ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

অবৈধপথে বিদেশ গমন ঠেকাতে পদক্ষেপ জরুরি

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১৫, ১৭ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অবৈধপথে বিদেশ গমন ঠেকাতে পদক্ষেপ জরুরি

রুহুল আমিন : প্রতিনিয়তই অবৈধ পথে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গমন করছে বাংলাদেশিরা। জীবননাশের শতভাগ ঝুঁকি থাকা সত্বেও প্রতিবছর বহু মানুষ অবৈধভাবে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।

সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক দৈনিক দ্য ইনডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায় এই সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ইউরোপে পাড়ি জমানো শরণার্থীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ার উদ্বেগজনক তথ্য পাওয়া যায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের প্রথম তিন মাসে ইতালিতে অবৈধভাবে পাড়ি জমানো শরণার্থীদের মধ্যে মাত্র একজন বাংলাদেশি ছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে তা দুই হাজার ৮০০ জনে গিয়ে ঠেকেছে।

ইউরোপে শরণার্থীদের উৎসস্থল হিসেবে আগে সিরিয়া, আফগানিস্তান ও ইরাকের নাম ছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে শরণার্থী সংখ্যা বাড়ায় একক দেশ হিসেবে সব দেশ ছাড়িয়ে বাংলাদেশ এখন শীর্ষে।

যারা ইউরোপমুখি তারা মূলত লিবিয়া হয়ে ইতালিতে ঢুকেছে। শরণার্থীরা প্রথমে বাংলাদেশ থেকে দুবাই হয়ে লিবিয়ায় যায়। পরে সেখান থেকে সাগর পথে (ভূমধ্যসাগর) নৌকায় করে ইতালির উদ্দেশে রওয়ানা হয়।

ওই প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ইউরোপে শরণার্থীদের রুট ও জনমিতির মানচিত্র বদলের এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

গবেষকরা মনে করছেন, অবৈধভাবে ইউরোপে পাড়ি জমানো বাংলাদেশিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ রোহিঙ্গা। সেইসঙ্গে বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে চাপের মুখে থাকা জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরাও এই সংখ্যা বাড়িয়ে তুলেছে বলে প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়।

কয়েক বছর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন শরণার্থীদের ঠেকাতে তুরস্কের সঙ্গে চুক্তি করে। এতে আজিয়ান সাগরের রুটটি দিয়ে শরণার্থী অনুপ্রবেশ কমে যায়। তবে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালিতে পাড়ি জমানো বেড়ে যায়।

আইওএম কর্মকর্তা ফ্লাভিও দি গিয়াকোমোর বরাত দিয়ে প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, গত বছর মার্চ নাগাদ তিন মাসে ইতালিতে প্রবেশকারী বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল এক। এই বছর একই সময়ে ওই সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮৩১। এই তথ্যটি শরণার্থীদের জাতীয়তা পরিবর্তনের আগ্রহের বিষয়টি ফুটিয়ে তোলে।

এ ছাড়া ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে ঢোকার অবৈধ পথটি বেশ বিপদসঙ্কুল। সেখানে নৌকাডুবিসহ নানা কারণে এই বছর প্রায়  এক হাজার ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

ইতালিতে যাওয়ার আগে বাংলাদেশ থেকে বিমানে দুবাই কিংবা তুরস্ক হয়ে লিবিয়া যায় তারা। আর এ জন্য ১০ হাজার ডলারের বেশি অর্থ পাচারকারীদের দিতে হয়। দাতব্য সংস্থা ও মানবাধিকার কর্মীদের এমনটাই জানিয়েছেন সাড়র থেকে উদ্ধারকৃত বাংলাদেশি কয়েকজন। এরপর লিবিয়া বা তুরস্ক থেকে ইতালিতে যেতে নৌপথের জন্য দিতে হয় ৭০০ ডলার।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষক নিকোলাস ম্যাকগিহানের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ঢাকা থেকে দুবাই পর্যন্ত রুটটিতে অসাধু জনশক্তি রপ্তানিকারকদের দৌরাত্ম্য রয়েছে। তারা (জনশক্তি রপ্তানিকারক) অনেক যুবকের কাছে স্বপ্ন বিক্রি করে কিন্তু সেই স্বপ্ন বেশিরভাগ সময় ভেঙে যায়।

রেমিটেন্সের আশায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সরকার জনশক্তি রপ্তানিতে এই অনিয়মের বিষয়ে উদাসীন বলেও মন্তব্য করেন নিকোলাস।

রেমিটেন্সের বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির বিষয়টি নিয়েও ভাবতে হবে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা অবৈধ পথে বিদেশ পাড়ি জমায়, গন্তব্যস্থলে পৌঁছলে রেমিটেন্স আসবে। আর যদি মধ্যপথে জীবননাশ হয় তাহলে দেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। প্রতিবেদনটির তথ্য নিঃসন্দেহে এক রূঢ় বাস্তবতাকে নির্দেশ করে। মানবাধিকারের প্রশ্নটিও এই সঙ্গে সামনে আসে।

অবৈধভাবে বিদেশ গমনের ব্যাপারে বরাবরই বাংলাদেশের নাম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচিত ছিল। সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদক্ষেপও নিয়েছে। কিন্তু তারপরও থেমে থাকেনি অবৈধপথে বিদেশ গমন। কয়েক বছর আগে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় কয়েকটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে মানবপাচারের বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোড়ন তৈরি হয়। সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো তখন নড়েচড়ে বসে।

মানব পাচার রোধ ও অভিবাসনের বিষয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে নানা পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এমনকি সংশ্লিষ্ট দেশের পক্ষ থেকে মানব পাচার রোধে কঠোরতার কথাও বলা হয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশ সরকাও তৎপর এই বিষয়ে। আমরা কিছুদিন পরপরই দেখি মানব পাচারকারীদের গ্রেপ্তার করছে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই তো গত  সপ্তাহেও কক্সবাজারে দুই বছর পর সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পাড়ি জমানোর অপেক্ষায় থাকা বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। ধরা হয়েছে পাচারকারীকেও। তারপরও বাস্তবতা হলো পাচারকারীরা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন স্থানে সক্রিয়। তার চেয়ে বড় কথা তারা সংঘবদ্ধভাবে সক্রিয়। আছে রাজনৈতিক আশ্রয়ও।

বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার সরকারের। বিশ্ববাসীর কাছে নিজেদের ভাবমূর্তি ঠিক রাখার জন্য তা জরুরি। এ ছাড়া যেসব রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ হয়ে, বাংলাদেশি পরিচয়ে বিদেশ পাড়ি জমাচ্ছে তার উৎস কোথায়, কীভাবে সম্ভব হচ্ছে তা সরকারকে খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ, বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ইউরোপ যাচ্ছে মানে হলো দেশে বসবাস সম্ভব হয় না ব্যাপারটিও তো নির্দেশ করে। এতে দেশের রাজীনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নটা ওঠে। যা বর্তমান সরকারের জন্য অবশ্যই ভাবার বিষয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ ও মধ্যম আয়ের দেশ কেবল রাজনৈতিক বুলি নয়, বিশ্বাস করি। তাই সরকারের ভাবমূর্তি বিশ্ববাসীর কাছে ঠিক রেখে প্রকৃত মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার জন্য দেশের নাগরিকের জীবন, তার মানবাধিকারের বিষয়টিও গুরুত্ব দিতে হবে। বিদেশ গমনেচ্ছুদের প্রশিক্ষণ দিয়ে, ব্যবহারিক জ্ঞান দিয়ে যথাযথ উপায়ে বিদেশে পাঠাতে হবে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ মে ২০১৭/রুহুল/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়