ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

দেশি টিভি নাটক, দেখেন নাকি দেখেন না? || আবুল হায়াত

আবুল হায়াত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৫, ২৯ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দেশি টিভি নাটক, দেখেন নাকি দেখেন না? || আবুল হায়াত

শহরে, গ্রামে-গঞ্জে, মাঠে-ঘাটে শুটিং করার কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সাথে দেখা হয়, কথা হয়। খুব স্বাভাবিক কারণে নাটকের মানের কথাও চলে আসে আলাপ-আলোচনায়। বেশির ভাগ মানুষের মুখেই একটি কথা- ‘নাটক তো তেমন দেখা হয় না’।

‘তাহলে কী দেখেন?’

উত্তর দিতে চান না সহজে। পরে আমতা আমতা করে জানান- কলকাতার বাংলা ধারাবাহিকগুলো তারা নিয়মিত দেখেন।

‘আর কিছুই দেখেন না? যেমন খবর, গান, নাচ?’ উত্তর না-বাচক।


একটি উদাহরণ দিই, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে, তাহলে বিষয়টি সবার কাছে প্রাঞ্জল হবে। আমি মাসে একবার শুটিং করি দিন দু’তিনের জন্যে ‘অলসপুর’ নাটকের। পুবাইলের ‘মেঘডুবি’ গ্রামে। ওখানকার একটি বাড়িতে আমাদের ঘাঁটি। সারাটা দিন, প্রায় রাত দশটা পর্যন্ত ওখানেই থাকি। আমি হলফ করে বলছি, ওদের একটি ঘরে টেলিভিশন চলে বিরতিহীন, কখনো থামতে দেখিনি- আর তাতে চলে হিন্দি  সিনেমা। চলছে তো চলছেই, কেউ দেখুক আর না দেখুক। দেশীয় কোনো চ্যানেল আমি কখনো চলতে দেখিনি।


এই হচ্ছে আমাদের দেশি চ্যানেলের হাল। দেশের মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন দেশের চ্যানেল থেকে। শহরের মানুষ তাও খবর দেখেন, দেখেন টক-শো। গান-নাচ কদাচিৎ দেখেন, কিন্তু নাটক?

‘না।’

‘কেন দেখেন না?’

‘খুব বাজে নাটক হয়।’

যে কোনো ব্যক্তি আপনাকে মুখের ওপর জবাব দিয়ে দেবেন।

আমি কখনও তর্কের খাতিরে আমার নির্মিত কোনো নাটকের নাম বলি- ‘ওমুক নাটকটা দেখেছেন ভাই?’

‘না ভাই, ওটা তো দেখা হয়নি। কখন হয়েছে?’

একবার আমি দশটা নাটকের নাম বলে দেখেছি, উত্তর একই। কখন হয়েছে, কবে হয়েছে, জানতাম না, দেশে ছিলাম না, তাই নাকি! ইত্যাদি।

তারপর আমি যখন আমাদের কয়েকজন ভালো নাট্যনির্মাতার নাম বলি, তিনি তাদের চিনতেই পারেন না।


উপরের উদাহরণ কিন্তু গোটা দেশের চেহারা। কি গ্রাম, কি শহর- সব জায়গায় একই চিত্র। সবার অভিযোগ নাটক খারাপ হয়। কিন্তু কোন নাটকটা খারাপ নির্দিষ্ট করে বলতে পারেন না।

এখন প্রশ্ন হলো, কেন আমাদের দর্শক নাটক বিমুখ, তথা দেশি টিভি বিমুখ? প্রথম অভিযোগ তো বললাম- নাটকের মান, দ্বিতীয় অভিযোগ, বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণা। তৃতীয় হলো পিক আওয়ারে খবরের ছড়াছড়ি।

‘বিজ্ঞাপন কি ভারতের টিভিতে হয় না?’

‘হয়, কিন্তু কম। বুঝতে পারি কতক্ষণ বিজ্ঞাপন হবে। সবচেয়ে বড় কথা, যখন নাটক শুরু হওয়ার কথা ঠিক সেই সময় বিজ্ঞাপন শুরু হয়। আর আমাদের টিভিতে? হা!’

বিরাট হতাশার নিঃশ্বাস ফেলেন দর্শক।


তাহলে বোঝা যাচ্ছে, একটি অনুষ্ঠান উপভোগ করার জন্য দর্শক নির্ধারিত সময়ে টিভির সামনে বসেন এবং যখন দেখেন সেই সময়ে অনুষ্ঠানটি শুরু হচ্ছে না, এমন কি কেন দেরি  হচ্ছে এবং কখন শুরু হবে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে না, তখন তিনি মুখ ফিরিয়ে চলে যান তার পছন্দের অন্য অনুষ্ঠানে, বীতশ্রদ্ধ মন নিয়ে- আর কখনও বসবো না এসব অনুষ্ঠান দেখতে- এই মনোভাব নিয়ে।


তারপরেও যদি সময়মত শুরু হতো। ৪০ মিনিটের নাটক দেখার জন্য ৯০ থেকে ১২০ মিনিট সময় ব্যয় করতে হয় দর্শককে। বাদবাকী সময়ে বিজ্ঞাপন, নয়তো সংবাদ শিরোনাম। কার এত ধৈর্য বা মাথাব্যথা আমাদের নাটক দেখতে যন্ত্রণা ভোগ করার।


তৃতীয় যন্ত্রণা- সংবাদ। পিক আওয়ারে সংবাদ চলে যখন মানুষ বিনোদনের অপেক্ষায় থাকে। সবচেয়ে বড় কথা বিনোদন চ্যানেলে চলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খবর। আর টক-শো?

এ ছাড়াও আর এক যন্ত্রণা আছে ‘স্ক্রলে সংবাদ’। আপনি দেখছেন নাটক, মন থাকবে নাট্য মুহূর্তে। নাটকের সংলাপে, কিন্তু প্রতি মুহূর্তে সংবাদ Scroll (তাও দু-তিন লাইন)-এ ভেসে উঠবে কারও আহত অথবা নিহত হওয়ার সংবাদ। নয়তো জেল জামিনের খবর, সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ, মানহানির মামলা, জামিন মঞ্জুর, না-মঞ্জুর ইত্যাকার সব খবর। মনটা কি নাটকে রাখা সম্ভব দর্শকের? আজকাল আবার নতুন যন্ত্রণা পর্দার আশপাশে বিজ্ঞাপন দেখাতে হঠাৎ করেই পর্দা ছোট-বড় করা হচ্ছে। এত যন্ত্রণা সয়ে নাটক দেখা? নৈব, নৈব চ।


এবার নাটকের মান নিয়ে দু’চার কথা বলতেই হয়। দর্শক নাটক দেখতে চান অবশ্যই, কিন্তু খারাপ নাটকের ভিড়ে ভালো নাটকগুলো তাদের দৃষ্টির অগোচরে রয়ে যায়।

সব নাটকই কি খারাপ হয়? বা সব নাটকই কি যথাযথ মানের হয়?

দু’দলের দু’রকম প্রশ্ন। দর্শক এবং নির্মাতা। সত্যি কথাটা হলো, নাটক তো যে কেউ বানাতে পারে। পারে বলতে যা খুশি তাই নির্মাণ করতে পারে। আইনত তাতে তো বাধা দেবার কোনো উপায় নেই। আমার টাকা আছে আমি নাটক বানাবো। তাতে কার বাপের কী? কিন্তু তাই বলে ‘মান-নিয়ন্ত্রণ’ বলে কোনো কিছু থাকবে না? অবশ্যই থাকতে হবে।

এই নিয়ন্ত্রণ এখন কোথায়, কার হাতে?

অবশ্যই চ্যানেলের হাতে। তারাই তো পয়সা দিয়ে নাটক কিনছেন, বা টাকা খাটিয়ে নাটক বানিয়ে নিচ্ছেন।

তাহলে নাটক যদি খারাপ হয়, তারা টাকা দিয়ে খারাপ নাটক কিনছেন, বা টাকা খাটিয়ে নিম্ন মানের নাটক বানিয়ে নিচ্ছেন। সুবিধা একটাই- নিম্ন মানের নাটক বানাতে টাকা কম লাগে এবং যাকে তাকে দিয়ে বানানো যায়। যেখানে বাজেট স্বল্পতার কারণে না থাকে ভালো পাণ্ডুলিপি, না থাকে যথাযথ Location, Cameraman, Technician, Artist. কোনো কিছুই যথাযথ মানের হয় না। হতে পারে না।


কারণ টাকা সরাসরি মানের সাথে জড়িত। টাকা কম লগ্নী করলে খুবই কম সময়ে নাটক নির্মাণ করতে হয়। সুতরাং কম সময়ে উন্নত মান কোথা থেকে আসবে? কথায় বলে ‘যত গুড় তত মিষ্টি’।

এর ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রকৃত নির্মাতারা। বাজেটের স্বল্পতার কারণে তাদের মেধার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো সম্ভব হচ্ছে না। অথচ নিজের পেশাগত কারণে নাটক কম টাকায় বানাতে বাধ্য হচ্ছেন, কারণ তার রুটিরুজির ব্যবস্থা তো করতে হবে দিন শেষে।

এভাবেই নাটক হারাচ্ছে তার মান, তার গৌরব। এইসব জটিলতার মাঝেও যথেষ্ট ভালো নাটক হচ্ছে কিন্তু গড্ডালিকায় ভেসে যাচ্ছে সে নান্দনিক সৃষ্টিগুলি। সবশেষে বলি, নাটক নিয়ে একটা আন্দোলন শুরু হয়েছিল ইদানীং কালে সেটাও মনে হয় অজানা কারণে স্তিমিত হয়ে গেল।


এ নিয়ে জনগণের মনে এক ধরনের বিভ্রান্তির সৃষ্টি হলো। কেন, আমি জানি না-‘সুলতান সোলেমান’ নামের এক বিদেশি ধারাবাহিককে আমাদের শত্রু বানানো হলো।

কিন্তু ‘সুলতান সোলেমান’ কি আমাদের শত্রু? আমি কখনোই তা মনে করি না।

বিদেশি ধারাবাহিক এদেশের চ্যানেলে সব সময় চলেছে। নিশ্চয় এখনও চলছে ও চলবে। তবে হ্যাঁ, সরকারকে এইসব বিদেশি অনুষ্ঠানের ব্যাপ্তি নির্ধারণ করে দিতে হবে। যেমন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কত শতাংশ সময় আপনি বিদেশি অনুষ্ঠান চালাবেন এবং কোন সময় চালাতে পারবেন তা আইন করতে হবে। এটা দেশীয় সংস্কৃতিকে নিরাপত্তা দেবার জন্যেই করতে হবে। দেশীয় শিল্পী, কলাকুশলীদের স্বার্থরক্ষার জন্যে।


আমাদের আরো দাবি নাটক নির্মাণের জন্য কোনো লেখক, শিল্পী, কলাকুশলী বিদেশ থেকে আনতে পারবেন না কেউ। সরকারের অনুমতি ছাড়া এবং সরকার তখনই অনুমতি দেবেন যখন এদেশের সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশন ছাড়পত্র দেবে।

এই নিয়ম বলবৎ না হওয়ায় মিডিয়ার শিল্পী কলাকুশলীর মধ্যেও চরম হতাশা বিরাজ করছে। কারণ অনেকেই কাজ না পেয়ে বসে থাকেন আর বিদেশিরা এসে একগুচ্ছ টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছেন আমাদের কাজ করে।

আমাদের চ্যানেল মালিকদের মধ্যেও এক ধরনের মানসিকতা মিডিয়ার এই ক্ষতির কারণ। তারা দেশিদের চেয়ে বিদেশিদের তিন-চার গুণ পারিশ্রমিক দিয়ে কাজ করাতে পছন্দ করেন। ফলে এক ধরনের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে দেশি-বিদেশি শিল্পী-কুশলীর মধ্যে।

মোটা দাগে কিছু সমস্যার কথা বললাম। আরো অনেক দিক খুঁজলে পাওয়া যাবে নাটকের এ দশার পেছনের কারণগুলো। সমাধান বের করবে কে জানি না? এখন বিভিন্ন পেশাজীবির নির্বাচিত পরিষদ গঠিত হয়েছে। তাদেরই দায়িত্ব এটা।

এদের কাছেই আমাদের আশা। কিছু একটা করবে সকলে মিলে। নাটক বাঁচাতে হবে। পাঁক থেকে বের করে আনতে হবে।

কারণ নাটকই হচ্ছে মিডিয়ার সবচেয়ে দর্শকপ্রিয় অনুষ্ঠান। দর্শককে ফিরিয়ে আনতেই হবে ঘরমুখে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ জুন ২০১৭/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়