ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

বাজেট স্বল্পতার কারণে সঙ্কটের মুখে এইচআইভি প্রোগ্রাম

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:১৪, ২০ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাজেট স্বল্পতার কারণে সঙ্কটের মুখে এইচআইভি প্রোগ্রাম

হাসান মাহামুদ: বর্তমানে বিশ্বে তিনটি মরণঘাতি রোগ, এইডস, যক্ষা ও ম্যালেরিয়া। আর এই তিনটি রোগ প্রতিরোধ সম্ভব তিনটি জিনিস থাকলে। তা হলো- প্রতিশ্রুতি, প্রত্যয় আর সংহতি।

কথাগুলো উঠে এসেছিল গত বছরের সেপ্টেম্বরে কানাডার মন্ট্রিলে অনুষ্ঠিত পঞ্চম বিশ্ব তহবিল পুনর্গঠন সম্মেলনে। আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রীও। হোটেল হায়াত রিজেন্সিতে অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে এই তিনটি মরণঘাতি রোগ এইডস, যক্ষা ও ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে গোটা বিশ্বকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করতে আন্তর্জাতিক তহবিল সহযোগিতাও চেয়েছিলেন তিনি।

‘বিশ্ব তহবিল পুনর্গঠন’ সর্ম্পকে একটু বলা প্রয়োজন। সারাবিশ্বে এইডস, ম্যালেরিয়া ও যক্ষা রোগ থেকে মানুষকে সুরক্ষা দেওয়াই এই বৈশ্বিক তহবিল গঠনের মূল লক্ষ্য। এই তহবিল থেকে বিভিন্ন দেশকে বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সহায়তা দেওয়া হয়।

কিন্তু যখনই সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এমডিজিতে এইডস নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়টি অর্ন্তভুক্ত হয়, তখন বিষয়টি আরো প্রাধান্য পায়। কিন্তু ২০১৫ সালে এমডিজি’র সময়সীমা শেষ হওয়ার পর থেকে এইডস নিয়ন্ত্রণের সহায়তা কমে যায়। এই অবস্থা সারাবিশ্বেই। এরপর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজিতেও পরোক্ষভাবে এইডস নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি এসেছে। বিশ্বব্যাপী এইডস নির্মূলের অঙ্গীকারের সঙ্গে বাংলাদেশ একাত্মতা প্রকাশ করেছে।  এমনকি বাংলাদেশও আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ‘এইডসমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়তে চায়।

এ জন্য সর্বপ্রথম এই সংক্রান্ত চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি বাড়াতে হবে। এর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি জড়িত, তা হলো বাজেট বরাদ্দ। এখন মে মাস চলছে, বাজেট প্রণয়নের সময়। তবে এই সময়ে নীতিনির্ধারকরা এই বিষয়ে আরেকবার হয়তো ভেবে দেখতে পারেন। কারণ এ বিষয়ে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম এবং এইচআইভি প্রোগ্রাম পরিচালনায় বাজেট খুব প্রয়োজনীয়। আর্থিক বাজেট স্বল্পতার কারণে এইচআইভি প্রোগ্রাম অনেকটা সঙ্কটের সম্মুখীন। এইচআইভি প্রোগ্রামে বিদেশের আর্থিক সহায়তা অনেকটা কমে এসেছে। এখন সরকারের এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা খুব প্রয়োজন।

যতদূর জানি,  বাংলাদেশে এইচআইভি-এইডস প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাগুলো কাজ করছে। এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য প্রয়োজনীয় সরকারি চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা এখনো কম। বেসরকারি কিছু সংস্থার মাধ্যমে রোগীদের সেবা দেওয়া হলেও তা যথেষ্ট নয়। এ অবস্থায় এইডসের প্রতিকার ও প্রতিরোধ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এইডসের চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য সচেতনতা জরুরি, পাশাপাশি আক্রান্তদের চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে।

এইডস নিয়ন্ত্রণে আমাদের অনেক ভালো উদ্যোগ অর্থসংকটের কারণে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। তবে নজরদারি অবশ্যই ধরে রাখতে হবে। দেশে এইচআইভি আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর হার কমেছে। তবুও মনে রাখা দরকার, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব ‘এইচআইভি সংক্রমণ’ মুক্ত হতে চায়। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে কাজের ধরনে পরিবর্তন আনতে হবে।

এইচআইভি প্রতিরোধে এত দিন ধরে যে কৌশল ব্যবহার করা হচ্ছে, সময় এসেছে তা বদলানোর। এই ক্ষেত্রেও সরকার ডিজিটালাইজেশন সিস্টেম ব্যবহার করতে পারেন। মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছাতে হলে প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করা যেতে পারে।  সময়ের সঙ্গে আমরা অনেক কিছু বদলিয়েছি। কিন্তু এইচআইভি প্রতিরোধের কৌশল বদলায়নি। বিশেষ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে বিশেষ কৌশলে কাজ করতে হবে। অথচ ক্রমান্বয়ে এইচআইভি প্রোগ্রামের বাজেট ছোট হয়ে আসছে। এইচআইভি নির্মূলের বিশেষ লক্ষ্য পূরণ করতে হলে অবশ্যই দেশীয় বাজেট বাড়াতে হবে।

সরকার ও দেশে যারা এইচআইিভ নিয়ে কাজ করছেন, তাদের সবার মধ্যে সমন্বয় খুব জরুরি। আমাদের একটি দুর্বলতা হলো, আমাদের কাছে সঠিক তথ্য নেই। আবার এই রোগ নিয়ে রয়েছে কুসংস্কারও। এইচআইভি রোগীকে একধরনের অপরাধী হিসেবে সমাজে দেখা হয়, ফলে তার মধ্যে ভীতি কাজ করে। এ জায়গা থেকে তাকে বের করে আনতে হবে। মনে রাখতে হবে, শুধু অনৈতিক যৌনমিলনের মাধ্যমেই এ রোগ ছড়ায় না। অন্য অনেকভাবেও ছড়াতে পারে। এ জন্য সমাজকে এইডস রোগীর প্রতি বাস্তবসম্মত মনোভাব গ্রহণে প্রস্তুত করতে হবে।

বিভিন্ন জায়গায় এইচআইভি পরীক্ষা করার ক্ষেত্রে অনেক ধরনের বিড়ম্বনারও শিকার হতে হয়, তাদের অন্যদের থেকে আলাদাভাবে দেখা হয়। এক্ষেত্রে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের ব্যবস্থা করা জরুরি।

আমাদের আরেকটি জায়গায় কাজ করা উচিত। তা হলো, এইডস নিয়ে আমরা যেন মানুষের মধ্যে ভয়ের জায়গা তৈরি না করি। এইডসে মারা গেলে বলি এইডসে মারা গেছে। কিন্তু আমরা বলি না ডায়াবেটিসে মারা গেছে বা অন্য কোনো রোগে মারা গেছে।

অন্যান্য রোগীকে আমরা যেভাবে দেখি, এইডস রোগীকে যেন সেভাবে দেখা হয়। সরকার থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে ১৮ বছরের নিচে শিশুদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। কারণ এ বয়সে বিভ্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি। তাই তাদের সচেতনতা খুব দরকার।

আমরা মূলত ১৯৯৫ সাল থেকে গত ২০ বছরের ফলাফল হিসাব করি। এই ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে আগামী ১০-১৫ বছরের সম্ভাব্য ফলাফল দেখার চেষ্টা করি। এক্ষেত্রে আমরা মোটামুটি সফল, বলতে পারি। গত ২০ বছরে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা ১ লাখ ৪১ হাজার সংক্রমণ ঠেকিয়ে রেখেছি। অনুমান করা হয়, দেশে প্রায় নয় হাজার এইচআইভি পজিটিভ ব্যক্তি আছে। এর মধ্যে শনাক্ত করা গেছে মাত্র ৪ হাজার ১৪৩ জনকে।

দেড় লাখ মানুষের সংক্রমণ যদি না ঠেকানো যেত, তবে বাংলাদেশে একটি বিশাল অঙ্কের এইচআইভি পজিটিভ ব্যক্তি থাকত। সুতরাং এটি দেশের জন্য একটি বিশাল অর্জন। এখন যে এলাকায় সংক্রমণের হার বেশি, সেখানে কাজ করা জরুরি। ২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে এইচআইভি পরীক্ষার হার বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে যৌনকর্মীসহ ঝুঁকিপূর্ণ সব জনগোষ্ঠীকে বিশেষভাবে পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। এটা করতে পারলে এইচআইভি প্রতিরোধের চ্যালেঞ্জ অর্জন করা অসম্ভব নয়।

আজ থেকে ৩৪ বছর আগে ১৯৮৩ সালের আজকের দিনে (২০ মে) সায়েন্স ম্যাগাজিনে এইচআইভি ভাইরাস সম্পর্কে প্রথম নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেই থেকে এই রোগ প্রাণঘাতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।

সরকার ও বেসরকারি সংস্থার বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে এইডস সম্পর্কে এখন মানুষ জানতে পারছে। সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও সরকার বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি চালাচ্ছে। এইডসকে রুখতে হলে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি খুব দরকার। এইচআইভি সংক্রমণ রোধে এবং এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে গণমাধ্যমও ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। সামাজিক বৈষম্য, কুসংস্কারের জন্য সবাই পরীক্ষা করান না। যেকোনো মূল্যে এটা দূর করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদন থাকতে পারে। সামাজিক বৈষম্য, কুসংস্কারের জন্য সবাই পরীক্ষা করান না। যেকোনো মূল্যে এটা দূর করা প্রয়োজন।

সর্বোপরি, এইচআইভি নির্মূলের বিশেষ লক্ষ্য পূরণ করতে হলে অবশ্যই ঘরোয়া বাজেট বাড়াতে হবে। কারণ বিভিন্ন কর্মসূচিতে এসব প্রোগ্রাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে ব্যাপক জনগোষ্ঠী রোগটি সম্পর্কে জানতে পারবে, সচেতন হতে পারবে। প্রান্তিক এবং বিশাল জনগোষ্ঠিকে সচেতনতার পর্যায়ে না নিয়ে আসতে পারলে আমাদের লক্ষ্য অর্জন দুষ্কর হবে।

লেখক: সাংবাদিক।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ মে ২০১৭/হাসান/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়