানের কারণে তার রিজ শহরের মানুষ তাকে ভালোবাসে।

এরদোয়ানের জন্ম ইস্তাম্বুলে হলেও সেই সময়ে রিজ শহরের সঙ্গে তার পরিবারের ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল। তার দাদা-দাদি জর্জিয়া থেকে রিজে অভিবাসিত হন। তার বাবাও রিজ শহরে জন্মগ্রহণ করেন।

এরদোয়ানের গ্রামের নাম গুনেয়সু। এটি রিজ শহরের সংলগ্ন। গ্রামের একটি বড় মসজিদের পাশে দাঁড়িয়ে তার এক আত্মীয় সাদুল্লাহ মুতলু বলেন, তার মনে আছে রিসেপ তাইয়েপ ছিলেন ‘পরিপূর্ণ মানসিকতার, সব সময় উচ্চাকাক্সক্ষী ও রাজনীতিতে আগ্রহী টগবগে তরুণ’।

প্রথম দিকে তার (এরদোয়ান) ইচ্ছা ছিল পেশাদার ফুটবলার হওয়া কিন্তু একটি ইসলামি আন্দোলনের তরুণ শাখার দিকে ঝুঁকে পড়েন তিনি। এর কিছু পরে তিনি এমিন গুলবারানকে বিয়ে করেন এবং তাদের চারটি সন্তান রয়েছে। রাজনীতিতে তিনি দ্রুত সফল হতে থাকেন। হলেন ইস্তাম্বুলের মেয়র। তখন ধর্মীয় একটি কবিতা আবৃত্তির জন্য তৎকালীন সেক্যুলার শাসনামলে অল্প কিছু দিনের জন্য তিনি কারাভোগ করেন।

কৃষ্ণসাগর উপকূলে তার শ্রমিক-শ্রেণির বংশপরিচয় এবং ইস্তাম্বুলের পাশে দরিদ্র কাসিমপাসা এলাকায় তার শৈশব পার হওয়ায় সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয় এবং সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলতে সক্ষম হন এরদোয়ান।

এই অঞ্চলে তার সমর্থকরা মনে করে, তিনিই তাদের জন্য কথা বলেন। এমন একজন সমর্থক হলেন মেহমেত মেরাল। ১৯৫০-এর দশক থেকে তার পরিবার রিজের আশপাশের পাহাড়ে ১৪০ একর আয়তনের চা-বাগানের মালিক। এ অঞ্চলই তুরস্কের চা-শিল্পের প্রধান কেন্দ্র। চা উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম তুরস্ক। চা-বাগানের সৌন্দর্য, পাহাড়ি ঢল ও অটোম্যান সাম্রারাজ্যের আমলের পাথরের সেতু রয়েছে এখানে।

মেহমেত মেরাল বললেন, ‘রিসেফ তাইয়েপ এরদোয়ান আমাদেরই একজন। তিনি জনগণের মধ্যে একজন। আগে সব নেতার বিক্তবান সন্তান ছিল, নয় তো তারা ছিল উঁচু শ্রেণির। কিন্তু এরদোয়ান তাদের মতো নন।’



এসব কারণে রিজে প্রেসিডেন্টের সমাবেশে তরতাজা আবেগের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। ড্রাম বাজিয়ে তারা সংবিধান পরিবর্তনের গণভোটের প্রতি সমর্থন জানায়।

এ ঘণ্টা মঞ্চে ছিলেন এরদোয়ান। সামরিক অভ্যুত্থান ঘটনানোর চেষ্টাকারীদের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান পুনর্বহাল করা এবং তুরস্কে বড় বড় প্রকল্প নিয়ে কথা বলে হাজার হাজার সমর্থকের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা কুড়ান তিনি। তার প্রতি সমর্থনের নেপথ্যে আরেক চালিকা শক্তি হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন।

ইউরোপকে কথার আক্রমণ করে যাচ্ছেন এরদোয়ান। ইউরোপের নেতারা তাদের দেশে বসবাসকারী তুর্কিদের মধ্যে প্রচার চালানোয় তার মন্ত্রীদের নিষিদ্ধ করার পর থেকে এই আক্রমণ অব্যাহত রেখেছেন তিনি।

এরদোয়ান বলেন, ‘সামান্য কিছু ফ্যাসিবাদী তুরস্কের সম্মান ধুলায় মেশাতে পারবে না।’ ‘নাৎসিদের নাতি-নাতনিদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে’ এবং সংবিধান পরিবর্তনকে সমর্থন করতে তুর্কিদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

এই ধরনের সাংঘর্ষিক মন্তব্য পশ্চিমা সরকারগুলোকে ক্ষেপিয়ে তোলে কিন্তু তার সমর্থকদের উজ্জীবিত করে। সমর্থকরা তার নাম লেখা ফিতা মাথায় বেঁধে এবং তার ক্যাম্পেইনের স্লোগান তুলে সমাবেশ মুখরিত করে রাখে।

সমর্থকদের হাতে বড় বড় পতাকায় আর যে মুখটি শোভা পাচ্ছিল, তিনি হলেন কামাল আতাতুর্ক এবং এখন এই প্রজাতন্ত্রের মহান নেতা হিসেবে আতাতুর্ককে গ্রাস করছেন এরদোয়ান। তুরস্কের এই অঞ্চলে আতাতুর্কের ভাবাদর্শের সেক্যুলাররা এখন বাসি স্মৃতি।

বক্তব্য শেষে আতাতুর্ক ও মন্ত্রীরা জনতার উদ্দেশে ‘চিজ সেট ও শিশুদের খেলনা’ উপহার হিসেবে ছুড়ে দেন। তবে উপহার নিয়েও অনেকের মুখ ছিল মলিন। কারণ হাত বাড়িয়েও তারা তাদের মহান নেতাকে স্পর্শ করতে পারেননি।

এরপর রিজে একটি বিমানবন্দরের নির্মাণকাজ উদ্বোধনের প্রতীক হিসেবে ফিতা কাটেন এরদোয়ান। তার বিগত শাসনামলে তুরস্কের বিমানবন্দরের সংখ্যা দ্বিগুণ করেছেন তিনি। অবকাঠামোগত এ কাজ তাকে ভোট পেতে সাহায্য করেছে।

এরদোয়ান জনতার ওপর যে আস্থার ছড়ি ঘোরান, তা হয়তো গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বিশ্বে বিরল। এখানে তার সমর্থকদের মধ্যে এমনও দেখা যায়, ‘তিনি (এরদোয়ান) যদি তার জন্য আমাকে মরতেও বলেন, আমি মরব।’

এরদোয়ানের প্রতি ভক্তির এই চমর পর্যায়ের বিপরীতে তুরস্কের অন্য অঞ্চলে রয়েছে তার জন্য সীমাহীন ঘৃণা। যা তার দেশের জনগণকে মারাত্মকভাবে বিভক্ত করে রেখেছে।

প্রথম পর্ব :



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ এপ্রিল ২০১৭/রাসেল পারভেজ

রাইজিংবিডি.কম

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়