ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

নির্যাতনের অন্য নাম ইভটিজিং

নাসিব-ই-নূর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ১৯ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নির্যাতনের অন্য নাম ইভটিজিং

নাসিব-ই-নূর : ‘দীপার বয়স প্রায় ৪৫। আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্ত্ব ও বেশ রুচিশীল একজন মহিলা। এখনও বিয়ে করেন নি বা বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি। চাকরি করেন একটা স্বনামধন্য প্রাইভেট ব্যাংকে। প্রায় এক বছর ধরে অফিসের সবচেয়ে বয়স্ক এবং সর্বোচ্চ পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির দ্বারা যৌণ নির্যাতনের শিকার। দীপার সব কোয়ালিটির ভীড়ে, সবচেয়ে বড় কোয়ালিটি সে একা। দীপা তাকে কৌশলে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছেন কিন্তু কাজ হয়নি। অফিসের পরিবেশ নষ্ট হবে ভেবে অনেক দিন সহ্য করেছেন। কিন্তু সহ্যেরও সীমা আছে। বাধ্য হয়েই তাকে যেতে হলো কঠোর অবস্থানে। মানবসম্পদ (এইচআর) বিভাগে এবং অন্যান্য সহকর্মীকে জানালেন এই সমস্যার কথা। উত্যক্তকারী ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য এমন যে, সে কথা কারো বিশ্বাস হবার নয়। কিন্তু বুদ্ধিমতি দীপা প্রতিটি মেসেজ ও ই-মেইল সংরক্ষণ করেছিলেন যার ফলে সবাই ঘটনাটি বিশ্বাস করেন এবং একটা সমাধানে আসেন। (উপরের ঘটনা সম্পূর্ণ সত্য এবং এ কারণে এই নিবন্ধে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে)।

চর্যাপদে একটা পদ আছে- ‘অপনা মাংসে হরিণা বৈরী’। অর্থাৎ হরিণের সুস্বাদু মাংসই তার বাঘের শিকারে পরিণত হওয়ার মুখ্য কারণ। মেয়েদের অবস্থাও এর ঊর্ধ্বে নয়। ইভটিজিং আর মলেস্টেসন একটা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যপার হয়ে দাঁড়িয়েছে মেয়েদের জন্য। রাস্তায় বের হলে এমন ঘটনার শিকার হতে হবে- এটা মেনেই যেন মেয়েরা এখন ঘর থেকে বের হন। অফিসে সিটে বসেও শান্তি নেই অনেকেরই। অফিসে মেয়েদের যৌণ হয়রানির ঘটনাও নেহায়েত কম নয়।

সমীক্ষায় দেখা যায়, ১৯৮০ এর দশকের শেষ ভাগে এবং ১৯৯০ এর দশকের প্রথম ভাগে ১০ বছর বয়সী মেয়ে থেকে১৬ বছর বয়সী পর্যন্ত মেয়েরা স্কুলে যাওয়ার সময় ইভটিজিং-এর শিকার হত। উত্যক্তকারীর তালিকায় ছিল শুধু উঠতি বয়সের ছেলেরা| বর্তমানে অবস্থা ভয়াবহ, পানওয়ালা থেকে শুরু করে অফিসের কর্মকর্তা বা কর্মচারী, সবাই আছে এই তালিকায়। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা এমনকি বয়স্ক নারীরাও এ থেকে রেহাই পান না।  বর্তমানে অনেক মেয়েই জীবীকার তাগিদে ঘরের বাইরে বের হন। মেয়েদের যে কেউই এর শিকার হতে পারেন যে কোনো মুহূর্তে।

ইভটিজিং ও মলেস্টেশন- এর কিছু উল্লেখযোগ্য কারণঃ

১) পারিবারিক মূল্যবোধের অভাব।
২) নারীকে শুধুই ভোগ্য মনে করা।
৩) নারীর চুপ করে থাকা বা সহ্য করা।
৪) প্রয়োজনে আইনের সাহায্য না নেয়া।
৫) মাদকের অবাধ ব্যবহার।
৬) সহজলভ্য পর্নোগ্রাফি।
৭) পুরুষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি।
৮) অপসংস্কৃতি ও প্রযুক্তির যথেচ্ছা ব্যবহার।

কর্মক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য নারীদের একটু কৌশলী হওয়া প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে আপনি একদিনে মলেস্টেশনের শিকার হবেন না। মনে রাখুন যে, ধীরে ধীরে উত্যক্তকারী আপনার চারপাশের পরিবেশ বুঝে জাল বিছানো শুরু করে। প্রথমে শুরু হয় আপনার সৌন্দর্য্য বর্ননা, এরপর তা মোড় নেয় অন্যদিকে। অশালীন মন্তব্য, কুরুচিকর ছবি দেখানো অথবা ই-মেইলে বা মোবাইল টেলিফোনে মেসেজ দেয়া সবই উত্যক্তের পর্যায়ে পরে। নারী কর্মীকে এমন কোন কাজ দেয়া, যা তাকে অফিস টাইমের পর থাকতে বাধ্য করবে- এইসব অশনি সঙ্কেত। সুযোগ তৈরি করে দেবেন না, প্রথমেই এড়িয়ে চলতে শুরু করুন বা পরিস্থিতি বুঝে প্রতিবাদ করুন। মেনে নিলেন তো পথ পরিস্কার করে দিলেন। আপনার একাকিত্বের কথা অথবা আপনার সঙ্গীর অপর্যাপ্ত সময়ের কথা, পারিবারিক দুঃখ কারো সাথে শেয়ার না করাই ভাল। কুচক্রী ব্যক্তিরা এইসব সুযোগের সন্ধান করে। সহানুভূতি দিয়ে আপনার বিশ্বস্ততা আদায় করে, আপনার দুর্বলতার সুযোগ নিতে তার একটুও বাঁধবে না। আপনার বুদ্ধিমত্তা আপনার সম্বল।

মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় অনেক প্রখর। এমন কিছু আপনি নিজেই সবার আগে বুঝতে পারবেন। চুপ করে থাকবেন না। কাছের জনকে জানান- প্রয়োজনে  আইনের সাহায্য নিন। ই-মেইল করে বা মেসেজ দিয়ে উত্যক্ত করা হলে সেগুলো নষ্ট না করে সংরক্ষণ করুন। ইভটিজিং সম্পর্কে আইন আছে।  ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ৭৬ নম্বর অধ্যাদেশেও স্পষ্ট বলা আছে ‘যদি কেউ কোন রাস্তায় বা সাধারণের ব্যবহার্য স্থানে বা সেখান হতে দৃষ্টিগোচরে স্বেচ্ছায় এবং অশালীনভাবে নিজ দেহ এমনভাবে প্রদর্শন করে যা কোন গৃহ বা দালানের ভিতর থেকে হোক বা না হোক কোন মহিলা দেখতে পায় বা স্বেচ্ছায় কোন রাস্তায় বা সাধারণের ব্যবহার্য স্থানে কোন নারীকে পীড়ন করে বা তার পথ রোধ করে বা কোন রাস্তায় বা সাধারনের ব্যবহার্য স্থানে কোন অশালীন ভাষা ব্যবহার করে, অশ্লীল আওয়াজ, অঙ্গভঙ্গি বা মন্তব্য করে কোন মহিলাকে অপমান বা বিরক্ত করে তবে সেই ব্যক্তি ১ বৎসর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদণ্ডে অথবা ২ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

যার দ্বারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তাকে সরাসরি জানিয়ে দিন যে আপনি তার এই আচরণের জন্য বিরক্ত হচ্ছেন এবং প্রয়োজনে অন্যদের জানিয়ে দেবেন। আর সেই ব্যক্তি নিজেই যদি কর্তাধর্তা হন সেক্ষেত্রে আপনার কী করনীয়? এইচআর বিভাগকে অবহিত করুন। সেই ব্যক্তিকে জানান, আপনি প্রয়োজনে তাকে আইনের আওতায় আনবেন। আপনি যদি ভাবেন চাকরি হারাবেন- সেটা ভুল। আপনার চাকরি যাওয়ার সম্ভাবনা এক্ষেত্রে থাকবে না। চাকরি গেলে সবাই জানবে আপনাকে কী কারণে চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে, ব্যাখ্যা দিতে গেলে উনি নিজেই বিপদে পরে যাবেন। সহ্য করা ছেড়ে দিন। আর কত ?

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না’ এবং ৩৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে  ‘জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, ইহার যে কোন স্থানে বসবাস ও বসতি স্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ ফলে কোন নারী যদি রাস্তায় বা কর্মক্ষেত্রে টিজিংএর শিকার হন তাহলে তা সংবিধানে দেওয়া অধিকার খর্ব বলে ধরে নেয়া যায়। অর্থাৎ আপনি আইনের সাহায্য নিতে পারেন। প্রয়োজনে একটা জিডি করে সেই কপি অফিসের এইচআর বিভাগে জমা দিয়ে রাখুন।

ইভটিজিং বা মলেস্টেশন রোধে পারিবারিক দায়িত্বঃ

আপনি মেয়ে, আপনি মা। আপনার সন্তানকে শিক্ষা দিন। নারী-পুরুষ সম্পর্ক পরিষ্কার ভাবে উপস্থাপন করুন তাদের সামনে। আপনার ছোট ছেলে সন্তানটি একদিন বড় হবে। তার দ্বারা যেন এমন কিছু না হয় সেই ব্যবস্থা করতে হবে আপনাকেই। আপনার মেয়েকে শেখান- কীভাবে সে এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলাবে। কখনো চুপ করে থাকার শিক্ষা দেবেন না মেয়েকে।

অত্যন্ত উদ্বেগের ও দুঃখের বিষয় হলো, বেশিরভাগ মেয়েই মুখ বুজে সহ্য করে যৌন নির্যাতনের মত অন্যায়। মুখ খুলতে শিখুন, ঘুরে দাঁড়ান, উত্যক্তকারীর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করুন, ‘আমাকে কিছু বলছেন?’ প্রয়োজনে হাত-পা চালাতে শিখুন। একদিন যদি প্রতিবাদ করেন দেখবেন দ্বিতীয় দিন সে তো নয়ই, অন্য অনেকেই সাহস করবেনা আপনার দিকে তাকাতে। আপনার চোখের হীম শীতল চাহনী যেন উত্যক্তকারীর অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেয়। সাহস করুন, বিশ্বাস করুন, আপনিই জয়ী হবেন। সর্বোপরি সচেতন হোন। আপনার হাতিয়ার আপনি নিজেই।

লেখক : ব্যাংক কর্মকর্তা।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ মে ২০১৭/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়