ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

একাত্তরের ঈদ

কাজী জাহিদুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২২, ২৭ জুন ২০১৭   আপডেট: ১১:৫৫, ৪ মে ২০২২
একাত্তরের ঈদ

বাঙালি মুসলমানের সবচেয়ে বড়ো ধর্মীয় উৎসব ঈদ। একাত্তর বাঙালির কাছে শুধু একটি সাল নয়, যেন আপন পরিচয়ে দাঁড়াবার শক্তি। একাত্তরের ডিসেম্বরে ভূমি, পতাকা, জাতীয় সংগীতের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে নিজের শিকড় খুঁজে পাবার আমোদ। একাত্তরে বাঙালির লড়াই নানা পর্যায়ে হয়েছে- কেউ লড়েছেন দেশে, কেউবা দেশের বাইরে। আবার অনেকে অবরুদ্ধ স্বদেশে স্বাধীনতার অপেক্ষায় কাটিয়েছেন নয়টি মাস। এই অগ্নিগর্ভ সময়ে এসেছে ঈদ। একাত্তরের ঈদ নিয়ে পরবর্তীকালে অনেকে স্মৃতিকথায় লিখেছেন, কেউবা দিনলিপিতে লিখে রেখেছেন সে সময়ের ভাষ্য। নিশ্চয়ই তা আনন্দের ঈদ নয়; প্রিয়জনের শোকে সেদিন দু’চোখে নেমেছে অশ্রুর ঢল। স্বাধীনতার প্রতীক্ষায় থাকা প্রতিটি মুখে সেদিন নিরানন্দের সুস্পষ্ট ছাপ। শোক, ক্রোধ আর নতুন ভোরের প্রত্যাশায় একাত্তরের ঈদের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এই গ্রন্থনা-গদ্যে। গ্রন্থনা করেছেন কাজী জাহিদুল হক।

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শব্দ সৈনিক সাংবাদিক কামাল লোহানী স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু বিপ্লবী বেতারে কি আর বসে থাকা যায়? যখন যাকে যে দায়িত্ব দেয়া হবে তখন তা পালন করতেই হবে। তিনি সংবাদ বিভাগ গড়ে তোলার পাশাপাশি সংবাদ পাঠ, কথিকা লেখা ও প্রচার, ঘোষণা, সম্মিলিত গানে কণ্ঠ দেয়া ইত্যাদি কাজ করেছেন। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, বিজয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে স্বাধীন বাংলা বেতারে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের প্রথম বার্তাটি লিখেছিলেন তিনি। বিশ্ববাসীর কাছে সেই বার্তা পৌঁছেছিল কামাল লোহানীর উচ্চারণে। কামাল লোহানী এক নিবন্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ঈদ আয়োজন সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেছেন :

‘‘একাত্তরে তখন চলছে মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আর অবরুদ্ধ বাংলায় ভীতসন্ত্রস্ত বাঙালির ঘরে এসেছে ঈদের বার্তা। কিন্তু কি করে পড়বো ঈদের জামাত? আমরা দেশমাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে লড়াই করছি রণাঙ্গনে। মাথায় টুপির বদলে হেলমেট, নয়তো গামছা বাঁধা। সারাক্ষণ ব্যস্ত শত্রুর মোকাবিলায়, সময় কোথায় ঈদ করার? তাইতো ক্ষুদ্ধ শব্দ সৈনিক শহীদুল ইসলাম ঈদের চাঁদকে ফিরে যেতে বললেন। তিনি লিখলেন-

‘চাঁদ তুমি ফিরে যাও ফিরে যাও,

দেখো, মানুষের খুনে খুনে রক্তিম বাংলা,

রূপসী আঁচল কোথায় রাখবো বলো?’

প্রখ্যাত গণসঙ্গীতশিল্পী সুরকার অজিত রায় সুর সংযোজন করলেন এ গানে। কোরাসে গাই রূপমালা আরো অনেকে। ঈদের দুদিন আগেই রেকর্ড করলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কিন্তু ঠিক হলো চাঁদ উঠলে এই গানটি প্রচারিত হবে। হলোও তাই। উঠলো ঈদের চাঁদ আকাশে। স্বাধীন বাংলা বেতারে গেয়ে উঠলো সমবেত কণ্ঠে সেই অজিত বিক্রমের গান- চাঁদ তুমি ফিরে যাও ফিরে যাও।’’

আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জানতে পারি পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতির উদ্দেশ্যে বাণী প্রদান করেন। যা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারের পাশাপাশি জয়বাংলা পত্রিকার ১ম বর্ষ ২৯ সংখ্যায় ২৬ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখে প্রকাশিত হয়। তাঁর বাণী ছিল :

‘পবিত্র রমজান মাসেও হানাদার বাহিনীর বর্বরতায় বাংলাদেশের মুসলমান, হিন্দু নির্বিশেষে অসংখ্য নরনারী নিহত হচ্ছে। গত বছর আমরা বারোই নভেম্বর প্রলয়ঙ্করী ঝড়ে নিহত দশ লাখ মানুষের শোকে মুহ্যমান অবস্থায় ঈদ উৎসব পালন করতে পারিনি। এবারও আমরা ইয়াহিয়ার সৈন্যদের বর্বরতায় নিহত দশ লাখ ভাই-বোনের বিয়োগ বেদনা বুকে নিয়ে ঈদের জামাতে সামিল হয়েছি। কিন্তু দুঃখ-কষ্ট যাই হোক, এবার ত্যাগের মন্ত্রে আমরা উদ্বুদ্ধ এবং যে কোনো ত্যাগের মূল্যে স্বাধীনতার ঘোষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে বদ্ধ পরিকর। দেশকে শত্রু কবল মুক্ত করার পরই মাত্র ঈদুল ফতেহ্ বা বিজয়ের ঈদ উৎসব পালন করবো এবং সেদিন যে খুব দূরে নয়, এই  প্রতিশ্রুতি আমি আপনাদের দিতে পারি।’

লেখক ফজলুল বারী তাঁর ‘একাত্তরের আগরতলা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন:

‘২০শে নভেম্বর আগরতলা মসজিদে ঈদের জামাতে অংশগ্রহণ করেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা আগামী ঈদ করব বাংলাদেশে।’

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঈদ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে এক বাণী প্রদান করেন। জয়বাংলা পত্রিকার ১ম বর্ষ ২৮ সংখ্যায় ১৯ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখে ‘এই ঈদে আমাদের প্রার্থনা হোক ...’ শিরোনামে প্রধানমন্ত্রীর বাণী প্রকাশিত হয়। তিনি জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ঈদ বাণীতে বলেন :

‘আমাদের দেশে এবারে ঈদ এসেছে অত্যন্ত মর্মান্তিক পরিবেশে। দখলীকৃত এলাকায় শত্রু সৈন্যের তাণ্ডব চলছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ  স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে বিচ্যুত হয়ে শরণার্থী হয়েছেন, মুক্ত এলাকায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি চলছে শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য, রক্তের বিনিময়ে মানুষ মাতৃভূমির  স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম করছে। এবার ঈদে আনন্দ মুছে গেছে আমাদের জীবন থেকে, আছে শুধু স্বজন-হারানোর শোক, দুর্জয় সংগ্রামের প্রতিজ্ঞা ও  আত্মত্যাগের প্রবল সংকল্প।

গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং আমার নিজের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে জনসাধারণকে ঈদ উপলক্ষে আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। ঈদের যে আনন্দ আজ আমরা হারিয়েছি, তা আমাদের জীবনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে সেই দিন, যেদিন আমরা দেশকে সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত করব। আমি আপনাদের আশ্বাস দিচ্ছি যে, যথাসর্বস্ব পণ করে যে স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা লিপ্ত, তার চূড়ান্ত সাফল্যের দিনটি নিকটতর হয়ে এসেছে। সেই মুহূর্তটিকে এগিয়ে আনার সংগ্রামে আমরা সকলে যেন নিঃস্বার্থভাবে নিজেদের নিয়োগ করতে পারি, এই ঈদে তাই হোক আমাদের প্রার্থনা।’

মতিউর রহমান সম্পাদিত ‘ইতিহাসের সত্য সন্ধানে: বিশিষ্ট  ব্যক্তিদের মুখোমুখি’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বাসায় ঈদের দিনটি কিভাবে কেটেছে। বেগম জোহরা তাজউদ্দীন জানাচ্ছেন- ‘ঈদের দিন ঈদ করিনি। বাসায় শুধু শাকসবজি রান্না করেছি। বিদেশের মাটিতে কী ঈদ! আমার ছিল এই চিন্তা। অনেকে বলেছে, এটা আমার ঢঙ। তাতে আমি কিছু মনে করিনি। তাজউদ্দীন ঈদ করেছে রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে।’

একাত্তরে ঈদ উদযাপন নিয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর ‘আমার একাত্তর’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন :

‘‘ঈদের কদিন আগে তাজউদ্দীন আমাকে ডেকে পাঠালেন। স্বভাবতই বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা হলো। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বিদেশ-সফরের গুরত্ব সম্পর্কে তিনি কিছুটা ধারণা দিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, বঙ্গবন্ধুর বিচারের ফল যাই হোক, বিশ্বজনমতের কারণেই, পাকিস্তানিরা তাঁকে হত্যা করতে পারবে না। মুক্তিযুদ্ধ যে চূড়ান্ত লক্ষের দিকে অগ্রসর হচ্ছে সে-বিষয়ে তাঁর সন্দেহ ছিল না।

কথাবার্তার শেষে উঠে গিয়ে ঘরের মধ্যে রাখা আয়রন সেফ থেকে একটা খাম বের করে তিনি আমার হাতে দিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম: ‘কী এটা?’ তিনি বললেন ‘সামনে ঈদ, তাই।’ খামে পাঁচশ টাকা ছিল- তখন আমার এক মাসের মাইনের সমান। আমি নিতে চাইলাম না। তিনি বললেন: ‘ঈদে  আপনার বাচ্চাদের তো আমি উপহার দিতে পারি, নাকি।’ কথাটা বলতে গিয়ে তিনি নিজেই ভাবাবেগপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন, আমিও খুব অভিভূত হয়ে কিছু আর বলতে পারিনি।’’

বাঙালির মুক্তির লড়াইয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষ একটি চেতনায় সম্মিলিত হয়েছিল; সেটি হলো পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্তি। এটা সূর্যের ন্যায় সত্য যে, পাকিস্তানীদের বাঙালি দোসর ছাড়া আর সবাই অবরুদ্ধ দেশে কাটিয়েছে ভয়াবহ সময়। মানুষ সুযোগ পেলেই পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিয়েছে জীবন বাঁচাতে। তাঁদের চোখে স্বপ্ন ছিল একদিন তারা ফিরে আসবেন লাল সবুজের এই বাংলায়। তারপর মাথা উঁচু করে গাইবেন- ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বেগম মুশতারী শফির স্বামী ডা. মোহাম্মদ শফি এবং বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছোট ভাই এহসান শহীদ হন। এই পরিবার চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্বামী ও ভাইকে হারিয়ে বেগম মুশতারী শফী বাধ্য হন শিশু সন্তানদের নিয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে। বেগম শফী তাঁর ‘স্বাধীনতা আমার রক্ত ঝরা দিন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন:

‘‘ছোট বেলা থেকেই জীবনের ছোট-বড় সব ধরনের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনার কথাগুলো খাতার পাতায় তারিখ দিয়ে দিয়ে লিখে রাখবার যে অভ্যাস গড়ে উঠেছিল, সেই অভ্যাস আমার আজও অব্যাহত রয়েছে। তাই বোধ করি ১৯৭১ সালে দেশের মুক্তিযুদ্ধের দিনে স্বামীহারা, ভাইহারা হয়ে ঘর থেকে শত্রুভয়ে পালাবার সময় অন্য কিছু নিতে না পারলেও প্রিয় ডাইরিটা হাতে তুলে নিতে ভুল হয়নি আমার। ১৯৭১ সালটি ছিল আমাদের জাতীয় জীবনে এবং ব্যক্তিজীবনেও একটি ঝড়ো বছর। এই বছরের প্রতিটি দিনের কথা- যা আমার জীবনে ঘটেছে, যা করেছি, যা দেখেছি চোখে, আর যা শুনেছি এবং আমার তাৎক্ষণিক অনুভূতি উপলব্ধির উদ্ভাস যখন যেভাবেই হয়েছে- পথ চলতে চলতে তার সবটুকু লিখে রেখেছিলাম আমার ডাইরির পাতায়।’’

বেগম মুশতারী শফী তাঁর গ্রন্থে ঈদ সম্পর্কে লিখেছেন :

‘‘১৯ নভেম্বর (প্রকৃত পক্ষে হবে ২০ নভেম্বর)। আজ ঈদ। দেশ স্বাধীন হলে আমরা ঈদ করবো। এক মাস কঠোর কৃচ্ছসাধনার পর আসে এই আনন্দময় দিন পবিত্র ঈদ। মনটা বিষণ্নতায় আজ ছেয়ে গেছে। আগের দিন বাচ্চাদের কাপড় চোপড়গুলো সাবান দিয়ে কেচে লন্ড্রি থেকে ইস্ত্রি করে রেখেছিলাম। মুসলমান পাড়া, তাই ঈদের আমেজটা পরিপূর্ণভাবে অনুভব করছি, ছেলেরা সবাই নতুন জামা কাপড় পরে টুপি মাথায় দিয়ে নামাজ পড়তে যাচ্ছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা রঙ বেরঙের নতুন জামা জুতো পরে, রঙিন ফিতায় চুল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বউরাও নতুন শাড়ি, অবাঙালি বউরা নতুন শিলওয়ার কামিজ পরে এ বাড়ী ও বাড়ী বেড়াচ্ছে, আশে পাশের ঘর থেকে পোলাও কোর্মা, জর্দা, ফিরনীর খোশবু আসছে। আমার বাচ্চারা মুখ মলিন করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। এমন ঈদ তো ওদের জীবনে কখনো আসেনি! আমার পাশের ঘরের খৃষ্টান ছেলে মেয়ে জাফরী, ননাট, ললী এলো। ওদের বললো, ‘তোমরা আজ নতুন কাপড় পরোনি? তোমরা ঈদ করবে না?

ওদের প্রশ্ন শুনে আমার বুকের ভিতরটা যেন কেমন করে উঠলো, কি উত্তর দেবে আমার বাচ্চারা? আমি কান পেতে রইলাম। শুনলাম আমার বড় ছেলে এরাদ বলছে, ‘না ললী, আমরা ঈদ করবো না।’ ওরা প্রশ্ন করছে, কেন?

এরাদ বলছে, ‘আমার কাকু বলেছে, দেশে যখন যুদ্ধ চলে, তখন কোনো ঈদ করতে হয় না। এখন আমাদের সাথে আব্বু নেই, মামা নেই, ওদের মিলিটারীরা নিয়ে গেছে। আমরা যুদ্ধ করে পাকিস্তানি আর্মিদের হারিয়ে দেব, আর আমাদের দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে, আমরা দেশে ফিরে আব্বুকে পাবো, মামাকে পাবো, তখন আমরা ঈদ করবো।’ ওদের কথা শুনে কান্না সংবরণ করতে পারলাম না। আঁচলে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললাম। হে খোদা, তুমি আমার বাচ্চাদের ইচ্ছা পূরণ করে দাও। তুমি তো অলৌকিক কত কিছু দেখালে, আরেকটু দেখাও, সত্যিই যেন ওদের আমরা ফিরে পাই।

না, মুরগী এনে পোলাও, কোর্মা রাঁধার সাধ্য আমার নেই। তবে বেলাল ভাই সেমাই কিনে এনেছিল কাল; আজ মিনু আপাও চোখ মুছতে মুছতে সেটাই রান্না করে বাচ্চাদের সকালে খাইয়েছে। অনেক দিন পর আজ যেন আবার একটু বেশী রকম মুষড়ে পড়ছি, কামনা করছি বার বার এই দিনটার দ্রুত অবসান।

সকাল দশটায় ওরা দুই ভাই মানু আর পিকু এসে হাজির। আমাকে সালাম করে বললো, ‘ছোট মা, আজ আমরা সারা দিনের প্রোগ্রাম নিয়ে এসেছি।’ ভয়ে ভয়ে বললাম, কি রকম? ওরা বললো, ‘আজ ভাইবোনদের নিয়ে আমরা সারাদিন বেড়াবো।’ বেড়ানোর কথায় বাচ্চারা আনন্দে লাফিয়ে উঠলো, ‘দাদা আমরা কোথায় বেড়াবো আজ?’ মানু বললো, ‘আজ তোমাদের আলীপুর চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাব। তারপর যাদুঘর, তারপর প্ল্যানোটোরিয়াম, তারপর রবীন্দ্র সরণীতে আজ একটা চমৎকার ফাংশন আছে সেটা দেখে রাতে ফিরবো।’

মিনু আপা বললেন, ‘সর্বনাশ এই সাতজনকে নিয়ে সারাদিন তোমরা সামাল দিতে পারবা?’ পিকু বললো, ‘কেন পারবো না? আমরা দুই ভাই আছি না?’ ওরা জামাকাপড় পরেই ছিলো। এখন জুতো মোজা পরে রেডি। বললো, দাদা চলো। মিনু আপা ধমক দিলেন, ‘থাম তোর দাদাদের কিছু খেতে দিবি না?’ বলেই সেমাই এনে দিলেন। ওরা দুই ভাই খুব তৃপ্তি করে খেলো। পিকু বললো, ‘বাহ্, এমন চমৎকার রান্নাতো কখনো খাইনি।’
মিনু আপা বললেন, ‘বাবা শরণার্থী জীবনে কি আর ভালো করে রান্না করা সম্ভব? ঘি, গরম মশলা নেই। এতো কেবল বাচ্চাদের বোঝানো।’
মানু পিকু সবগুলো বাচ্চাকে নিয়ে চলে গেলো। যাবার সময় বাচ্চাদের আনন্দ দেখে মনে হলো, আজ ঈদ যেন মানু পিকুই নিয়ে এসেছে আমাদের ঘরে। আমার বুকের ভিতরে চেপে থাকা কষ্টের ভারটা যেন অনেকখানি নেমে গেল। মিনু আপা কান্নারুদ্ধ স্বরে বললেন, হে খোদা, তুমি ওদের দুই ভাইয়ের কল্যাণ করো।’’

অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ তাঁর ‘যখন পলাতক: মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ গ্রন্থে  লিখেছেন:

‘সেবার ঈদ হয়েছিলো ২০শে নভেম্বর। ঈদ উপলক্ষে আমাদের বাড়িতে অথবা অন্য যাঁদের জানতাম, তাঁদের বাড়িতে কোনো সমারোহ অথবা সাধারণ উৎসবও হয়নি। তবে তারই মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একটি বেতার ভাষণ দিয়েছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন যে, স্বদেশে গিয়ে আপনজনদের সঙ্গে আনন্দ করার দিন আর বেশি দূরে নয়।’

মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতে শরণার্থী ক্যাম্পের স্মৃতি গ্রন্থে মো. মিজানুর রহমান লিখেছেন: ‘ভারতে অবস্থানকালীন সময়ে একটি ঈদই পেয়েছিলাম, তা হচ্ছে রোজার ঈদ। সেদিন আমরা সবাই স্থানীয় পঞ্চায়েতের অনুমতি নিয়ে কলাগাছিয়া বাজার সংলগ্ন স্কুল মাঠে ঈদের নামাজ পড়েছি। আমাদের গ্রামের এক বিশিষ্ট আলেম মৌলভী সায়েব আলী খান নামাজে ইমামতি করেছেন। এর পূর্বে ক্যাম্পে কোনো দিন জুমার নামাজ বা জামায়াতে নামাজ পড়ার কোন সুযোগ ছিল না। বিরাট জামাআত হয়েছিল। ঈদের এ নামাজে কয়েকটি ক্যাম্প হতে কয়েক হাজার মুসলমান পুরুষ ও ছেলেরা যোগদান করে। তখন বিশেষ মোনাজাত করা হয়েছিল আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য, মুক্তিযোদ্ধাদের মঙ্গল ও শীঘ্রই দেশ স্বাধীন হওয়ার জন্য। পাক বাহিনীর নির্যাতনের হাত হতে আমাদের দেশের জনগণকে রক্ষা করার জন্যও আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করা হয়।’

মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) হাফিজ উদ্দিন আহমদ, বীর বিক্রম ছিলেন ক্রীড়া জগতের মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ সমাপনান্তে অনেকটা যেন খেলাচ্ছলেই যোগ দিয়েছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলের সদস্য হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন দেশ-বিদেশ, আর নিমগ্ন ছিলেন সেনাদলের জনবিচ্ছিন্ন নিয়মনিষ্ঠ জীবনে। রাজনীতির অভিঘাত থেকে অনেক দূরের এই যুবক অকস্মাৎ কীভাবে বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন মুক্তিযুদ্ধের একেবারে সূচনা লগ্নে, পক্ষত্যাগ করে যোগ দিলেন জনতার কাতারে, তার আন্তরিক ও বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে ‘রক্তেভেজা একাত্তর’ গ্রন্থে। বিধৃত হয়েছে যুদ্ধের নয় মাসের ধারাবাহিক কাহিনী, যেখানে অনুপমভাবে ফুটে উঠেছে বাঙালির মহত্তম সংগ্রামের বাস্তবতা, রয়েছে যুদ্ধের সঙ্গে সাধারণজনের সম্পৃক্ততা ও তাঁদের অসাধারণ বীরত্বের নানা ঘটনাসহ যুদ্ধদিনের জীবনযাপনের বিভিন্ন ঘটনা। মেজর হাফিজ তাঁর গ্রন্থে ঈদ সম্পর্কে লিখেছেন :

‘ওই রাতেই জানলাম আগামীকাল ঈদুল ফিতর। ঈদের দিন সকালে সীমান্ত এলাকায় টিলার ওপর সারিবদ্ধভাবে ঈদের জামাতে দাঁড়ালাম আমরা অর্থাৎ পুরো ব্যাটেলিয়ন। ঈদগাহ বলতে চারদিকে জঙ্গলবেষ্টিত একটা অসমতল মাঠ। ঈদের পোশাকের পরিবর্তে পরনে ইউনিফরম্, পাশে শুইয়ে রাখা অস্ত্র স্টেন, রাইফেল ইত্যাদি। নামাজরত অবস্থায় নীরবে অশ্রুবর্ষণ করছিল সবাই, মোনাজাতের পর কোলাকুলির সময় শুরু হলো সশব্দ ক্রন্দন। পিতা-মাতা, স্ত্রী-পুত্র, পরিবার-পরিজনের কথা সবার মনে পড়ছে আজ। ফেলে আসা দিনগুলোতে পারিবারিক পরিবেশে উদ্যাপিত ঈদের স্মৃতি মনে যেগে ওঠার কারণে এদিন কেউ অশ্রু সংবরণ করতে পারেনি। আমরা কোথায়, পরিবার কোথায়, কেউ জানে না। বিপদসঙ্কুল বর্তমান আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সবাই বিহ্বল হয়ে পড়ি। যুদ্ধক্ষেত্রে মারণাস্ত্রের ছোবলের মুখে যারা নিঃশঙ্ক নির্বিকার, সেই অসম সাহসী যোদ্ধারা শিশুর মতো কাঁদছে! জাতি কি এদের কথা মনে রাখবে? স্বাধীন দেশ নাকি জীবিত গেরিলা চায় না।

আমরা একে অন্যকে সান্ত্বনা দিলাম। অশ্রুসিক্ত চোখে অপরকে বলছি, কাঁদার কি আছে? কি মুশকিল, কাঁদছিস কেন?
সুবেদার ফয়েজ এসে বললো, ‘স্যার, দুই দিনের ছুটি চাই। বউ আর ছোট ছেলেটাকে বেলোনিয়াতে রেখে এসেছি অনেকদিন হলো। একটু দেখে আসি, যাবো আর আসবো।’ বললা, ‘ঠিক আছে, যাও তুমি’। কৃতজ্ঞতার হাসি উপহার দিয়ে, চোখ মুছে বিদায় নিলো ফয়েজ।’

মাহবুব আলম, দিনাজপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক গেরিলা কমান্ডার। তাঁর লেখা ‘গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে’ গ্রন্থে প্রতিদিনের যুদ্ধকথার ভেতর দিয়ে একাত্তরের দিনগুলো আমাদের সামনে চিত্রিত হয়। মাহবুব আলম একাত্তরের ঈদের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে :

‘ঈদ এসে গেলো। ছেলেরা ঈদ উৎসব পালনের জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠেছে। একটা গুজব ছড়িয়ে পড়েছে এরকমের যে, ঈদের দিন পাক আর্মি ব্যাপকভাবে হামলা করবে সীমান্ত এলাকাগুলো জুড়ে। গুজবটা যেভাবেই ছড়াক, যথেষ্ট বিচলিত করে তোলে আমাদের। মুক্তিযোদ্ধারা যখন ঈদের নামাজের জন্য জামাতে দাঁড়াবে ঠিক সে সময়ই নাকি করা হবে এই হামলা। যুদ্ধের মাঠে শত্রুবাহিনীর সম্ভাব্য কোনো তৎপরতাকেই অবিশ্বাস করা যায় না। ঈদের দিন মুক্তিবাহিনীর দল যখন ঈদ উৎসবে মেতে থাকবে, তারা নামাজ পড়তে দলবদ্ধভাবে কোথাও সমবেত হবে, তখুনি সুযোগ বুঝে তারা হামলে পড়বে অপ্রস্তুত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর। খবর যখন রটেছে, এ ধরনের হামলা তখন পাকবাহিনীর তরফ থেকে হওয়াটা বিচিত্র কিছু নয়। তাই খুব স্বাভাবিক কারণেই পাকবাহিনীর তরফ থেকে এ ধরনের সম্ভাব্য হামলাকে সামনে রেখে আমরা ঈদুল ফিতর উৎসব উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নিই। ঈদ মুসলমানদের জন্য প্রধান উৎসবের দিন। জন্ম থেকেই সবাই এই উৎসব পালনের জন্য মেতে উঠেছে। ঈদের নামাজ পড়া হবে না, ঈদের উৎসব হবে না, ভালো খাওয়া-দাওয়া হবে, ঈদের দিন সবাই হাতিয়ার হাতে শত্রুর অপেক্ষায় ওঁত পেতে বসে থাকবে, এরকম একটা কিছু কেউই যেনো মন থেকে মেনে নিতে পারবে না।

...সিদ্ধান্ত হয় ঈদের আগের দিন সবগুলো দল দু’ভাগে ভাগ হবে এবং সমবেত হবে দু’জায়গায়। নালাগঞ্জ আর গুয়াবাড়িতে। ছেলেরা তাদের নিজেদের মতো করেই ঈদ উৎসব পালন করবে। তবে নামাজ পড়বে একেবারে সীমান্তের ধার ঘেঁষে। গুয়াবাড়িতে সমবেত ছেলেরা ভারতীয় সীমান্তে উঁচু গড়ের পাদদেশে গিয়ে জামাত পড়বে। নালাগঞ্জে জামাত হবে আমগাছ তলায় পুকুরের পাড়ে।

মুসলমান ছেলেরা যখন ঈদের জামাতে দাঁড়াবে, তখন হিন্দু ছেলেরা কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে হাতিয়ার হাতে সতর্ক প্রহরায় থাকবে। হিন্দু সহযোদ্ধাদের দেয়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে মুসলমান ছেলেরা নামাজ পড়বে। এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হয় গুয়াবাড়িতে একরামুলের কাছে। সোনারবানে বকর ও শামসুদ্দিনের কাছে। নালাগঞ্জে মুসা আর চৌধুরীও সেভাবেই তৈরি হয়। হিন্দু ছেলেরা তাদের মুসলমান ভাইদের নামাজের সময় পাহারা দেবার দায়িত্ব পেয়ে যারপরনাই খুশি হয়ে ওঠে। ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে এই যুদ্ধের মাঠে জীবনমরণের মাঝখানেই সবার বসবাস। এক ধর্মের মানুষ ধর্মীয় আচরণ পালন করবে, আর তাদের নিরাপদ রাখার জন্য ভিন্ন ধর্মের মানুষ হাতিয়ার হাতে পাহারা দেবে, আমার কাছে এ অভাবনীয় আর মহান মানবিক ঘটনা বলে মনে হয়। হিন্দু ছেলেদের সংখ্যা বেশি না হলেও ঈদের জামাতের সময় তাদের স্বল্পসংখ্যক সদস্য দিয়েই তারা তাদের মুসলমান ভাইদের কিভাবে নিরাপত্তা বিধান করবে, তার পরিকল্পনায় মেতে ওঠে। ঈদের বড়ো আয়োজনের আহারাদির বাজেট নিয়ে বসে মিনহাজ। সকালে রান্না হবে শেমাই। দুপুরে কোর্মা-পোলাও ইত্যাদি। আর সে অনুসারেই হিসেব-নিকেশ করে লম্বা একটা ফর্দ তৈরি করে ফেলে সে। হিন্দু ছেলেরা রয়েছে, সেহেতু গরু চলবে না। গ্রামের বন্ধুরা তাদের শুভেচ্ছাস্বরূপ পাঠিয়ে দেয় ৪টা খাসি। এরমধ্যে দুটো পাঠিয়ে দেয়া হয় গুয়াবাড়িতে সেখানকার ছেলেদের জন্য।

...ঈদের দিনের সকাল। উৎসবমুখর পরিবেশ। সবাই আনন্দে উচ্ছল। পাশাপাশি চরম উত্তেজনা পাকবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ হতে পারে। ভরতের নেতৃত্বে ৮/১০ জন হিন্দু ছেলে এগিয়ে খালের পাড়ে গিয়ে অবস্থান নেয়। সকাল ন’টায় ঈদের জামাত শুরু হয় পুকুর পাড়ে। আমি নিজে দাঁড়াতে এবং লাঠি ধরে চলাফেরা করতে পারলেও নামাজ পড়তে পারি না। ওরা সবাই ঈদগাহের মতো জায়গায় পরম পবিত্র মনে নামাজে দাঁড়ায়। আমিও লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি জামাতের কাছাকাছি অবস্থানে। যা হোক, যুদ্ধের মাঠেও তাহলে আমরা নামাজ পড়তে পারছি। গভীর এক প্রশান্তিতে ভরে ওঠে মন। সতৃষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে আমি তাকিয়ে থাকি ঈদের জামাতের দিকে। না, শত্রুর হামলা হয় না। তাই হৈ-চৈ করে, উৎসবের খাওয়া-দাওয়া নিয়ে আনন্দে আনন্দে গড়িয়ে যায় দিনটি।’

শহিদ জননী জাহানারা ইমাম একাত্তরে অবরুদ্ধ ঢাকা শহরে থেকে দেখেছেন শহরের অবস্থা। তাঁর ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে ১৯ নভেম্বর ৭১ তারিখে অর্থাৎ ঈদের আগের দিনের বর্ণনা পাই। তিনি লিখেছেন:

‘রুমীর এনলার্জ করা ফটোটা দোকান থেকে এনেছি। বেশি বড় করি নি, মাত্র আট বাই দশ। ঐ মাপের একটা ফটোস্ট্যান্ডও কিনে এনেছি। ফটোটা স্ট্যান্ডে লাগিয়ে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলাম। কতোদিন দেখি নি ওই প্রিয় মুখ। ... রুমী, তোমাকে আসতেই হবে আবার ফিরে।
চোখ মুছে ছবিটার নিচে একটুকরো কাগজে বড় বড় অক্ষরে লিখলাম: আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়। ফটোটা রাখলাম নিচতলায় বসার ঘরের কোণার টেবিলে। আগামীকাল ঈদ। অনেক মানুষ আসবে ঈদ মিলতে। তারা সবাই এসে দেখবে রুমী কেমন করে কোমরে হাত দিয়ে দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে সদর্পে ঘোষণা করছে- আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়।’

২০শে নভেম্বর লিখেছেন:

‘আজ ঈদ। ঈদের কোন আয়োজন নেই আমাদের বাসায়। কারো জামাকাপড় কেনা হয় নি। দরজা-জানালার পর্দা কাচা হয় নি, ঘরের ঝুল ঝাড়া হয় নি। বসার ঘরের টেবিলে রাখা হয় নি আতরদান। শরীফ, জামী ঈদের নামাজও পড়তে যায় নি। কিন্তু আমি ভোরে উঠে ঈদের সেমাই, জর্দা রেঁধেছি। যদি রুমীর সহযোদ্ধা কেউ আজ আসে এ বাড়িতে? বাবা-মা-ভাই-বোন, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কোন গেরিলা যদি রাতের অন্ধকারে আসে এ বাড়িতে? তাঁদেরকে খাওয়ানোর জন্য আমি রেঁধেছি পোলাও, কোর্মা, কোপ্তা, কাবাব। তাঁরা কেউ এলে আমি চুপিচুপি নিজের হাতে বেড়ে খাওয়াবো। তাঁদের জামায় লাগিয়ে দেবার জন্য একশিশি আতরও আমি কিনে লুকিয়ে রেখেছি।’

সাহিত্যিক আবু জাফর শামসুদ্দীনও একাত্তরে ঈদের সময় ঢাকা শহরে ছিলেন। তিনি তাঁর ‘আত্মস্মৃতি’ গ্রন্থে ১৬.১১.৭১ ও ২৩.১১.৭১ তারিখে ঈদ প্রসঙ্গে লিখেছেন। তিনি ১৬.১১.৭১ তারিখে লিখেছেন:

‘শুনলাম, ঈদের বড় বড় জামাতে সেনাবাহিনী নিযুক্ত লোকরাই বোমা মারবে। উদ্দেশ্য, মুক্তিবাহিনীকে নিশ্চিহ্ন  করা। কি চমৎকার বুদ্ধি! মানুষও ওয়ার্নিং পেয়ে গেছে। বোরকা ছাড়া কেউ ঈদের বড় জামাতে যাবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া জুমা ও ঈদের নামাজ পড়া এখন এ দেশে জায়েজও নয়।’

২৩.১১.৭১ তারিখে লিখেছেন:

‘ঈদের দিন শনিবার। যুদ্ধকালে কোনো জামাত জায়েজ নয়। নামাজে যাই নি। কনিষ্ঠ পুত্র কায়েসকে সঙ্গে নিয়ে সকাল নয়টায় সিদ্দিক বাজারের উদ্দেশ্যে বেরুলাম। রিকশায় চড়ে দেখি সড়ক জনমানবশূন্য। টেলিভিশন অফিসের (ডি.আই.টি বিল্ডিং) সমুখে যেতে রিকশা ফিরিয়ে দিল। ট্রাকে ট্রাকে টহল ও পাহারায়ও মিলিটারি। স্টেডিয়ামে আবদুর রহমান বেখোদের ইমামতিতে অনুষ্ঠিত জামাতে বোধ করি ৫/৭ শত লোক হয়েছিল- অধিকাংশ বিহারি। ওরা দু’চারজন করে ঘরে ফিরে যাচ্ছিল।

ঘুরে সেক্রেটারিয়েটের কোণ হয়ে জিন্নাহ এভেন্যুও (বঙ্গবন্ধু এভিন্যু) পেছন দিয়ে গুলিস্তান সিনেমার পাশ দিয়ে পুনরায় জিন্নাহ এভেন্যুতে পড়ে কোনোক্রমে সিদ্দিক বাজারে মোজো ছেলের শ্বশুর কাজী হাবিবুল্লাহ সাহেবের বাসায় যাওয়ার সময় দেখলাম বায়তুল মোকাররম মসজিদে মেলেটারি পাহারায় ঈদের জামাত হচ্ছে। এ মসজিদেও বোধ করি হাজারখানেক লোকের বেশি হয়নি। সিদ্দিক বাজার হতে ফেরত আসার সময়ও দেখলাম, সড়ক তেমনি জনমানবশূন্য। ক্বচিৎ দু’একটি মোটর গাড়ি দেখা যায়। দুঃসাহসী ব্যক্তিরা বোধ করি ঈদের মোলাকাত করতে যাচ্ছে আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে। বেলা তিনটা পর্যন্ত শহর এমনি জনশূন্য ছিল। ২৭ মার্চ শহর যে-রকম জনশূন্য ছিল আজকের অবস্থাও তাই। তিনটার পর কিছু কিছু লোক সড়কে বেরোয়। ... আসলে শহরের অর্ধেক লোক নামাজে যায়নি। বাকিরা মসজিদে বা পাড়ায় পড়েছে। বহু বাড়িতে সাধারণ ভাত-সালুন পাক হয়। বহু বাড়িতে সেমাই কেনা হয়নি। আমি নিজে ছেলেমেয়েদের জন্যে নতুন জামাকাপড় ক্রয় করিনি। নাতি-নানিরা আছে। ওদের জন্য দেশি চালের সেমাই এবং কিছু গোশত পাক করা হয়েছিল। আমার জীবনেই প্রথম ঈদের জামাতে শরিক হইনি।’

কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনও সন্তানদের নিয়ে ঢাকাতেই ছিলেন। তিনি তাঁর ‘একাত্তরের নয় মাস’ গ্রন্থে লিখেছেন:

‘‘একটি একটি রোজা পার হয়ে ঈদুল ফিতর এগিয়ে আসছে। আর আরবারের মতো কোনও প্রোগ্রামই ছিলো না। গুলিস্তানের পেছনে সেই যে দেশী  সামগ্রীর ‘বাংলা মার্কেট’ সবাই কিছু না কিছু কেনাকাটা করছিলো ঈদ উপলক্ষে সেখান থেকে। নতুন করে রটছিলো এর পত্তনীর কথা। প্রথমে চার যুবক নাকি চট বিছিয়ে ধারে বিক্রি করছিলো দেশী কাপড়। দেখাদেখি বেকার যুবকরা বসে গেছিলো। শুরুর সেই চার যুবক আর কেউ নয়, ঝানু চার মুক্তিযোদ্ধা। এই যোদ্ধারা জনগণের ভেতর মিশে গেছে। রিকশাওয়ালার ছদ্ম পরিচয়ে রিকশা চালাচ্ছে।
এই মার্কেটের দিন ঈদের আগে বেশ জমজমাট। কেনাকাটা করে দাঁড়িয়েছি বায়তুল মোকাররমের এক ওষুধের দোকানের সামনে সাগর আর আমি। ওষুধ নেব।
শুক্রবার চাঁদ উঠেছে ঈদের। বাঁকা খঞ্জরের মতো।
শনিবার অনেক সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেছে বোমার শব্দে। শুনে শুনে গুনেছি- এক, দুই ... বারো। বারোটি বোমার শব্দ দিয়ে এবারের ঈদের সূচনা। মুক্তিভাইদের ঈদের শুভেচ্ছা। জনমুখে প্রচারিত পাকিস্তানীদের ঈদের জামাতে শরীক হলে এ্যাসিড খাবার ভয়। গুলি খাবার ভয়। মাইকে মাইকে আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। পাবলিক ভয় পাক বা না পাক সরকার পেয়েছে সন্দেহ নেই। মোড়ে মোড়ে অজস্র মিলিটারি। মসজিদে মাঠে। এমন কি মিনারে রাইফেল উঁচিয়ে। এমন অভিনব ঈদের আয়োজন কে কোথায় শুনেছে। ঘরে ঘরে বাচ্চারা রয়েছে বলেই সেমাই, জর্দা, পোলাও পারাটা। চোখ ভরে দেখার মতো দৃশ্য। বাংলাদেশ মার্কেটের কেনা কাপড় সবার ঈদের পোশাক।

হক ছাড়া জীবনে প্রথম ঈদ। সতেরো বছরের দাম্পত্য বলয়ে এমনটি ঘটেনি। শুনেছি ওপার বাংলায় রিফিউজীদের নানা ধরনের দুঃখ, অভাব, অসুবিধার কথা। কে জানে কিভাবে তার ঈদ হচ্ছে। বাবাকে ছাড়াও প্রথম ঈদ। কয়েক বছর হাত-পা কাঁপানির জন্য জামাতে শামিল হতে পারতেন না। কিন্তু নামাজ বাদ দিতেন না। প্রচণ্ড শীতের রাতেও সুবেহ সাদেকের সময় উঠে কাঁপতে কাঁপতে ওজু করতেন। গত ঈদে আমি একটা ঘিয়ে রং ফ্লানেলের ফুলশার্ট দিয়েছিলাম। চির সৌখিন মানুষটি সেটা পরে নতুন বেতের চেয়ারে, আলফ্রেড কাটা চুলে বসেছিলেন। মৃত্যুর সময় সেই শার্টটাই পরা ছিলেন। মহাশূন্য থেকে তিনি কি দেখছেন?

[ঈদের দিন] বোমা বাস্ট হলো। শান্তিনগর সরকারী ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের অফিসে। ফরিদপুর ম্যানসনের ধারের বাড়িটি নাকি চূর্ণ হয়ে গেছে। রামপুরা জংলা জমিতে মুখোমুখি লড়াই হয়েছে মুক্তি আর খানদের মধ্যে। গ্রামের দিকের বহু অংশ নাকি মুক্তিফৌজের দখলে। তারা এখন উল্টা পদ্মা, মেঘনা, গোমতী, মধুমতীতে কারফিউ দিচ্ছে শুধু খান সেনাদের জন্য।
ভারতীয় রেডিও জানাচ্ছে, আকাশ সীমা লংঘনকারী তিনটি পাকিস্তানী সেভয় জেটকে ভূপাতিত করা হয়েছে। খবরের সত্যতা পাকিস্তান স্বীকার করেছে। তবে তিন নয়, বিমানের সংখ্যা দুটি। জয়বাংলা কেন্দ্র জানাচ্ছে ঈদের দিন থেকে পরিকল্পিতভাবে তাদের দক্ষ সৈনিকরা অনেক সেক্টরে মুখোমুখি লড়াই করছে।
পাড়ায় মাঠের চারদিকে, খালি জমিতে ডাব্লিও গড়নের পরিখা তৈরির ধূম পড়েছে। আধ খনন করা মাটির ঢেলার গোলা বানিয়ে বাচ্চারা খেলার নতুন ক্ষেত্র পেয়েছে।’’

১৯৭১-এ ঈদের সময় ঢাকার আরামবাগে অবস্থান করছিলেন শিল্পী হাশেম খান। ঈদের নামাজ পড়েন আরামবাগের শুরু ও ফকিরাপুল বাজারের মাঝামাঝি অবস্থিত একটি মসজিদে। ‘গুলিবিদ্ধ একাত্তর’ গ্রন্থে ঈদেরদিনের স্মৃতিচারণ করে তিনি লিখেছেন :

‘আজ ঈদ। আনন্দের দিন, উৎসবের দিন। কিন্তু কী আনন্দ করবো এবার আমরা? নতুন জামা কাপড় বা পোশাক কেনা-কাটার আগ্রহ নেই! শিশু-কিশোরদের কোনো আবদার নেই, চাওয়া-পাওয়া নেই। বাড়িতে বাড়িতে কি পোলাও কোরমা ফিরনী সেমাই রান্না হবে? আমার বাড়িতে তো এসবের কোনো আয়োজন হয়নি। প্রতিটি বাঙালির বাড়িতে এরকমই তো অবস্থা।
... তিন তলার বারান্দা থেকে আরামবাগের শুরু ও ফকিরাপুল বাজারে মাঝামাঝি অবস্থানে মসজিদটি দেখা যায়। সকাল ৮টা থেকে মাইকে ঘোষণা দিচ্ছে সাড়ে নয়টায় নামায হবে। যথাসময়ে মসজিদে গিয়ে হাজির হলাম। নামায হল, খুৎবা হল, মোনাজাতও হল। খুৎবা ও মোনাজাতে ইমাম সাহেব পাকিস্তানের কল্যাণ কামনা করে এবং পাক সেনাবাহিনীর গুণকীর্তন করে দোয়া চাইলেন খোদার কাছে।
ইমাম সাহেব হয়তো রাজাকার ও পাকসেনাদের দালালদের শোনানোর জন্যেই অত জোরে শব্দ করে মোনাজাত করছেন, আল্লাহর কাছে কাঁদছেন, তাতে তার অন্তরের সায় কতখানি ছিল জানি না। তবে বাঙালি মুসলিম কেউই যে ইমামের মোনাজাত কর্ণপাতও করেনি তা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। সবাই বিড় বিড় করে নিজের মোনাজাত করেছে- খোদা, হানাদার আর হিংস্র পশু পাকসেনাদের কবল থেকে তোমার নিরীহ বান্দা বাঙালিদের বাঁচাও, মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষা কর। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস যোগাও তারা যেন পশুদের তাড়িয়ে আমাদের দেশকে মুক্ত করতে পারে।’

কাজী আনোয়ারুল ইসলাম তাঁর ‘আমার একাত্তর’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন:

‘ঈদ হয়ে গেলো। আব্বা একা গিয়ে ঈদের নামাজ পড়ে এলেন। আমি, মিন্টু, হাসান কেউই ঈদের নামাজ পড়তে গেলাম না। বুদ্ধি হওয়ার পর এই প্রথম ঈদের জামাতে নামাজ পড়লাম না। খুব সম্ভব একুশে নভেম্বর ঈদ হলো [হবে ২০ নভেম্বর]। আনন্দহীন ঈদ। বাঙালিরা কেউ কারও বাড়ি গেলো না। ইয়াহিয়া সরকার বাঙালিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, তাঁরা আজ ঈদের মাঠেও যেতে সাহস পাচ্ছে না। ইসলামি রাষ্ট্রে আমরা ঈদের নামাজ পড়তে পারলাম না।’

সাহিত্যিক আবুল ফজল ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে লেখক-শিল্পী-শিক্ষকদের  প্রতিবাদ মিছিলে শরিক হয়েছিলেন। পরে চট্টগ্রাম শহর যখন শত্রুকবলিত হয়, তখন চলে গিয়েছিলেন গ্রামে। কয়েকমাস পরে আবার ফিরে এসেছিলেন শহরে। নিজের বাসায় ওঠার ভরসা পাননি, ছিলেন অন্যের আশ্রয়ে। তাঁর সে সময়কার ভাবনার স্বাক্ষর আছে ‘দুর্দিনের দিনলিপি’তে। ১ জুলাই ১৯৭১ থেকে ৩০ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত সময়ের স্বর তিনি সেখানে তুলে ধরেছেন। এই গ্রন্থে আবুল ফজল ঈদের দিনের বর্ণনায় লিখেছেন :

‘আজ ঈদ। রমজান শেষে খুশীর ঈদ। যে খুশী আমাদের কবিরা প্রতি ঈদের দিনে নানাভাবে ব্যক্ত করে থাকেন প্রতি বছর। আজ পাকিস্তানী হানাদারদের তাণ্ডবে সব খুশী দেশ-ছাড়া মায় ঈদের খুশীটুকুও। এমন নিরানন্দ ঈদ বাঙালির জীবনে আর দ্বিতীয় বার আসেনি। প্রেসিডেন্ট এহিয়ার চণ্ডাল-নীতির ফলে, গত মার্চ মাস থেকে সারা পূর্ব বাংলাব্যাপী এক নিদারুণ নিরানন্দময় জীবনের শুরু। তার অবসান এখনো দুর্নিরীক্ষ। পূর্ব বাংলার মানুষ আজ স্বাধীনতার মরণ পণ সংগ্রামে লিপ্ত। অসংখ্য পরিবার শোকে মুহ্যমান। তাই ঈদ আজ তাদের জীবনে স্রেফ এক মর্মান্তিক ব্যঙ্গ বিদ্রুপ। দেশের বহু পরিবার হারিয়েছে একমাত্র উপার্জনক্ষম অবলম্বনকে, বহু পিতা-মাতা হারিয়েছে পুত্রকে, বহু তরুণী স্ত্রী হারিয়েছে স্বামীকে, বহু বোন হারিয়েছে ভাইকে- প্রিয়জনের শোকে আজ ঈদের দিনে ওদের চোখে নেমেছে নতুন করে অশ্রুর ঢল। এ অবস্থায় কোথায় হাসি, কোথায় এতটুকু আনন্দ? শূন্য বুকে এতখানি হাহাকার নিয়ে কে করবে কার সঙ্গে কোলাকুলি। চারদিকে শোকের ছায়া, বিদীর্ণ হৃদয়ের হতাশা আর নৈরাশ্যের দীর্ঘশ্বাস।

... কালচক্রের স্বাভাবিক আবর্তনে দেশব্যাপী এমন দুঃখ দুর্দশা, স্বপ্নভঙ্গ আর হতাশা-বিভ্রান্তির মাঝে এবারকার ঈদের চাঁদের উদয়। এ চাঁদ একদিন হাসি-খুশী আর আনন্দ-উল্লাসের উৎস ছিল- খাওয়া আর খাওয়ানোর, দেওয়া আর নেওয়ার এক মহা মিলনোৎসব। এবার এমন চাঁদের দিকে কেউ একটুখানি উৎসুক চোখে একবার তাকিয়েও যেন দেখলে না। গতানুগতিক জড়-অভ্যাসবশত রোজাদারেরা রোজা ছাড়লে, সকালে গিয়ে শরিক হলেন ঈদের জামাতে, হয়তো বা মুখেও দিলে একটুখানি সেমাই। কিন্তু দেখা গেল না কোথাও এতটুকু প্রাণের চাঞ্চল্য, উৎসাহ-উদ্দীপনা কিম্বা চোখে মুখে হাসি খুশীর ঝিলিক। নজরে পড়লো না নতুন পোষাক আশাকের জৌলুষ। সবই গতানুগতিক, জড় অভ্যাসেরই পুনরাবৃত্তি। পুরাতন জামা কাপড় ধোলাই করে বা নিজের হাতে একটুখানি কেঁচে নিয়ে তা গায়ে চড়িয়েই কোন রকমে গিয়ে শরিক হলো ঈদের জমাতে। আর হয়তো গিয়ে, কাছাকাছির মধ্যে যে সব আত্মীয় স্বজন রয়েছে তাদের সঙ্গে দেখা করলে, জানালে ঈদ মুবারক, সারলে কোলাকুলির পালা। মনের ভিতর অসীম দুঃখ বেদনা আর প্রতিরোধ প্রতিহিংসার আগুন বুকের তলে চেপে রেখে পূর্ব বাংলার মানুষ এবার ইদুল ফিত্র উদযাপন করলে।’

এক তরুণীর দেখা স্বাধীনতা যুদ্ধের দিনগুলোর অনুপুঙ্খ বর্ণনা লিপিবদ্ধ হয়েছে ‘যুদ্ধে যুদ্ধে নয় মাস’ গ্রন্থে। গ্রন্থের রচয়িতা সাহিদা বেগম। যুদ্ধকালে তাঁর বয়স ছিলো ষোল। গ্রন্থে তিনি একাত্তরের ঈদ সম্পর্কে লিখেছেন :

‘আজ ঈদুল ফিতর। গ্রামে প্রায় সবাই রোজা রেখেছে সারা মাস। কিন্তু ঈদের আনন্দ নেই কারো মনে। ... আমাদের ঘরেও ঈদ এলো এবার কিছুটা ভিন্নভাবে। বুবু সেই যে টাইফয়েডে পড়েছে, এখনো সারেনি সেই অসুখ। কারো জন্যই কোনো নতুন জামাকাপড় কেনা হয়নি। তুলে রাখা চাদর, কুশন কভার বের করা হয়নি। বিছানা পাতা হয়নি, ফুলদানিতে রাখা হয়নি ফুল, ঘর সাজানো হয়নি। রুবি সকালের দিকে কতোক্ষণ ঘুরেফিরে এসে বললো, ‘দুর মনেই হচ্ছে না যে আজ ঈদ। কোনো ফুর্তি নেই। যার ঘরে যাই, দেখি সেই কাঁদছে। মনে হচ্ছে কারবালার মাতম চলছে।’

এ তো গেল স্বাধীনতা প্রত্যাশী সাধারণ মানুষের একাত্তরের ঈদের অনুভূতি। কিন্তু এর উল্টোটাও দেখেছে সেদিন এ দেশের প্রতিটি শস্যদানা। বলাবাহুল্য রাজাকারদের কাছে একাত্তরের ঈদ ছিল অন্যান্য বছরের চেয়েও আনন্দের। রাজাকাররা একাত্তরের ঈদকে কিভাবে দেখেছে তার বর্ণনা পাওয়া যায় আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘আত্মস্মৃতি’ গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন:

‘একুশে নভেম্বর রবিবার (ঈদের পরের দিন) জহুরের ওখানে গিয়েছিলাম (জহুর হোসেন চৌধুরী)। সেখানে দেখলাম টেক্সটইল মিল ও চাবাগানের মালিক মকবুলুর রহমানকে (নওয়াব মোশাররফ হোসেনের ভ্রাতুষ্পত্র)। মকবুলুর রহমান জামাতে ইসলামীর টিকেটে জলপাইগুড়ি সীমান্তের এক নির্বাচনী এলাকা থেকে ইলেকশনে দাঁড়িয়ে ফেল করেন। আবারও তথাকথিত বাই ইলেকশনে দাঁড়িয়েছেন কিন্তু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পারছেন না। বললেন, এবারের মতো এত বড়  ঈদের জামাত নাকি পল্টন ময়দানে আর কখনও দেখেন নি, বায়তুল মোকাররমেও তাই। লোকজন নাকি পুরোদমে ঈদ করেছে।
কিছু বললাম না। জহুর আমাকে বহু আগেই মকবুলুর রহমানের সাথে তর্কবিতর্কে প্রবৃত্ত হতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, মকবুল আমার ক্লাস ফ্রেন্ড, তার সঙ্গে  আমার খিস্তিখেউর চলে, সে আমার ক্ষতি করবে না; কিন্তু আপনাকে জাফর ভাই ছাড়বে না, মকবুল সাংঘাতিক লোক।
মকবুলুর রহমান চলে গেলে জহুরকে বললাম, এমন নির্জলা মিথ্যা মানুষ কেমন করে বলতে পারে! নিজে যদি শহরে না বেরোতাম তাহলেও না হয় বুঝতাম।

দোহাই :
০১. কামাল লোহানী,  দৈনিক ভোরের কাগজ, ঈদ সাময়িকী, ২০০৮
০২. জয়বাংলা, ১ম বর্ষ ২৮ সংখ্যা ১৯শে নভেম্বর ১৯৭১ এবং ১ম বর্ষ ২৯ সংখ্যা ২৬শে নভেম্বর ১৯৭১
০৩. ফজলুল বারী, একাত্তরের আগরতলা,  ঢাকা, নওরোজ কিতাবিস্তান, ১৯৯৭
০৪. আনিসুজ্জামান, আমার একাত্তর, ঢাকা : সাহিত্য প্রকাশ, ৩য় মুদ্রণ ২০০৬
০৫. মতিউর রহমান; ইতিহাসের সত্য সন্ধানে : বিশিষ্ট  ব্যক্তিদের মুখোমুখি, মাওলা ব্রাদার্স ২০০৪
০৬. জাহানারা ইমাম, একাত্তরের দিনগুলি, রজতজয়ন্তী সংস্করণ ২০০, সন্ধানী প্রকাশনী
০৭. আবু জাফর শামসুদ্দীন,  আত্মস্মৃতি, অখণ্ড সংস্করণ, সাহিত্য প্রকাশ; ২০০৫
০৮. রাবেয়া খাতুন, একাত্তরের নয় মাস, আগামী প্রকাশনী, ১৯৯১ 
০৯. কাজী আনোয়ারুল ইসলাম, আমার একাত্তর, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ১৯৯৮
১০. মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম, রক্তেভেজা একাত্তর, সাহিত্য প্রকাশ ২য় সংস্করণ, ২০০৪
১১. মাহবুব আলম, গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে ২য় খণ্ড, সাহিত্য প্রকাশ ১৯৯৩
১২. বেগম মুশতারী শফী, স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন,  ৩য় স. অনুপম প্রকাশনী, ১৯৯২
১৩. গোলাম মুরশিদ, যখন পলাতক : মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি, সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৩
১৪. মোঃ মিজানুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ ও ভারেত শরণার্থী ক্যাম্পের স্মৃতি,  বিদ্যাপ্রকাশ, ২০০৯
১৫. আবুল ফজল, দুর্দিনের দিনলিপি, বইঘর, ডিসেম্বর ১৯৭২
১৬. সাহিদা বেগম, যুদ্ধে যুদ্ধে নয় মাস, সাহিত্য প্রকাশ, ২য় মুদ্রণ ১৯৯৩
১৭. হাশেম খান, গুলিবিদ্ধ একাত্তর



২৭ জুন ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়