ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আবদ্ধ ঢাকায় অবরুদ্ধ শৈশব

জাহাঙ্গীর আলম বকুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২২, ৪ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আবদ্ধ ঢাকায় অবরুদ্ধ শৈশব

জাহাঙ্গীর আলম বকুল : ঢাকা জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের ১১তম বৃহত্তম মহানগরী। যেভাবে জনসংখ্যা বাড়ছে, তাতে দেড় দশক পর ষষ্ঠ বৃহৎ মহানগরীতে পরিণত হবে।

ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশন এলাকায় এখন বাস করে ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ। দেড় দশকের মধ্যে তা গিয়ে দাঁড়াবে ২ কোটি ৭৪ লাখে। ক্রমশ বাড়তে থাকা এই নগরীর নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে বিস্তর উদ্যোগ দৃশ্যমান। নির্মাণ করা হচ্ছে মেট্রো রেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। সুউচ্চ আধুনিক ভবন।

ঢাকা নগরীর আয়তনও বাড়ছে। ঢাকার আশপাশের ১৬টি ইউনিয়নকে ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনের মধ্যে এনেছে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস-সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি (নিকার)। এর ফলে ঢাকা মহানগরের আয়তন বেড়ে হয়েছে ২৭০ বর্গকিলোমিটার, যা পূর্বের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।

মানুষের অর্থনৈতিক সঙ্গতি এবং আধুনিক জীবন-যাত্রা বিবেচনায় রেখে ঢাকাকে বাড়ানো হয়েছে। বাড়ছে রাস্তাঘাট, অফিস, যানবাহন। কিন্তু দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সব সময় উপেক্ষিত থেকেছে, তা হলো শিশুদের খেলার মাঠ। অথচ এ বিষয়ে নগরবিদদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা ছিল। আরেকটি বিষয় সবুজায়ন।

বর্তমানে দেশের জনসংখ্যার ছয় কোটির বেশি শিশু। এর মধ্যে ঢাকায় থাকে ৭০ লাখের বেশি। নিরাপত্তা শঙ্কা এবং খেলাধূলার পর্যাপ্ত মাঠ না থাকায় এরা শৈশব-কৈশোরে চার দেয়ালের মধ্যে অবরুদ্ধ থাকে। এতে এদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ পরিপূর্ণ হয় না। এ নিয়ে নীতিনির্ধারকদের উদ্বেগ দেখা যায় না।

২৭০ বর্গকিলোমিটারের এই নগরীতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ। যার বড় অংশই শিশু। এদের জন্য খেলার মাঠ রয়েছে মাত্র ২৫টি। আর পার্ক রয়েছে মাত্র ৫৪টি। (সিটি করপোরেশনে ১৬টি ইউনিয়ন যুক্ত হওয়ার এ সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে)। বাস্তবে দেখা যায়, দখল হতে হতে ১২টি পার্ক ও মাঠ আর অবশিষ্ট নেই। এত সংখ্যক শিশু খেলবে কোথায়?



শিশুদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় খেলাধূলা। তারা মুক্ত স্থানে অবাধে সমবয়সীদের সঙ্গে আনন্দ উচ্ছ্বাসে দিনের কিছুটা সময় কাটাবে- এটা শৈশব বা কৈশোরে তাদের শারীরিক সক্ষমতাকে যেমন মজবুত করবে, একই সঙ্গে বন্ধুদের সঙ্গে মিশে অচেনা জগৎকে ধীরে ধীরে চিনতে থাকবে। সবাই মিলে কাজ করতে শিখবে, দায়িত্ব নিতে শিখবে। ঢাকা নগরীর নিঃসঙ্গ পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুদের স্কুল জীবন পেরিয়ে যায়, অথচ তার চেনা-জানার জগৎ মা-বাবা বা পরিবারের কয়েকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।

এই শিশুদের কাছে সমাজের অনেক রূপ-রঙ অচেনা-অজানা থাকে। এদের শৈশব-কৈশোরে বন্ধন ভাঙার বা সীমানা পেরিয়ে অদেখাকে দেখার সাহস থাকে না। নিষ্প্রাণ  ও নিরানন্দ শৈশব-কৈশোরকে তারা সারা জীবন বহন করে। 

কয়েক শত বর্গফুটের ফ্ল্যাটে বন্দি শিশুদের ভালোভাবে নড়াচড়ার সুযোগ মেলাও কঠিন। এর সঙ্গে আছে ফাস্টফুডের অভ্যাস। এতে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরও মুটিয়ে যেতে থাকে। পাল্লা দিয়ে শরীরে বাসা বাধে রোগ। এই শিশুরা সবুজ দেখতে পায় না। তাদের চারপাশে শুধু কংক্রিটের বাহারি দেয়াল। রাস্তাঘাটে কখনো দু’একটি বৃক্ষের দেখা মেলে বটে কিন্তু ধূলোবালি জমে ওই বৃক্ষের রঙ যে সবুজ, তা বোঝাও কঠিন হয়ে পড়ে। অল্প বয়সে এদের চোখে লাগাতে হয় পুরু চশমা। 

মানুষের জীবনে শৈশব-কৈশোরে মান-অভিমান, বিবেচনাহীন ভালোলাগা, প্রিয়জনের সঙ্গে খুনসু্ঁটি, দস্যিপনা ও দূরন্তপনার স্মৃতি থাকে। এটা তার সম্পদ। ঢাকা নগরীতে ভিডিও গেম এবং টিভি কার্টুনে বন্দি শিশুরা শৈশবের কী স্মৃতি বহন করবে?  

প্রাথমিক শিক্ষা অধিপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে ৩৩৮টি প্রাইমারি স্কুল, ৪৫০ এনজিও পরিচালিত স্কুল এবং ১১ হাজারের বেশি কিন্ডারগার্টেন রয়েছে। কিছু সংখ্যক সরকারি স্কুলে খেলার মাঠ থাকলেও বেসরকারি স্কুল, কিন্ডারগার্টেন, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ৯৮ ভাগেরই নেই।



বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য ৫ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুর দিনে কমপক্ষে এক ঘণ্টা খেলাধূলা করা প্রয়োজন। অথচ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)-এর সাম্প্রতিক জরিপ থেকে জানা যায়, রাজধানীর মাত্র ২ শতাংশ শিশু ঘরে-বাইরে কিংবা স্কুলে গিয়ে খেলার সুযোগ পায়। রাজধানীর শিশুদের মুটিয়ে যাওয়ার হারও সারা দেশের শিশুদের তুলনায় বেশি। স্থূলতার কারণে পরবর্তীতে উচ্চ রক্তচাপ, অল্প বয়সে ডায়াবেটিস, দুর্বলতা, চোখের সমস্যার মতো শারীরিক ঝুঁকিতে থাকে।   

খেলাধূলার সময় রক্ত প্রবাহ বাড়ে। এটা শিশুর দেহ-মন গঠন এবং সুস্থ জীবনের জন্য জরুরি। খেলাধূলার মাধ্যমে শিশুরা নানান পরিস্থিতি সামাল দিতে শেখে। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, পরাজয় মেনে নিতে শেখে।

আমরা যারা গ্রামে বড় হয়েছি, আমরা জানি ঝুম বৃষ্টিতে নদীতে সাঁতার কাটা বা পুকুরে ডুব সাঁতার খেলা কতটা আনন্দের। বর্ষায় কাদায় সমবয়সীদের সঙ্গে দস্যিপনা আর বসন্তে সূতাছেঁড়া ঘুড়ির পেছনে ছোটার আনন্দ, ছুটতে ছুটতে পথ-হারিয়ে ভিন্নগ্রামে গিয়ে পথ-খুঁজে বাড়ির ফেরার রোমাঞ্চ- এই কষ্ট ও আনন্দের সঙ্গে ঢাকার শিশুরা পুরোপুরি অপরিচিতি। আমাদের সামনে দিগন্তবিস্তৃত মাঠ আর খোলা আকাশ ছিল।। সবুজ বনানী ছিল। বন্ধনহীন সেই জীবনে কোথাও হারিয়ে যাওয়ার মানা ছিল না।

ঢাকা নগরীরর শিশুরা পথ হারিয়ে পথ খোঁজে না। দস্যিপনা, দূরন্তপনা করে না।   এরা কখনো খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে নিজেকে আবিষ্কার করার সুযোগ পায় না। টিভি বা কম্পিউটারের পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে বাইরের বৃহৎ জগৎ, প্রকৃতির বৈচিত্র্য, এর রূপ-রস ও গন্ধের সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ খুব একটা ঘটে না। 

মানুষ বিকশিত হয় সামাজিক, আধ্যাত্মিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে। পরিপূর্ণ  বিকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশের প্রয়োজন। ঢাকার শিশুরা সেই পরিবেশ পাচ্ছে না। তারা এককেন্দ্রিক ভোগবাদী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। এটা নিজের জন্য যেমন অনিষ্ট ডেকে আনছে, সমাজকেও বিকশিত করছে না।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ আগস্ট ২০১৭/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়