ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

ছুটির ফাঁকি, ছুটিকাহন, ছুটির পাঁচমিশালী

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২৯ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছুটির ফাঁকি, ছুটিকাহন, ছুটির পাঁচমিশালী

হাসান মাহামুদ: ‘ছুটি’ নিয়ে বাংলা ভাষা এবং বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বহুল পঠিত কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে/ বাদল গেছে টুটি,/ আজ আমাদের ছুটি ও ভাই/ আজ আমাদের ছুটি’। ছুটি মানেই আনন্দ, ছুটি মানেই বাধাহীন উচ্ছ্বাসের উপলক্ষ্য। ঠিক যেন, ‘কী করি আজ ভেবে না পাই’ ধরনের অনুভূতি।

বৃটিশরা এই ভারতবর্ষে প্রশাসনিক কাঠামো প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে ‘ছুটি’ বিষয়টির রেওয়াজ চালু করে। এর আগেও অবশ্য এই অঞ্চলে ছুটি ছিল। ডাচ, ওলন্দাজ কিংবা তারও আগে গোষ্ঠীভিত্তিক, রাজ্যভিত্তিক প্রশাসনিক কার্যক্রমের সময়েও ছুটির প্রচলন ছিল। কিন্তু বিষয়টি কাঠামোগত বিষয়ে দাঁড়ায় ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরেই। বৃটিশরা বিদায় নেওয়ার পর পাকিস্তান, তারপর স্বাধীন বাংলাদেশ। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ছুটি বিষয় আকার বা অবয়ব ঠিক রেখেই চলে এসেছে। অর্থাৎ বৃটিশ আমল থেকে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে অভিন্ন ছুটি প্রচলিত ছিল। ওই সময়ে ছুটির আবেদনও ছিল অন্যরকম।

কিন্তু ২০ বছর আগে আজকের দিনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশে ছুটিতে পরিবর্তন আনেন। ১৯৯৭ সালের ২৯ মে সরকার কর্তৃক শুক্র-শনি দু’দিন ‘সরকারি ছুটি’ ঘোষণা করা হয়। এরপর এটি একবার বন্ধ হয়, পুনরায় চালু হয়। এখন পর্যন্ত দুদিন ছুটির বিষয়টি প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু শুরু থেকেই কিছু গোঁজামিল ছিল এই দুদিনের ছুটিতে। সেসব এখনো রয়ে গেছে। এর মধ্যে সরকারের মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ থেকে কয়েকদফা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কিছু বিষয় অমীমাংসিতই থেকে গেছে।

বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার দাবি উঠেছে অনেক আগে থেকেই। সরকারের পক্ষ থেকে কয়েক দফা এ বিষয়ে মতামত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি আর সমাধানের মুখ দেখেনি। বিশেষ করে আড়াই-তিন বছর আগেও ক্রমবর্ধমান হরতাল ও রাজনৈতিক গোলযোগের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি নিয়ে নতুন করে ভাবনার প্রয়োজন বলে মত দিয়েছিলেন কম করে হলেও এক ডজন শিক্ষাবিদ। মতামত দিয়েছিলেন খোদ ‘সাবেক আমলারা’ও।

বাংলাদেশে এখন সাপ্তাহিক সরকারি ছুটি শুক্র ও শনিবার। যদিও সরকারস্বীকৃত বা সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই দু’দিন বন্ধ থাকে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধুমাত্র শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকে। অন্যদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে সাপ্তাহিক ছুটি শুক্র ও শনিবার।

শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে নয়, ঢাকাসহ সারাদেশের প্রধান প্রধান বিদ্যালয়, কলেজগুলোতে সাপ্তাহিক ছুটির এই অসমতা রয়েছে। নটর ডেম কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দু’দিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকে। আবার শুধু শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল, রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।

যদিও মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপন অনুসারে- সরকারের ছুটি-সম্পর্কিত সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, ‘এই ছুটি সব অফিস, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের বেলায় প্রযোজ্য। ..আবার, যেসব প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব আইনকানুন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত কিংবা সরকারের জরুরী বিভাগ, তারা জনস্বার্থ বিবেচনা করে ছুটি ঘোষণা করবে।

রাজধানীতে আবার এমন কিছু স্কুল দেখা যায়, যারা শনিবার স্কুল বন্ধ রাখে কিন্তু শিক্ষার্থীদের এক্সট্রা ক্লাস বা টিউটোরিয়াল নেয়। আবার সরকারের কিছু মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর বিশেষ কারণে নিজেদের নির্বাহী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে শনিবার অফিসিয়াল কার্যক্রম পরিচালনা করে। এইতো দুদিন আগেই শনিবারে অর্থমন্ত্রী সচিবালয়ে অফিস করলেন, ভ্যাট নিয়ে কথা বললেন। এছাড়া বর্তমানে দেশের প্রায় সকল ব্যাংকের প্রধান শাখাগুলো শনিবারে খোলা থাকে নিয়মিত।

ছুটির দিনে অফিসিয়াল কার্যক্রম পরিচালনা করলে কর্মরতরা অতিরিক্ত ভাতা পাবেন এটাই নিয়ম। এক্ষেত্রে অনুপাত নির্দিষ্ট করে সরকারের নির্দেশনাও রয়েছে। কিন্তু সেখানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা মিলে অসমতার। কারণ সকল স্তরের কর্মকর্তা এই ভাতা এক হারে পান না।

জাতীয় উপলক্ষ্যগুলোতে ছুটি নিয়ে অসঙ্গতি রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বার্ষিক ছুটি ও সরকারি কার্যালয়ের বার্ষিক ছুটির মধ্যেও পার্থক্য আছে। যেমন, ঈদে সরকারি ছুটি থাকে সাধারণত তিন দিন করে, কিন্তু অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তা সাত দিন করে। দুর্গাপূজায় সরকারি ছুটি এক দিন, কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিন-চার দিন। এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন কিছু ছুটি আছে, যা সরকারি ছুটিতে নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিছু ছুটি আছে, যে ছুটিতে শ্রেণিপাঠ থাকে না। তবে স্কুলের অফিসিয়াল কাজ চলে। ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাস করেন না, কিন্তু স্কুলে আসতে হয় শিক্ষকদের।  তখন শিক্ষকদের মধ্যে ছুটি-ছুটি একটা ভাব থাকে। যেমন রমজান মাস কিংবা গ্রীষ্ম অবকাশকালে। শিক্ষা প্রশাসনে যারা আছেন, তাদের কথা পৃথক। তবে এটা ঠিক, নির্দিষ্টভাবে ছুটি থাকা আর ছুটি-ছুটি ভাব থাকা এক কথা নয়। ‘ছুটি-ছুটি’র মধ্যে একটি অস্থিরতাও আছে। তা ছাড়া ছুটির মধ্যে পরীক্ষার দায়িত্ব পালনও শিক্ষকদের নিত্যকর্মে পরিণত হয়েছে।

ছুটির ক্ষেত্রে শিক্ষকরা আরো দ্বিমুখী নীতির শিকার। সরকারি চাকুরিজীবী ও শিক্ষকদের অর্জিত ছুটির মধ্যে বিভেদ রয়েছে। সরকারি চাকুরিজীবীরা প্রতি ১০ দিনে এক দিন, কিন্তু সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকেরা প্রতি ১১ দিনে এক দিন অর্জিত ছুটি সঞ্চয় করেন। এর  বাইরে রয়েছে, মূল্যমান বিবেচনার ক্ষেত্রে অসমতা: সরকারি চাকরিজীবীরা তাদের অর্জিত ছুটি ভোগ করেন পূর্ণ গড়বেতনে, কিন্তু শিক্ষকেরা (সরকারি বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়েরও) অর্ধ গড়বেতনে, যা আর্থিকভাবে শিক্ষকদের জন্য বিশেষ ক্ষতি। এটি অবশ্যই শিক্ষকদের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

ছুটি একটি সার্বজনীন অধিকার। ছুটির লাভ-ক্ষতির অংশীদারও সবারই সমান হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে সরকারি চাকুরিজীবী ও শিক্ষকদের একই সঙ্গে অর্জিত ছুটি গণনা ও মূল্যমান বিবেচনার ক্ষেত্রে বিদ্যমান অসমতা দূর করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ উদ্যোগী হয়ে জরিপ পরিচালনা বা মতামত সংগ্রহ করে দেখতে পারেন, শনিবারের ছুটিটা কী আদৌ আমাদের জন্য দ্রুত উন্নতির দিকে ছুটে চলা দেশের জন্য প্রয়োজন?

লেখক: সাংবাদিক।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ মে ২০১৭/হাসান/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়