ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

এবারের এসএসসির ফলই কি প্রকৃত মূল্যায়ন?

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৮, ৯ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এবারের এসএসসির ফলই কি প্রকৃত মূল্যায়ন?

মাছুম বিল্লাহ : শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের ছোট সোনামণিদের পিএসসি ও জেএসরি পর এসএসসি হচ্ছে তৃতীয় বৃহত্তম জাতীয় একাডেমিক মূল্যায়ন স্তর। এই মূল্যায়নের ওপর একজন শিক্ষার্থীর অনেক কিছু নির্ভর করে। তাই ফল ভালো করার পর বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো আনন্দে ফেটে পড়ে তরুণ শিক্ষার্থীরা। সেই আনন্দে যোগ দেন শিক্ষক ও অভিভাবকগণ। শিক্ষা নিয়ে যারা কাজ করেন, চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করেন তারা প্রতিবছরই বলে আসছেন, পাবলিক পরীক্ষার ‘হাইব্রিড ফল’ নিয়ে। কিন্তু সরকার বলে আসছিল শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের অবদানের ফলে ক্রমান্বয়ে পাসের হার বাড়ছে। এর পেছনে মান বা অন্য কিছু নিয়ে কথা বলার তেমন একটা অবকাশ নেই। বিষয়টি নিতান্তই গভীর ভাবনার।

২০০১ সালে এসএসসিতে পাসের হার ছিল ৩৫.২২ শতাংশ আর ২০১৬ সালে সেটি ৮৮.২৯ শতাংশে উন্নীত হয়। মনে রাখতে হবে, ২০১৪ সালে পাসের হার ৯১.৩৪ শতাংশে পৌঁছেছিল! বিষয়টি সময়ের পরিবর্তনের সাথে হওয়ারই কথা, কিন্তু বাস্তবে শিক্ষাদান প্রক্রিয়া, শিক্ষার সার্বিক ব্যবস্থাপনা, শিখণ-শেখানো পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি যার ফলে বিষয়টি বেমানান দেখাচ্ছিল। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে বিষয়টির ক্রিটিক্যাল অ্যানালাইসিস করার পরিবর্তে জোর গলায় বলা হচ্ছিল-এটি  তাদের সাফল্য। কিন্তু এবার (২০১৭) এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার ও জিপিএ-৫ দুটোই কমেছে। অন্যান্য সূচকও নিম্নগামী। আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডসহ ১০ বোর্ডের অধীনে এবার পরীক্ষায় অংশ নেয় ১৭ লাখ ৮১হাজার ৯৬২ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে পাস করে ১৪লাখ ৩১ হাজার ৭২২ জন। গড় পাসের হার ৮০.৩৫ শতাংশ যা গতবার ছিল ৮৮.২৯ শতাংশ। গত বছরের তুলনায় এবার পাসের হার কমেছে ৭.৯৪ শতাংশ। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে এক লাখ চার হাজার ৭৬১ জন। গতবার ছিল এক লাখ ৯ হাজার ৭৬১জন অর্থাৎ গতবারের তুলনায় জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে পাঁচ হাজার। এবার শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা  দুই হাজার ২৬৬, গতবছর যা ছিল চার হাজার ৭৩৪। একজনও পাস করেনি এমন প্রতিষ্ঠানও গত বছরের তুলনায় বেড়েছে, গত বছর ছিল ৫৩টি, এবার ৯৩টি।

এবার সমস্ত মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হলো যে, এবার নতুন পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয়েছে, ফলে পরীক্ষার্থীরা আগের মতো ঢালাও নম্বর পায়নি, তার প্রভাব পড়েছে ফলাফলে। মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে ‘এটিই হচ্ছে প্রকৃত মূল্যায়ন’। আসলেই কি আমরা প্রকৃত মূল্যায়ন করতে পেরেছি? এই ফলই কি প্রকৃত ফল? আমরা কি এতেই সন্তষ্ট থাকবো? লন্ডনের বিভিন্ন পরীক্ষায় একজন পরীক্ষক প্রতিটি পরীক্ষার জন্য চার সেট মডেল উত্তরপত্র পান সেখানে প্রতিটি পরীক্ষার জন্যই ‘অ্যাসেসমেন্ট রাইটার’ থাকেন, যারা মূলত বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের একটি প্যানেল যারা ‘মার্ক স্কিম’ তৈরি করেন যেখানে প্রতিটি বিষয়েরই সংযোজন, বিয়োজন ও সংশোধনী থাকে। প্রতিটি মডেল উত্তরপত্রে পরীক্ষার্থীদের সম্ভাব্য উত্তরগুলোর প্রতিফলন থাকে। আর এমনভাবে এই উত্তরপত্র তৈরি করা হয়, যাতে প্রত্যেক পরীক্ষক তা সহজভাবে বুঝতে পারেন ও প্রয়োগ করতে পারেন।  অ্যাসেসমেন্ট রাইটাররা কয়েকজন শিক্ষার্থীর উত্তরপত্র বিশ্লেষণ করে প্রতিটি মডেল উত্তরে স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করেন। ‘মার্ক স্কিমে’ অন্তর্ভুক্ত নয় এমন কোন উত্তরও যদি  পাওয়া যায়, তাহলে সেটি নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হয়। কোন অস্বাভাবিক উত্তর যদি  পাওয়া যায়, যা মার্ক স্কিমে নেই, তাহলে সে ক্ষেত্রে অ্যাসেসমেন্ট রাইটারদের মত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এই আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে পরীক্ষকরা যাতে যথাযথ নম্বর দিতে পারেন সে বিষয়ে তিন বছর ধরে কাজ করছে বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট। চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার খাতা দেখায় তারা পরীক্ষকদের একটি মডেল উত্তর দেওয়ার সুপারিশ করে। সেই হিসাবে এবার পরীক্ষকরা খাতার সঙ্গে প্রতি পত্রেরই মডেল উত্তরপত্র পান। কম বা না লিখে কেউ যাতে বেশি নম্বর না পায় আবার ভালো লিখে কেউ যাতে বঞ্চিত না হয় সে জন্যই এ ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া প্রধান পরীক্ষক ও পরীক্ষকদেরও খাতা দেখার ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

প্রধান পরীক্ষকদের দশের পরিবর্তে বারো শতাংশ খাতা মূল্যায়ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়। মূল্যায়নকৃত খাতার ওপর ছয় পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন পেশ করতে বলা হয়। এ বছর এভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয় যা নতুন পদ্ধতি বলে মিডিয়ায় প্রচার করা হয়। তবে, বিষয়টি সকল বোর্ডের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে কিনা আমরা এখনও নিশ্চিত নই। বিইউডিইউ-এর গবেষণায় দেখা যায়, অনেক শিক্ষক নিজেরাই প্রশ্ন বোঝেন না বিশেষ করে সৃজনশীল চালু হওয়ার পর  প্রতিটি প্রশ্নের ‘গ’ ও ‘ঘ’ অংশ নিয়ে শিক্ষকদেরই সমস্যা তৈরি হয়। অনেক শিক্ষক না বুঝে নম্বর দিয়ে দেন। তাই এবার খাতার সঙ্গে মডেল উত্তর দেওয়াতে কোন উত্তরের জন্য কেমন নম্বর দিতে হবে, তা পরীক্ষকরা বুঝতে পেরেছেন বলে দাবি করা হচ্ছে। বিষয়টি কি সবক্ষেত্রে এবং সর্বত্র প্রয়োগ করা হয়েছে? যদিও ঢাকা বোর্ড থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে যে, পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরপর খাতা আসে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাবোর্ডে। যেদিন যে বিষয়ের পরীক্ষা শেষ হয়, সেদিন সে বিষয়ের প্রশিক্ষিত তিনজন প্রধান পরীক্ষককে বোর্ডে ডাকা হয়। তারা উত্তরপত্রগুলো থেকে ‘ভালো’ ‘মধ্যম’ ‘নিম্নমান’ এই তিনভাবে উত্তরপত্র নমুনা হিসেবে সংগ্রহ করে দেখেন। এরপর কর্মশালার মতো করে একই উত্তরপত্র ফটোকপি করে আরও ২০ জন পরীক্ষককে দিয়ে দেখানো হয়। এতে দেখা যায়, একই উত্তরপত্র হলেও নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে কমবেশি হয়। পরে তারা আলোচনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, এভাবে লিখলে এতো নম্বর পাবে। এই প্রক্রিয়ায় মডেল উত্তরপত্রের ‘গাইডলাইন’ তৈরি করা হয়। পরে সারাদেশ থেকে পরীক্ষকেরা যখন উত্তরপত্র নিতে বোর্ডে আসেন, তখন সবাইকে আবার ওই সব প্রশিক্ষিত পরীক্ষক একটি ব্রিফ দেন এবং গাইডলাইন দেন, যেন সেভাবেই খাতা দেখা হয়েছে।

এবার পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করলে আমরা আরও দেখতে পাই যে, কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে পাসের হার গতবারের চেয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ কমে গেছে যা  সার্বিক গড় পাসের হারে প্রভাব ফেলেছে। কুমিল্লায় পাসের হার কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হলো, পরীক্ষার্থীরা ইংরেজি ও গণিতে খারাপ করেছে। বরিশাল বোর্ডেও গণিতে খারাপ করেছে অনেক শিক্ষার্থী। নতুন পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়ন, প্রশ্ন ফাঁস ও নকলের ক্ষেত্রে কড়াকড়িসহ পাঁচ কারণে ফল এমন হয়েছে বলে মন্তব্য করা হচ্ছে। প্রথমবারের মতো ৪০-এর পরিবর্তে ৩০ নম্বরের এমসিকিউ পরীক্ষা হয়। এটি একটি যৌক্তিক কারণ। উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে উদারনীতির পরিবর্তে কিছুট কঠোরতা অবলম্বন করা হয়। মডেল উত্তরপত্র অনুসরণের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়।  গণিতে এবার তৃতীয়বারের মতো সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা এখনো পুরোপুরিভাবে আত্মস্থ করতে পারেনি বিষয়টি।  কুমিল্লা বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসারেই আমরা এবার উত্তরপত্রের মূল্যায়ন করেছি। তাই গতবার আমাদের পাসের হার ছিল ৮৪ শতাংশ, কিন্তু এবার  ৫৯.০৩ শতাংশ।’

সবকিছু মিলিয়ে এবার ঢালাওভাবে নম্বর প্রদান করার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় কিছুটা হলেও কঠোর ছিল। এটিই আমাদের জন্য আশার কথা।

লেখক : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ মে ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়