ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ফ্রিজ নিয়ে কথকতা

জাহাঙ্গীর আলম বকুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩৯, ২৯ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফ্রিজ নিয়ে কথকতা

জাহাঙ্গীর আলম বকুল : ৮/১০ বছর আগে, থাকতাম ঢাকার মিরপুরের একটা মেসে বন্ধুদের সঙ্গে। কাজ করতাম একটা দৈনিক প্রত্রিকায়। বন্ধনহীন জীবন ছিল তখন। নিয়মের মধ্যে শুধু সময় মতো অফিস করা। বাসায় ফেরার তাগিদ নেই। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে থাকা, দল বেঁধে সিনেমা দেখা, রাত জেগে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখে হৈ-হুল্লোড় করে সময় কাটত। ভালোই কাটছিল দিনগুলি। কিন্তু কাজের বুয়ার অত্যাচার ছিল অসহনীয়।

এই অত্যাচার থেকে কিছুটা পরিত্রাণের জন্য সিদ্ধান্ত নিলাম একটা ফ্রিজ কিনব। মেসের সবাই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাল। যথা সিদ্ধান্ত তথা কাজ। শুরু হলো  ফ্রিজ কেনার অভিযান।

ফ্রিজের বাজারে আমি অজ্ঞ ক্রেতা। বাহারি রংয়ের ফ্রিজে ভর্তি দোকান। যে দোকানে যাই- বিক্রেতা তার মতো করে বোঝান, তার পণ্যটি সেরা প্রমাণ করে বিক্রির চেষ্টা করেন। তাদের কথা শুনে বোঝার চেষ্টা করি কোন জিনিসটির মান কেমন। আমি এই বিষয়ে অজ্ঞ বুঝতে পেরে তারা বিভ্রান্ত করেন। ফলে সাধ-সাধ্য অনুযায়ী পছন্দের ফ্রিজ কেনা কঠিন হয়ে পড়ল।

আমি পণ্য কেনার সময় কয়েকটি বিষয় গুরুত্ব দেই। তার মধ্যে অন্যতম- পণ্যের মান। তবে অবশ্যই সাধ্যের বিষয়টি মাথায় রাখতে হয়। অর্থাৎ সাধ্যের মধ্যে সেরাটিই আমার পছন্দ। আমি বিক্রেতাদের কথায় বোঝার চেষ্টা করছিলাম- দেশের আবহাওয়া এবং লোডশেডিংয়ের সঙ্গে মিল রেখে কোনটি বেশি উপযোগী, কোনটি ঝামেলাহীনভাবে নিরবচ্ছিন্ন ব্যবহার করা যাবে, দেখতেও যেন মার্জিত রংয়ের হয়।

আর পণ্য কেনার সময় আমি গুরুত্ব দেই দেশীয় পণ্যকে। যে পণ্য আমাদের দেশের আছে, যেমন দেশের পোশাক বিশ্বখ্যাত। আমি সব সময় দেশীয় পোশাককে গুরুত্ব দেই। আমি দেশীয় লাল চিনি কিনি, বাধ্য না হলে আমদানিকৃত সাদা চিনি কিনি না। আমার শ্রমের টাকায় আমার দেশের একটি ইন্ডাস্ট্রি বিকশিত হোক- এমন একটা বাসনা মনের মধ্যে কাজ করে। জানি না, ৮/১০ বছর আগের সেই সময়ে বাজারে দেশীয় তৈরি কোনো ফ্রিজ ছিল কি না?

ঘুরতে ঘুরতে এমন একটি দোকানে গেলাম, যেখানে হরেক নামের ও ডিজাইনের ফ্রিজের সমাহার। দোকানিকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম- আমি ফ্রিজের বিষয়ে তেমন কিছু বুঝি না। আপনি আমাকে এমন একটি ফ্রিজের কথা বলুন, যেটি মানে ভালো হয়। কয়েকটি দোকান ঘুরে বিভ্রান্ত হওয়ার বিষয়টি তাকে জানালাম।

তিনি সব শুনে বললেন, ‘আমি অনেক দিন বিদেশে থেকেছি, সেখানে মিথ্যা বললে পাপ হয়। এই দেশে মিথ্যা বললে ব্যবসা হয়।’ আমি ভাবলাম- একজন সত্যবাদী ব্যবসায়ীর সন্ধান পেলাম। এবার মনে হয় আমার ফ্রিজ অভিযান সমাপ্ত হলো। পরে তিনি একটি ফ্রিজ দেখিয়ে বললেন, ‘এটি নেন, এটি ইতালি থেকে এসেছে। দামও কমের মধ্যে…।’

আমি ততক্ষণে জেনে গেছি, তখন দেশের বাজারে বাহারি রঙে বিভিন্ন নামে যে সব ফ্রিজ, তার প্রায় সবই চায়না থেকে আমদানিকৃত। শ্যাকলক ব্র্যান্ডের নিউজিল্যান্ডে প্রস্তুতকৃত ফ্রিজ দেশে আসে বটে তবে মাঝারি আকারের একটির দাম লাখ টাকার কাছাকাছি। থাইল্যান্ড এবং দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আমদানি করা দুটি নামি ব্র্যান্ডের ফ্রিজ বাজারে পাওয়া যায়, সেগুলোর দামও বেশ বেশি। এ সব ব্র্যান্ডের ফ্রিজের মান নিয়ে প্রশ্ন নেই। ইতালি থেকে কোনো ফ্রিজ আমদানি হয়, এ কথা তো শুনিনি। আর যদি হয়, দাম এত কম হওয়ার সুযোগ নেই।

সত্যবাদী ব্যবসায়ীর কথা শুনে আমি নিশ্চুপ বসে আছি, ভাবছি কী বলব? তিনি আমাকে চুপ থাকতে দেখে- ফ্রিজটি গুছিয়ে ভ্যানে তুলে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমি ভাবছি- কীভাবে তার কাছ থেকে পরিত্রাণ পাব। আমাকে উঠতে দেখে তিনি  দাম আরো কমানোর প্রস্তাব দিলেন। আমি ‘পরে আসছি’ বলে পালিয়ে বাঁচলাম।

অবশেষে নামি একটি ব্র্যান্ডের শো-রুমে গিয়ে কথার সঙ্গে দামের-মানের মিল পেলাম। তারা বিনয়ের সঙ্গে জানালেন, তাদের ব্র্যান্ড স্যামসাং। তবে তারা সম্প্রতি ইলেক্ট্রা ব্র্যান্ডের ফ্রিজ আমদানি করেন, সেটি প্রস্তুত চীনে… যেটির মানও ভালো… ইত্যাদি।

বছর খানেক আগে আবার ফ্রিজের সন্ধানে বাজারে ঘুরতে হলো। বহু নামিদামি ব্র্যান্ডের ফ্রিজের শো-রুমে ঢু মারলাম। তবে এবার আত্মতৃপ্তির জায়গা পেলাম- দেশীয় ব্র্যান্ডের ফ্রিজে বাজার ভর্তি। চারিদিকে সেই ফ্রিজের শো-রুমই বেশি চোখে পড়ল। ভালো লাগল- আমরা নিজেরাও যে পারি এবং পারব, তার নমুনা দেখতে পেয়ে। আজ আমরা মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে।

দেশে দীর্ঘ সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে জিডিপি বাড়ছে। এক সময়ের ‘তলাবিহীন ঝুঁড়ি’র দেশটি এখন উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। এই দেশে এখন খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকে। গত কয়েক বছর ধরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশের কাছাকাছি। যা বিশ্বের মাত্র কয়েকটি দেশ করতে পেরেছে। অর্খনীতিতে শিল্পখাতের অবদান বাড়ছে।

চীনের যে ক্যান্টন ফেয়ারে দুই শতাধিক দেশ থেকে তিন লাখেরও বেশি ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকেরা আসেন পণ্য কিনতে, সেই মেলায় আমাদের দেশের একটি কোম্পানি ওয়ালটন নিজস্ব পণ্য নিয়ে অংশ নেয়, এটা আমাদের জন্য গর্বের। এবারের ১১৯তম ক্যান্টন ফেয়ারে গিয়ে বড় অংকের রপ্তানি আদেশ পেয়েছে কোম্পানিটি। সত্যিই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

এবার ফ্রিজ কিনতে বিদেশের নামি-দামি কয়েকটি ব্র্যান্ডের শো-রুমে অভিযান চালালাম। তাদের পণ্যের মডেল এবং মান সম্পর্কে বিক্রেতারা নানা ফিরিস্তি দেন। কিন্তু দামটাও ভাবনায় ফেলে। অবশেষে দেশীয় ব্র্যান্ডের একটি ফ্রিজ এবং টেলিভিশন সেই তুলনায় অর্ধেক দামে দীর্ঘ সময়ের কিস্তিতে কিনতে পারলাম। কোম্পানিটি দেশে উৎপাদন করতে পেরেছে বলেই হয়ত সুবিধাজনক দামে এবং কিস্তিতে দিতে পেরেছে। ভাবতে ভালো লাগে- ওই ব্র্যান্ডের ফ্রিজ বিশ্বের যে সব দেশে এখন রপ্তানি হয়, সেই দেশে সেটি বিদেশি ব্র্যান্ডের ফ্রিজ। যে ব্র্যান্ডটি এখন ক্যান্টন ফেয়ারে যায়।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে রপ্তানি আয় ৩৪০০ কোটি ডলার ছাড়ায়, যা আগের বছরের তুলনায় ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ বেশি। ৩৪০০ কোটি ডলারের মধ্যে ২৮০০ কোটি ডলারই আসে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। ডোনাল্ড ট্রাম্পও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পরতে গর্ববোধ করেন। সত্তরের দশকের শুরুতে যখন তৈরি পোশাক রপ্তানি শুরু হয়, তখন ক্ষুদ্র আকারে শুরু হয়েছিল। সে সময় দেশের উদ্যোক্তারা আজকের বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন বলেই আজ দেশ মধ্যম আয়ের।

আজকের শিল্প-সংশ্লিষ্টরা স্বপ্ন দেখছেন বলেই শত শত ইলেকট্রনিক্স পণ্য দেশে উৎপাদন হচ্ছে। হাজার হাজার পরিবারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে এবং হচ্ছে। তাদের সন্তানরা দেশে-বিদেশে লেখাপড়া করে নতুন উৎপাদনকারক হচ্ছেন।

পণ্যের মান সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিযোগিতার বাজারে মানহীন পণ্য তৈরি করে দীর্ঘ সময় কেউ টিকে থাকতে পারে না। ব্র্যান্ডের প্রতি ক্রেতাদের আস্থায় সেটি টিকে থাকে। অপপ্রচারে ভালো মানের পণ্যের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় না, তবে দেশের জন্য আত্মঘাতী হয়।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ মে ২০১৭/বকুল/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়