ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ঊনাশিতেই আন্তর্জাতিকভাবে দাবি ‍তুলেছিলেন শেখ হাসিনা

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১০ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঊনাশিতেই আন্তর্জাতিকভাবে দাবি ‍তুলেছিলেন শেখ হাসিনা

হাসান মাহামুদ: ‘১৯৮১ সালে ফিরে এসে আমি কিন্তু কোনো বাড়ি ভাড়াও পেতাম না। যখনই বাড়ি ভাড়া করতে যেতাম, কেউ ভাড়া দিত না। একদিন ছোট ফুপুর বাড়িতে এক রাত, মেজো ফুপুর বাড়িতে ... এইভাবে আমাকে থাকতে হয়েছে।’

কথাগুলো বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার, যার নেতৃত্বে এখন পরিচালিত হচ্ছে দেশের গণতন্ত্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ছয় বছর পর দেশে ফিরে কী দুঃসহ পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে, এভাবেই তার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।  গত মাসে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নতুন ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী মূলত কথা বলছিলেন, ’৭৫ পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে।

জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার সময় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে ছিলেন বলে ঘাতক চক্রের হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পান। কিন্তু এরপর তারা আর দেশে ফিরতে পারেননি। ফিরেছিলেন দীর্ঘ ছয় বছর পর। এই বিষয়গুলো এখন জ্বলন্ত ইতিহাস। সবাই জানি। কিন্তু কঠিন সময়েও শেখ হাসিনা কতটা কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছিলেন, তা খুব বেশি আলোচনায় বা ইতিহাসে আসেনি। তেমনি একটি বিষয়- জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার আন্তর্জাতিকভাবে বিচারের দাবি তোলা।

আজ থেকে ৩৮ বছর আগে এই দিনে (১০ মে) সুইডেনের স্টকহোমে অনুষ্ঠিত সর্বইউরোপীয় বাকশালের এক সম্মেলনে শেখ হাসিনার পক্ষে এই দাবি তোলা হয়। শেখ হাসিনা তখন বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ভারত- এসব দেশে কূটনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন বিরতিহীন।  সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে প্রধান অতিথি হিসাবে যোগদানের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু তখন ভারত থেকে সুদূর সুইডেনে গিয়ে সম্মেলনে যোগ দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। সর্বইউরোপীয় নেতৃবৃন্দ শেখ হাসিনার প্রতিনিধিত্ব করতে লন্ডনে অবস্থানরত শেখ রেহানাকে অনুরোধ করেন। দিল্লী থেকে ফোনে শেখ হাসিনাও বোনকে বলেন সম্মেলনে যেতে। অনুষ্ঠানে কী বলতে হবে সে বিষয়ে তিনি টেলিফোনে ছোট বোনকে নির্দেশনা দেন। শেখ রেহানা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৭৯ সালের ১০ মে, দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। সম্মেলনের প্রধান অতিথি শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাঁর পাঠানো বাণী পাঠ করেন শেখ রেহানা। তাঁর পক্ষে বক্তব্য রাখেন তিনি। এটাই ছিল কোন রাজনৈতিক সমাবেশে শেখ রেহানার প্রথম বক্তব্য রাখা। আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে শেখ হাসিনার পক্ষে শেখ রেহানা সর্বপ্রথম পঁচাত্তরের কলংকজনক ও অমানবিক হত্যাকান্ডের বিচারের দাবি তোলেন।

স্টকহোমে অনুষ্ঠিত সর্বইউরোপীয় বাকশালের সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা


সেদিন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, জাতিসংঘের মহাসচিব, জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কমিশনের চেয়ারম্যান, আমেরিকার কংগ্রেসের হিউম্যান রাইটস কমিটির চেয়ারম্যান, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের প্রধানদের কাছে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যার বিচারের প্রশ্নে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন তিনি।

তখনকার প্রেক্ষাপটে এই হত্যার বিচারের দাবি তোলাই ছিল চ্যালেঞ্জিং একটি বিষয়। এমনকি তখন দেশে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ প্রায় নিষিদ্ধ। আন্তর্জাতিক মঞ্চে সেদিনের সেই দাবি উত্থাপনের পর শেখ হাসিনা মূলত এ বিষয়ে মোটা দাগে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন শেখ রেহানাও।

হত্যার বিচারের দাবি উত্থাপনের পরের মাসেই (জুন) যোগাযোগ করা হয় প্রখ্যাত আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামসের সঙ্গে। তিনি ছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বিশিষ্ট কৌসুলি। তখন প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়, স্যার টমাস উইলিয়ামসকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের দাবিতে মামলা করা হবে।  কিন্তু তখনো এই আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। এরপর গঠন করা হয় সর্বইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ। শেখ হাসিনার পরামর্শ অনুযায়ী ১৯৮০ সালের ২০ জানুয়ারি সেন্ট্রাল লন্ডনের কনওয়ে হলে এই পরিষদের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।  স্যার টমাস উইলিয়ামসের সম্মতি নেওয়ার জন্য ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝিতে ‘হাউস অব কমন্সে’ গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন শেখ রেহানা ও ড. শফিক।

১৯৮০ সালের জুনের মাঝামাঝিতে স্যার টমাস উইলিয়ামসের আমন্ত্রণে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যান শেখ হাসিনা। তখন শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্ত কমিশন গঠন করার দায়িত্ব নিতে স্যার টমাস উইলিয়ামসকে অনুরোধ করেন। এতে তিনি সম্মত হন।  ১৯৮২ সালের ২০ মার্চ  আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারবর্গ এবং চার জাতীয় নেতার হত্যা সম্পর্কে প্রাথমিক রিপোর্ট পেশ করেন। এর মধ্যে ঘটেছিল নানান ঘটনা। এর একবছর আগেই শেখ হাসিনা প্রায় ৬ বছরের নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে দেশে ফিরেছিলেন। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর আবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসীন করেন শেখ হাসিনা। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। তবে ১৯৭৯ সালের সেই বিপদসঙ্কুল সময়েও পিছপা ছিলেন না শেখ হাসিনা।

বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। এখন দেশ ও জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। এই কলঙ্কমোচনের প্রথম সোপান রচিত হয়েছিল আজকের এই দিনে সুদূর সুইডেনে। আর, এই সোপান রচনায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। বাকী দন্ডপ্রাপ্ত পলাতকদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে ফাঁসির রায় কার্যকর করার চেষ্টা চলছে। আমরাও চাই, যতদ্রুত সম্ভব বিচারকার্য সম্পন্ন করা হোক।

লেখক: সাংবাদিক।





রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ মে ২০১৭/হাসান/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়