ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

তাদের বাংলাদেশের খেলা না দেখলেও চলবে

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০৮, ১১ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তাদের বাংলাদেশের খেলা না দেখলেও চলবে

রুহুল আমিন: ক্রিকেটের জন্য উন্মাদনা আমাদের একটু বেশিই বোধহয়। অন্যসব ব্যাপারে দেশের আপামর জনসাধারণের মধ্যে বিভাজন, ভিন্ন মত থাকলেও ক্রিকেটের ক্ষেত্রে সবাই এক।

সবার চাওয়া এক বাংলাদেশ যার সাথেই খেলুক জিততে হবে। জেতা ছাড়া আর কোনো চাওয়া নেই। যদি এই জেতার বাইরে কোনো ফল হয় তবেই বাধে যত ঝামেলা!

ক্রিকেটে উন্মাদনা দোষের কিছু না। তবে স্পোর্টসম্যানশিপ থাকাটা জরুরি। আমার সব সময় মনে হয়েছে স্পোর্টসম্যানশিপের জায়গায় আমরা এখনো ‘নাদান’ রয়ে গেছি। একটা শিশুসুলভ আচরণ আমাদের মধ্যে সব সময় বিরাজ করে। বিশেষ করে বাংলাদেশের যখন খেলা চলে তখন এই ‘নাদান’, শিশুসুলভ চরিত্রগুলো সামনে চলে আসে। খারাপ খেললে মুহূর্তেই অনেক দর্শক বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নেন; গোষ্ঠী উদ্ধার করেন!

সবচেয়ে খারাপ হলো ব্যক্তিগত আক্রমণ। তামিম খারাপ খেললে সে আকরাম খানের ভাতিজা হয়ে যান, মাহমুদউল্লাহ খারাপ খেললে সে হয়ে যান মুশফিকের ভায়রা। সৌম্য খারাপ খেললে আমরা কোনো না কোনো যোগসূত্রতা খুঁজে বের করি। সাব্বিরের ক্ষেত্রেও তাই। ভাল না খেললে গালাগাল করি। বিপরীতে যেই ভাল খেলুক না কেনো তাকে আমরা আকাশে ‍তুলে নাচি। আমি ব্যক্তিগতভাবে দুটো বিষয়কেই অসমর্থন করি। প্রকৃতপক্ষে খেলাধুলার চিরাচরিত নিয়ম সব দিন সমানভাবে কেউ খেলতে পারবে না। তা ক্রিকেটই হোক, আর ফুটবল বা অন্য যেকোনো খেলাই হোক না কেন। সব দিন সমান পারফরম্যান্স করা কোনো খেলোয়াড়ের পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু সচেতনভাবেই হোক আর অসচেতনভাবেই হোক আমরা চাই প্রতিদিনই আমাদের খেলোয়াড়রা ভাল খেলবে! আমরা জিতব, আনন্দ করব, উল্লাস করব প্রতিদিন! এখানেই আমরা স্পোর্টসম্যানশিপের দিক থেকে বাদ পড়ে যাই।

তার জ্বলন্ত প্রমাণ পেতে সদ্য অতীত হওয়া নিউজিল্যান্ড-বাংলাদেশ ম্যাচের দিকে তাকালেই হয়। যখন খেলার শুরুর দিকে চার উইকেট পরে গেল তখন আমরা খেলোয়াড়দের পিন্ডি চটকাতে শুরু করলাম। কেউ কেউ তো ব্যক্তিগত আক্রমণও করতে শুরু করল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এর কিছু নমুনা পাওয়া গিয়েছিল। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো, অনেক শিক্ষিত ও বিচার বিবেচনা সমৃদ্ধ মানুষকেও দেখলাম গালাগাল করে স্ট্যাটাস দিতে। কেউ এই গালাগালের সঙ্গে তাদের ক্রিকেট আবেগের যুক্তিও দেখান। এটা কোনোদিনই মানবো না। আবেগ থাকা ভাল নিশ্চয়, কিন্তু এমন আবেগ কেউ পছন্দ করবেন না নিশ্চয়, যে আবেগ মূল্যবোধ, নীতি নৈতিকতা ও শুভবোধের বর্ডার লাইন ক্রস করে। প্রতিক্রিয়া থাকবে না তা আমি বলছি না। জিতলে যেমন প্রতিক্রিয়া দেখাই আমরা, হারলেও তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাব এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের এই প্রতিক্রিয়া যেন কোনোভাবেই মানবিক মূলবোধের বর্ডার লাইনকে ক্রস না করে।


আমাদের দেশে একটা বাজে প্রাকটিস আছে। তা হলো আমরা ব্যক্তির প্রতিভার চেয়ে তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বেশি টানাটানি করি। কয়েক বছর আগে দেশের বেশকয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে গানের প্রতিযোগিতা হয়েছে। ওই সময় দেখতাম প্রতিযোগীদের ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন কিরকম প্রভাব ফেলেছে দর্শকদের মতামত প্রদানের ক্ষেত্রে। অনেক ভাল এবং প্রতিভাবান শিল্পীও ঝরে গেছে দর্শকদের আবেগের কাছে পরাজিত হয়ে। আমি আবারও বলছি আবেগ থাকা ভাল, কিন্তু যে আবেগ নেতিবাচক ফল বয়ে আনে তা থাকা নিশ্চয় ভাল না।

আমাদের মিডিয়াগুলোও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বর্ডার লাইন ক্রস করে। তাই তো কখনো কখনো মিডিয়াতে আমরা দেখি মাশরাফির শেষ দেখেন কেউ, সাকিবের বিকল্প খোঁজার কথা ফলাও করা প্রচার করে! শতভাগ পেশাদারিত্বের জায়গায় কোথাও যেন অল্প হলেও ঘাটতি আছে আমাদের। মিডিয়া হাইপ তোলে সাময়িক পেনিক তৈরির সুযোগও কেউ কেউ নেন। কিন্তু দিন শেষে সব পরিস্কার হয়ে যায়।

জয়ে আনন্দ করার মধ্যে যেমন গৌরব আছে, তেমনি হেরে গিয়ে তা মেনে নেওয়ার মানসিকতা থাকাও জরুরি। যে প্রকৃত সমর্থক সে জয়ে যেমন ইতিবাচক থাকে তেমনি হেরে গিয়েও পরাজয় মেনে নিয়ে পরেরবার জেতার অপেক্ষায় থাকে। বাংলাদেশকে হারতে দেখলে যাদের মাথা নষ্ট হয়ে যায় তাদের ক্রিকেট খেলা দেখা থেকে দূরে থাকলেই ভাল হয়। তাদের বাংলাদেশের খেলা না দেখলেও চলবে।

আমাদের খেলোয়াড়রাও জানে কেমন তাদের দর্শক, কেমন তাদের দেশের মিডিয়া। তার জ্বলন্ত প্রমাণ চলমান আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালে বাংলাদেশ ওঠার পর দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার বক্তব্য। সেমিফাইনাল নিশ্চিতের পর মাশরাফি বিন মুর্তজা টিম হোটেলে বলেছেন, ‘আমাদেরকে কেউ চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে দিয়েন না। আমাদের দেশে যেটা হয়ে থাকে, অযথা চাপ তৈরি করে ফেলে। আমি আগেও বলে এসেছি আমাদের গ্রুপ থেকে একটি জয় হবে আমাদের আরেকটি মাইলফলক। আমরা একটি ম্যাচ জিতেছি এবং বৃষ্টির সহায়তায় সেমিফাইনাল খেলছি। একটা অনুরোধ আপনারা এতটাও বেশি আবেগকম্পিত হয়ে যাবেন না যে আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাব।’




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ জুন ২০১৭/রুহুল/ইয়াসিন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়