ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ভাস্কর্য কাণ্ড : মুখস্থ আপত্তির এনাটমি

আরিফ রেজা মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫০, ২২ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভাস্কর্য কাণ্ড : মুখস্থ আপত্তির এনাটমি

আরিফ রেজা মাহমুদ : যেকোনো বিষয় বিশ্লেষণ করতে গেলে আগে দেখতে হয় তার উৎপত্তি। অতঃপর বিপত্তি। এরপর আপত্তি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য-কাণ্ড নিয়ে উৎপত্তি-বিপত্তির বালাই নেই। খালি আপত্তি দেখছি।

তবে আগে দেখে নেওয়া যাক, কোন অ্যাক্টরের কী কাজ।

১. ভাস্কর্য মৌলবাদীরাই ভেঙেছে : গুজবি সাংবাদিকের আবির্ভাব। অমনি রটনা ছড়িয়ে গেল চারপাশে। একে তো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, তারপর ভাস্কর্য ইস্যু। ইদানিং ভাস্কর্য হট ইস্যু। ভাবনার দৌড় মৌলবাদ পর্যন্ত। আগে যেভাবে হযেছিল, পরেরবারও সেভাবেই হবে- এর নাম মৌলবাদ। এই গুজবি সাংবাদিকতাও মৌলবাদ।

২. ভাস্কর্য অবমাননা প্রতিষ্ঠা প্রকল্প : না, জানা গেল ভাস্কর্য কেউ ভাঙেনি। চারুকলায় সীমানা দেয়াল নির্মাণ, ভাস্কর্য  রক্ষণাবেক্ষণের দাবিতে ভাস্কর্য উল্টিয়ে রেখেছেন কিছু শিক্ষার্থী। এবার তো গুজবি সাংবাদিকতার মৌলবাদ প্র্রতিষ্ঠা প্রকল্পে ধস। করণীয় কী? আপত্তি জানানো। কী কী আপত্তি :

ক. শিল্পকর্মের অবমাননা :  শিল্পকলার অবমাননা জিনিসটা কী সেটা একটু বুঝে নেই। ভাস্কর্যগুলো মাটিতে উল্টিয়ে রাখাটা হলো অবমাননা। বক্তব্যটি কাদের? সরকারি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের। তাদের ভাষায়- উল্টিয়ে রাখাটা ‘তছনছ’ ‘লণ্ডভণ্ড’। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ভাস্কর্যগুলো যদি এত সম্মানের জিনিস হয়, তবে এমন করে রাখা ছিল কেন, যেন যে কেউ যখন তখন এসে একে উল্টে দিতে পারে। দিনের পর পর দিন এত মূল্যবান শিল্পকর্মগুলো যখন এতদিন অরক্ষিত থেকেছে, গরু ছাগলের ঢিঁশ খেয়েছে, রোদে জলে ভিজে  স্থায়ীত্বের হুমকিতে রয়েছে, তখন, কি গুজবি সাংবাদিক, কি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, কি ছাত্রলীগ তার খবর কেউ নেয়নি। নিলেও টু শব্দটি করেনি। কেন বলুন তো? আদতে ভাস্কর্য ইস্যুতে যখন দেশ সরগরম, তখন সরকারি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ছাত্রলীগের নিজ ঘরে ভাস্কর্যগুলো স্রেফ কর্তৃপক্ষের অবহেলায় অবমাননার শিকার।

এই অবহেলা ঢাকার জন্য মোক্ষম অস্ত্র কী হতে পারে? অফেন্স। আদতে রক্ষণাবেক্ষণ, অবহেলা ইত্যাদির উৎপত্তি নিয়ে আলাপ নেই। এর ফলে যে বিপত্তি এতদিন শিক্ষার্থীরা পোহাচ্ছে, তা নিয়েও আলাপ নেই। আলাপ আপত্তি নিয়ে। ফলে বোঝা যায় আপত্তির বৈধতা আদায়ে উৎপত্তি/বিপত্তি আড়াল করে ফেলা হচ্ছে। ওটা সামনে আসলেই মুখোশ উন্মোচন।

খ. প্রতিবাদের ভাষা এমন হতে পারে না : আপত্তির দ্বিতীয় যুক্তি হলো,  নিজের শিল্পকর্ম সন্তানের মতো, তাকে কি কেউ উল্টে রাখতে পারে? সাংবাদিক, শিক্ষক, লেখকরা সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে, বাকস্বাধীনতার দাবিতে কলম ভাঙেন। একে আমরা বলি প্রতীকী প্রতিবাদ। ঐ ভাঙাভাঙিটা প্রতিবাদ হলে স্রেফ উল্টানোটাতে আপনাদের আপত্তি কেন মশাই? প্রতিবাদের ভাষা নিয়ে এই ক্রিটিক যুতসই হলো না আপনাদের।

প্রতিবাদের ভাষা সরকারি স্মরকলিপি আর ভুয়া আল্টিমেটাম হলে আপনারা খুশি কি? তেমন কিছু হলে কয়টা পত্রিকায় খবর হয়? গণ্ডার চামড়ার প্রশাসনের গায়ে কতটুকু লাগে? আসলে প্রতিবাদের ভাষা নয়, আপত্তি খোদ প্রতিবাদ নিয়েই। ভাষার ওজর আলখাল্লামাত্র। শাসকের ভঙ্গিতে যায় চেনা। খেয়াল করুন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক হোমড়া চোমড়ারা সুপ্রিম কোর্টের ভাস্কর্য ইস্যুতে কিন্তু টু-বাক্যটি বলেননি।

গ. প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে কাজটা করলে যুক্তিসঙ্গত হতো : কেন? মাস্টার দা সূর্যসেন কি ঘোষণা দিয়ে অস্ত্রগার লুট করেছিলেন? ওটা কি প্রকাশ্য দিবালোকে ছিল? নাকি চোরাগোপ্তা তড়িৎ অপারেশন? বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা রাতের বেলাতেই হয়েছে। গোপনে, অতি গোপনে তা বহন করে নিয়ে গিয়ে বেতারে প্রচার করা হয়েছে, তাবৎ মানুষ তখন তা শুনতে পেয়েছে।

আসলে প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য নয়, ঘোষণা বা অঘোষণা নয়, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের বৈধতা দাবির ন্যায্যতার উপরে নির্ভরশীল। দাবির সমর্থনের উপর নির্ভরশীল। নির্ভরশীল অনুঘটকদের সামাজিক, রাজনৈতিক ভিশনের উপরেও। যারা ভাস্কর্য উল্টেছেন তাদের দাবি জানতে পেরেছি। সামাজিক, রাজনৈতিক ভিশন কি আমার জানা নেই। যতক্ষণ না জানতে পারছি ততক্ষণ মুখস্থ অভিযোগ দেওয়ার পক্ষপাতী আমি না।

প্রশ্ন উঠতে পারে, দেশে মৌলবাদীরা যখন ভাস্কর্য ভাঙার জিকির তুলেছে, তখন প্রতিবাদের এমন উপস্থাপনা, বিশেষত যাতে কোনো লিফলেট ব্যানার বা ন্যূনতম কোনো বার্তা নেই, তাতে ভ্রম হওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়? আদতে দুনিয়ার সব জিনিসকে মহাবয়ানের খাপে আঁটাতে যাওয়ার বিপদ হলো অচিরে নিজেই তার ফাঁদে পড়া। যখন যুক্তি আর আগায় না, বুঝবেন আপনি মহাবয়ানের ফাঁদে পড়েছেন। যারা কেন্দ্র-প্রান্ত ছকে চলেন, যারা হাইকমান্ডের এরিয়াল ভিউ দিয়ে প্রান্তে বসে সমাজকে দেখেন, তারাই মহাবয়ানের ফাঁদে পা দেন। মহাবয়ান সত্য, বাকি সব মিথ্যা, এমন নীতিই তো আদি ও নিখাঁদ মৌলবাদ।

একটু উদাহরণ দিয়ে বলি। ২০০৪ এর ঘটনা। শিবির রাবিতে রাকসু চায়। ছাত্রদলও চায় । ছাত্রলীগ সরকারের পালাবদলে ক্যাম্পাস ছাড়া হওয়ার পর সদ্য ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছে। তারাও রাকসু চায়। আর বামপন্থিরা তো চায়-ই। কিন্তু কেউ একে অপরাপর ছাত্র সংগঠনগুলোর শিবিরের সঙ্গে কনসেনসাস বা ঐকমত্য বলেনি। বলবেও না কোনো দিন। কারণ সবাই জানে কে কী কেন চায়। এই  ‘কে কী কেন চাই’ বিশ্লেষণ করতে না পারলে আমরা ফাঁদে পা দেই।

আর  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভাস্কর্য বলে নয়, যেকোনো প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ন্যায্যতা দমনের জন্য আন্দোলনকারীদের শিবির হিসেবে অভিহিত করা হয়। ২০১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারির ঘটনাটা খেয়াল করা যেতে পারে। আন্দোলনে শিবির ঢোকার নামে কী নারকীয়ভাবে শিক্ষার্থীদের উপর গুলি চালানো হয়েছিল।  এই সরকারি প্রগতিশীলদের যুগে যুগে দেখেছি, কোনটা প্রগতি আর কোনটা না, তা ক্ষমতার হালুয়া-রুটির হিসাব মতো, নিজেদের সুবিধা মতো নির্ধারণে ফতোয়া দিতে। আদতে এরা প্রতিবাদকে ভয় করে। প্রতিবাদকে রুদ্ধ করতে চায়।

অনেকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রশ্ন তুলেছেন। গত ৮/১০ বছর ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে  নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন তো দূরে থাক,  সভা-সমাবেশের সংগঠনগত অধিকার নিষিদ্ধ। এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে সরাসরি পুলিশ হস্তক্ষেপ করতে পারবে। প্রশাসন কিছু বলবে না। এমন সিদ্ধান্তই নিয়ে ছিলেন শ্রদ্ধেয় সোবহান-মলয়-তাপু স্যারেরা। সেটাই বলবৎ রেখেছেন মিজান-সজল স্যারেরা। অথচ ২০০৮ সালে ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দীনের জরুরি শাসনামলে এই শিক্ষকদের কারামুক্তির জন্য আন্দোলন করেছিলাম আমরা- প্রতিগতিশীল শিক্ষার্থীরা। তখন স্লোগান ছিল- বিশ্ববিদ্যালয় ক্যান্টনমেন্ট নয়। সভা-সমাবেশের রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ভেঙেই তা প্রতিষ্ঠা করেছিলাম আমরা। কিন্তু প্রশাসনের ক্ষমতা পাওয়ার পরপরই এই শিক্ষকরা তা নস্যাৎ করেছেন। মলয় স্যার দায় অস্বীকার করতে পারেন। তিনি প্রশাসনিক কোনো পদে ছিলেন না অজুহাতে। কিন্তু কেনা জানে, সোবহান-প্রশাসনের আমলে তিনি ওই গ্রুপের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। একান্ত উপদেষ্টা। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা-স্বায়ত্তশাসন সমুন্নত রাখার মতো শিক্ষকের উচ্চনৈতিকতা তারা আর দেখাতে পারেননি শিক্ষার্থীদের। ফলে নিয়মতন্ত্রের প্রশ্ন নেই।

আমি শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায দেখেছি, দিনের পর দিন রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া পড়ে থেকে অনুশীলনী ভাস্কর্যগুলো অর্ধেক মাটিতে ঢুকে গেছে। মেহেরচণ্ডী থেকে ষাঁড় ঢুকে ঢিঁশ মেরে কত ভাস্কর্য ভেঙেছে তা পরিসংখ্যান ডিপার্টমেন্ট ডেকে গুনতে হবে হয়তো। দিনের পর দিন সেশনজট। আমাদের সময় ৮/৯ বছর লাগত। এখনও পরিস্থিতির উন্নতি নেই। ফলে অসন্তোষ ভেতরে যে আছে, তা সহজেই অনুমেয়।  শিক্ষার্থীরা তো আজীবনই বলে এসছেন এসব নিয়ে। আসলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে নিয়মতন্ত্রান্ত্রিক প্রতিবাদের প্রশ্ন প্রশাসন নিজেই অনেক আগে খতম করে ফেলেছে। এই নিষেধাজ্ঞা নিয়ে  কখনো  কোনো হার্ড রিপোটিং দেখেছেন? আমি দেখিনি। কেন? তার ছোট্ট উত্তর : সুবিধা, ভয় এবং নিউজ সেন্সরটাও এমবেডেড হয়ে যাওয়া। সুতরাং খবর হয় না।

স্থানকাল নিরপেক্ষভাবে বা অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে, ভাস্কর্য উল্টে রাখাটা ঠিক বা ঠিক না-এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের বুদ্ধিজীবী, ইয়া বড় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা খুঁজে দেখেননি। আমার বক্তব্য সরাসরি ও স্পষ্ট। নিজের হাতে গড়া ভাস্কর্য ভেঙে ফেলেও প্রতিবাদ হতে পারে। এটা শিল্পীর শৈল্পিক এবং একই সঙ্গে রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিষয়। এমনকি দুনিয়াব্যাপী খোদ শিল্পিসমাজে প্রতিষ্ঠিত একটা বিষয়।

উদাহরণ দিতে পারি। বিখ্যাত শিল্পকর্ম ‘ডলস হাউস’ পুড়িয়ে ফেলেছিলেন ইন্সটলেশন আর্ট- এর দিকপাল হিথার বেনিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আর্টের আরেক অমর শিল্পী গেরহার্ড রিকটার। নিজের আাঁকা ৬০টিরও বেশি শিল্পকর্ম একবারে কুচি কুচি করে ছিঁড়েছেন তিনি। বিভিন্ন সময়ে, একাধিকবার। এর বেশিরভাগই প্রদর্শনীতে কদর পেয়েছিল, নেহাত আনকোরা অপছন্দের জিনিস ছিল না।

শুধু রিকটার নন, শিল্পকলার ইতিহাসে তার আগেও এই উদাহরণ ভূরি ভূরি। ক্লদ মনেত, রবার্ট রাউজেনবার্গ, জন বাল্ডেসারি, জেসপার জনস, রবার্ট ফ্যাঙ্ক কত শত নাম। ভারতের শিল্পীরাই কি কম গেছেন। কর্ণসুমার নামে এক শিল্পী রাজা পারিশ্রমিক দেন নাই বলে নিজেই সব শিল্পকর্ম আঙিনাতেই চুরমার করেছিলেন।

আসলে, কী রাত কী দিন, ঘোষণা/অঘোষণার প্রশ্ন নয়, প্রশ্নটা একেবারেই শিল্পী কোন ধরনের শিল্প-রাজনৈতিক দর্শনকে ধারণ করে কাজটি করছেন তার ওপর।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় ভাস্কর্য ‘তছনছ’ ‘লণ্ডভণ্ড’- এর ‘হোতারা’ কতটা যৌথতার ভিত্তিতে কাজটি করেছেন আমার কাছে আসলে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কেননা আমি অন্যের শিল্পকর্ম তার সম্মতি ছাড়া প্রতিবাদে সামিল করতে পারি না।

আমার একটা পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, এই শিক্ষার্থীদের প্রটেস্টের পাঞ্চটা যতটা তীব্র, শিল্প-রাজনৈতিক বক্তব্য ততটা দৃশ্যমান নয়। ঠিক যতটা দৃঢ় শিল্প-রাজনৈতিক চৈতন্য থাকলে ক্ষমতার ভয়কে জয় করা যায়, ততটা দৃঢ়তা তারা দেখাতে পারেনি।

লড়তে গিয়ে কত শত পরাজয় থাকে। কিন্তু ভেতরের আগুনটা তো ছাইচাপা রয়েই যায়। বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত, বিদ্রোহ বৃথা যায় না।

লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ এপ্রিল ২০১৭/রাসেল পারভেজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়