ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সত্যেন সেনের জন্ম-মৃত্যুর তারিখ আজো অমীমাংসিত

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ২৮ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সত্যেন সেনের জন্ম-মৃত্যুর তারিখ আজো অমীমাংসিত

সত্যেন সেনের প্রতিকৃতি, শিল্পী : কাইয়ুম চৌধুরী

হাসান মাহামুদ : বাংলা সুরের ভুবনে স্বপ্নবাজ শিল্পী বলা হয় সঞ্জীব চৌধুরীকে। বহু প্রতিভার অধিকারী এই গুণী শিল্পী বৈচিত্র্যপূর্ণ গায়কীর পাশাপাশি বিখ্যাত ছিলেন ভিন্নধারার লিরিকের জন্য। তিনি লিখেছিলেন, ‘একটা চোখে কাজল আর অন্য চোখ সাদা/ তুমি গভীর ঘুমে আমার শুধুই গলা সাধা’। গানের কথাগুলো মনে করিয়ে দেয় কিংবদন্তি সত্যেন সেনের কথা। যার দু’চোখে পাশাপাশি বসবাস করতো ‘শিল্প’ ও ‘বিপ্লব’।

আমরা তাকে জানি সংগ্রামী হিসেবে। জাতীয় স্বার্থে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন ও সংগ্রাম করেছেন। জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তাকে জেলে থাকতে হয়েছে। আজীবন কমিউনিস্ট বিপ্লবী এবং শ্রমিক সংগঠক ছিলেন। অথচ এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব একাধারে প্রগতিশীল লেখক, সাহিত্যিক এবং উদীচী সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি সাংবাদিকতার সাথেও যুক্ত ছিলেন। দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন। ‍তিনি ছিলেন মেহনতি মানুষের এক পরম সুহৃদ।

আজ এই বহু প্রতিভাধর মানুষটির জন্মদিন। ১৯০৭ সালের ২৮ মে সত্যেন সেনের জন্ম। তবে তার জন্ম তারিখটা নিয়ে একটু ভিন্নমত রয়েছে। ‘জীবন কথা’ নামের একটি বইয়ে সত্যেন গবেষক কাজল বন্দ্যোপাধ্যায় ও নজরুল আলম লেখেন সত্যেন সেনের জন্ম ২৮ মে ১৯০৭। আবার সত্যেন সেনের বোন প্রতিভা সেনের উদ্ধৃতি দিয়ে ‘সত্যেন সেন’ নামক গ্রন্থে ড. সৌমিত্র শেখর লেখেন- সত্যেনের জন্ম ২৮ মার্চ ১৯০৭। যদিও উল্লেখিত দু’টি তারিখই বাংলাদেশ ভারতে ব্যবহৃত হচ্ছে। তার জন্মস্থান মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গীবাড়ি উপজেলার সোনার গ্রামে।

ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘যে দেশে গুণের কদর নাই সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না।’ তেমনি আবদুল হাকিম তার বঙ্গবাণী কবিতায় লিখেছেন, ‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী। সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি॥’’
কিছু বিষয় সামনে আসলে সত্যিই এই দৈন্যতা চোখে পড়ে। কিংবদন্তি সত্যেন সেনের জন্মতারিখ এবং মৃত্যুতারিখের জটিলতার দিকে তাকালে এই দৈন্যতা স্পষ্ট হয়ে উঠে। সত্যেন সেন মারা গেছেন ১৯৮১ সালে। গত ৩৬ বছরেও এই কিংবদন্তির জন্ম ও মৃত্যুতারিখ ঠিক করা হয়নি। এমনকি এই জটিলতার অবসান করার জন্য জাতীয়ভাবে কখনো আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ২৮ মার্চেই সত্যেন সেনের জন্মবার্ষিকী উদযাপন করে। উইকিপিডিয়াতেও এই তারিখেই তার জন্মের কথা বলা আছে। অথচ বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ ‘বাংলাপিডিয়া’তে সত্যেন সেনের জন্মতারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ২৮ মে। তবে জন্মস্থানের ক্ষেত্রে অভিন্ন তথ্যই পাওয়া যায়। আবার বিভিন্ন মাধ্যমে বলা হয়, ১৯৮১ সালের ৫ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে তার মৃত্যু হয়। বাংলাদেশের নব্বই দশকের স্বনামধন্য কবি, ছড়াকার ও প্রাবন্ধিক তপন বাগচী এই তথ্য বাংলাপিডিয়াতে উল্লেখ করেছেন। আরো কিছু মাধ্যমেও এই তারিখ পাওয়া গেছে। কিন্তু উদীচী, উইকিপিডিয়াসহ কয়েক স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে, শান্তি নিকেতনের গুরুপল্লীতে ১৯৮১ সালে ৫ জানুয়ারি তিনি মারা যান।

সত্যেন সেনের মতো একজন কিংবদন্তির ক্ষেত্রে এই অসঙ্গতি থেকে যাওয়া, তার প্রতি অবহেলার শামিল। এটি কখনোই কাম্য নয়। আমরা চাই অন্তত সত্যেন সেনের হাতে গড়া উদীচী তার জন্ম ও মৃত্যু তারিখের এই জটিলতা নিরসনের উদ্যোগ নেবে। প্রয়োজনে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সাহায্য নিতে পারে তারা। কিংবা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নিজেরাও এই উদ্যোগ নিতে পারে। কারণ কিংবদন্তিরা যুগে যুগে জন্মায় না। তাদের যোগ্য মর্যাদা দিতে হয়।

এতকিছুর ভেতরেও সত্যেন সেনের একটি বিশেষ দিক আমাদের অনেকের কাছে অজানা রয়ে গেছে। আর তা হলো, সত্যেন সেন ‘গদ্য সাহিত্যের স্বর্ণকারিগর’ হিসেবেও মূল্যায়িত এবং সংজ্ঞায়িত ছিলেন। সত্যেন সেন- একটি নাম, বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির একটি প্রোজ্জ্বল অধ্যায়। জেল প্রকোষ্ঠে বসেও তিনি লিখেছেন নিরন্তর। তিনি বাইবেলের কাহিনী নিয়ে লিখলেন দুখানা উপন্যাস- ‘অভিশপ্ত নগরী’ ও ‘পাপের সন্তান’।

সংবাদপত্রে যা চারণ সাংবাদিকতা নামে পরিচিত, তার মূল দলিল বলা হয় সত্যেন সেনের লেখা ‘গ্রাম বাংলার পথে পথে’ গ্রন্থটিকে। ভ্রমণের অভিজ্ঞতা কীভাবে লিখতে হয় তার আদর্শলিপি এই গ্রন্থটি। তার লেখার যে সারল্য ও সাধারণ শব্দের ব্যবহারের কৌশল, তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। একজন মার্কসবাদী লেখকের গদ্য শৈলী যে মাপের হয়, সেই মাপেই সত্যেন সেনের প্রতিটি উপন্যাস ও প্রতিবেদনের ভাষা নির্মিত হয়েছে।

সত্যেন সেন লিখতেন শুধু মাত্র মনের তাগিদে নয়, সমাজের দায় থেকে। সমাজ বদল যার চেতনায়-মননে-অন্তরের গহীন তল্লাটে ভর করে আছে তার শব্দ নির্মাণের কাঠামো আর দশজনের থেকে আলাদা হবে এটাই স্বাভাবিক। তিনি লিখেছেন রাজনৈতিক উপন্যাস, ঐতিহাসিক উপন্যাস, সামাজিক উপন্যাস, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কাহিনী, বিজ্ঞান বিষয়ক ছোটদের লেখা, কারা-উপন্যাস প্রভৃতি।

পরিণত বয়সে এসেই সত্যেন সেন সাহিত্য কর্ম শুরু করেন। তাঁর কাছে সাহিত্যই ছিল সংস্কৃতির প্রাণ। সেই সংস্কৃতিকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যই তিনি আশ্রয় নেন সাহিত্যের। সেই দিক থেকে বাংলা সাহিত্যের জনজীবনমুখী, সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার সাহিত্য নির্মাণের অগ্রপথিক ছিলেন সত্যেন সেন। সত্যেন সেনের নিজের ভাষায়, ‘মানুষের কাছে যে কথা বলতে চাই, সে কথা অন্যভাবে বলতে পারবো না, সে জন্যই সাহিত্যের আশ্রয়।’ এই সময় তিনি পুরোটাই মগ্ন থাকেন সাহিত্য সৃজনে। শুধুমাত্র ১৯৬৯ সালেই তিনি রচনা করেন ছয়টি গ্রন্থ ও ১৯৭০ সালে তার এগারটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৯৬৯ সালে ‘পাপের সন্তান’ উপন্যাসের জন্য তিনি ‘আদমজী সাহিত্য পুরস্কার’ ও ১৯৭০ সালে তিনি সাহিত্য কর্মের জন্য ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ পান। ১৯৮৬ সালে তাকে ‘একুশে পদক (মরণোত্তর)’ দেওয়া হয়।

সত্যেন সেনের জীবনের একটি বড় অংশ কেটেছে সাংবাদিকতায়। তিনি পেশাগত জীবনে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় যুক্ত ছিলেন। সেখানে তিনি নিয়মিত কলাম লিখতেন ও অনুসন্ধানী প্রবন্ধ লিখতেন। এ পত্রিকায় যুক্ত থাকাকালেই তিনি বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে কৃষক আন্দোলনের অনেক তথ্য সমৃদ্ধ কাহিনী জানতে পারেন। যা পরে তার বিভিন্ন বই রচনায় কাজে লাগিয়েছেন।

১৯৬৮ সাল সত্যেন সেনের জীবনে এক বিশেষ তাৎপর্যময় সময়। এ সময় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন তার স্বপ্নের সংগঠন ‘বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী’। শিল্পী সাইদুল ইসলামের নারিন্দার বাসায় সত্যেন সেনসহ মাত্র ছয়জনকে নিয়ে শুরু হয় এই সংগঠনের যাত্রা। সত্যেন সেন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকে বিকশিত করার লক্ষ্যেই এই সংগঠন গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এখনো পর্যন্ত উদীচী সেই লক্ষ্যকেই সামনে রেখে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

সত্যেন সেন কৃষক আন্দোলনের সাথেও জড়িত ছিলেন। একই সাথে ঢাকেশ্বরী কটন মিল, লক্ষীনারায়ণ কটন মিল, চিত্তরঞ্জন কটন মিল ও ঢাকা নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন পাটকলে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং শ্রমিক শ্রেণিকে তাদের ন্যায্য মজুরি, দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এছাড়াও এই সময় তিনি জড়িত হয়ে পড়েন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথেও। 

যে মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মানুষের জন্য, সমাজের জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য, তার দৈহিক মৃত্যু হলেও আদর্শের অনির্বাণ শিখা সদা দীপ্যমান। তাই আজও প্রতিটি লড়াই-সংগ্রামে, আমাদের অর্জন আর ত্যাগে সত্যেন সেন আমাদের অনুপ্রেরণা, আমাদের ভবিষ্যতের পাথেয়। বর্তমানের সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিতে সত্যেন সেনের আদর্শ ও জীবনের পাঠ অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে সত্যেন সেন সংক্রান্ত যাবতীয় অসঙ্গতি ও তথ্যবিভ্রাট লাঘবের জন্য উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।

লেখক: সাংবাদিক।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ মে ২০১৭/হাসান/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়