ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

আমাদের লাকী ভাই...

শেলি সেলিনা আলম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:২৬, ২২ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আমাদের লাকী ভাই...

শেলি সেলিনা আলম : গানের মানুষ, সুরের মানুষ হিসেবে লাকী ভাইকে কে না চেনে? গানের গভীরে ছিল তার আবেগের বাস। গানের শব্দে ছিল তার চাওয়া-পাওয়ার সকল ব্যথা।

তাকে চিনি বহুদিন, সেই স্কুলে পড়া সময় থেকে। চিনেছি গানেরই কারণে। তবে দেখিনি কখনো। ‘এই নীল মনিহার’ - গানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমিও সুরে ভিজেছি কতো কতো দিন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার আরো অনেক গান আমার মন কেড়েছিল। তার সুর করা গান শিল্পী সামিনা চৌধুরীর গলায় শুনে সামিনারও ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম।

একদিন আমারও ইচ্ছে হলো আমি লাকী ভাইয়ের সুরে গান গাইবো। ওস্তাদ সঞ্জীব দা'র কাছে ফোন নম্বর নিয়ে তাকে কল করেছিলাম, সেটা ২০০৪ সালের ঘটনা। একজন লাকী আখন্দ এতটা আন্তরিক হবেন আমি ভাবতেই পারিনি। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের বাসাটাতে আমি দুবার গিয়েছিলাম। মানুষ কতোটা গানের প্রতি, সুরের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে তা তার বাসার সামনের রুমটিতে প্রবেশ করেই বুঝেছিলাম। রুম ভর্তি নানা রকম বাদ্যযন্ত্র। একজন শিল্পীর এমন ক্ষমতা সেই প্রথম নিজ চোখে দেখা। গানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক রকম বাদ্যযন্ত্র ওনার আঙুলে ঝংকার ছড়াতো। খুব দ্রুত আয়ত্বে এনে ফেলতেন যেকোনো গানের সুর।

আমরা শুরু করেছিলাম। উনি মাঝে মাঝে আসতেন আমাদের বাসায়। আমরা একসঙ্গে নতুন গান তুলতে শুরু করলাম। প্রমিতির বাবার সঙ্গে লাকী ভাইয়ের খুব ভাব হয়ে গেল। আমার থেকেও খাতিরটা হয়ে গেল তারই সঙ্গে বেশি। প্রমিতির বাবার মিউজিকের ওপরে নানারকম সংগ্রহ ছিল। সেগুলো হিমেল ওনাকে সিডিতে রেকর্ড করে দিত। প্রায়ই শুনতাম দুজনের দেখা হয়েছে। ওনাকে হিমেল গানের সিডি দিয়ে এসেছে।

‘তোমার প্রতিক্ষা ধরে রাখো’ - বলে লাকী ভাই একটা নতুন গান আমায় শেখালেন। গানটা আমরা ডুয়েট করেছিলাম। একদিন সেটা বাসায় ছোটো ক্যাসেট প্লেয়ারে রেকর্ডও করলাম।

তারপর কী জানি কী হলো, হঠাৎ করে উনি উধাও। মাঝেমধ্যে পাওয়া যায় ফোনে। এই বলেন পঞ্চগড় আছি, আবার এই বলেন বাংলাদেশের শেষ প্রান্তে আছি। খুব পাহাড় আর সবুজ ভালোবাসতেন। ঢাকা শহরে শীত নেই। উনি পঞ্চগড়ে চলে যান শীত উপভোগ করতে।

কাজে কাজে সময় গড়িয়ে গেছে। একজন লাকী ভাই, গানের মানুষ হিসেবে তাকে চিনলেও, তাকে যতটুকু বুঝেছি - ছিলেন অনেক প্রকৃতি প্রেমী, ছিলেন অনেক অভিমানী। ছন্নছাড়া, ভবঘুরে, উদাসীও ছিলেন অনেকটা। কিন্তু যখনই ফোনে পেতাম, এমন ভাব নিয়ে উনি কথা বলতেন যেন প্রতিদিনই কথা হচ্ছে আমাদের।

শেষের দিকে এ দেশে গানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ওনার মনে এক ধরনের আক্ষেপ শুনতাম। ভালো গান, ভালো সুর, ভালো শিল্পী তৈরির আক্ষেপ, হতাশা, আমাদের ব্যর্থতা - এসব ভেবে ভেবে তাকে কষ্ট পেতে দেখেছি।

সময় কীভাবে যে চলে যায়। ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে যখন আমার সিডি বের হয়, হিমেল দাওয়াত করেছিল ওনাকে। আমি জানতাম না। সিডির মোড়ক উন্মোচনে ওনাকে দেখে আমিতো অবাক। কিন্তু উনি অবাক নন। যেন সচরাচর দেখা হচ্ছে আমাদের। অথচ শেষ দেখা হয়েছে বছর পাঁচেক আগে। আমার ব্যাংকের বনানী শাখায় এসেছিলেন ব্যাংকিং একটা ব্যাপার বুঝে নিতে।

তারপর আরো আরো সময়। একদিন হঠাৎই শুনলাম উনি অসুস্থ। পত্রিকায় ছবি দেখে আমি এতটাই বিমর্ষ হয়ে পড়েছি যে, একদিনের জন্য দেখতেও যাইনি। আমি যে লাকী ভাইকে চিনতাম, এটা যেন সে নয়, অন্য কেউ। সাধারণ মানুষ মারা গেলে পেপারে ছবি দেখে আমি কাঁদি, আর লাকী ভাইতো জানাশোনা মানুষ। নিশ্চিত মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের কাছে আমি যেতে পারি না। আমি এড়িয়ে চলি কাছের মানুষদের মৃত্যুও। অসুস্থ হয়ে পড়ি নিজেই। স্বাভাবিক হতে আমার সময় লাগে।

আজ লাকী ভাই নেই। জানি না বাংলাদেশের গানের ভুবনে এমন একজন লাকী আখন্দ আদৌ তৈরি হবেন কি না। কিন্তু যা তিনি দিয়ে গেছেন আমাদের গানের ভুবনে, আমরা যেন সেটুকু শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।

প্রত্যেকটি মানুষ একদিন মারা যাবে, চিরাচরিত এ নিয়মের বাইরে আমরা কেউ নই। কিন্তু মরে গিয়েও কোনো কোনো মানুষ বেঁচে থাকে। তার কর্ম তাকে বাঁচিয়ে রাখে। লাকী আখন্দ বেঁচে থাকবেন তার সকল গানের মাঝে, তার সুরের মাঝে, আমাদের স্মৃতিতে।

এ কথাগুলো কখনোই লেখা হতো না যদি আজ উনি বেঁচে থাকতেন। আমার জমানো স্মৃতি তাকে উৎসর্গ করলাম। সৃষ্টিকর্তা তাকে সবরকম কষ্ট থেকে মুক্তি দিন। যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন লাকী ভাই।

লাকী ভাই আমার ফেসবুকে বন্ধুও। আমার মতো অনেকেই তার ফেসবুকে নিজস্ব অনুভূতি শেয়ার করছে। এখনো ওনার ফেসবুক সচল। শুধু মানুষটিই নেই।

গিটার ভালোবাসতাম খুব। কিন্তু আমার গানে হাতেখড়ি হারমোনিয়ামে। বড় হয়ে গিটার ধরে মনে হলো, ভীষণই কঠিন বাদ্যযন্ত্র এটি। আজ প্রমিতি গিটারে গান করে। সবচেয়ে স্মৃতিময় ঘটনা, প্রমিতি যার গিটার হাতে নিয়ে প্রথম তারে হাত রেখেছিল সেটা লাকী ভাই। নিজের আফসোস মিটে গেছে মেয়ের করা গানে। এক গিটার বাজাতে পারলে গানের সঙ্গে আর কোনো বাদ্যযন্ত্র লাগে না। ... আমি পারিনি, প্রমিতি পেরেছে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ এপ্রিল ২০১৭/সাইফুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়