সু চিও খেলছেন রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে!
শাহেদ হোসেন : হিটলারের প্রচারমন্ত্রী জোসেফ গোয়েবলসের চিন্তা ভাবনা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রায় আটটি দশক পেরিয়ে গেলেও তার প্রচারতত্ত্বটি রাজনীতিতে এখনো বেশ জনপ্রিয়। জলজ্যান্ত মিথ্যাকে নিখাঁদ সত্যে পরিণত করার ব্যাপারে তার নীতি ছিল- কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক, মিথ্যাটাকে সত্য বলে অবিরাম প্রচার করতে থাকুন। একসময় জনগণের কাছে সেই মিথ্যই সত্য বলে মনে হবে।
আশির দশক থেকে আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে গোয়েবলসের নীতি অনুসরণ করে যাচ্ছে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, তারা বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অনুপ্রবেশকারী- এই ধুন তোলা হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। একইসঙ্গে প্রচার করা হচ্ছে, রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসী, দাঁঙ্গাবাজ। তারা নিরীহ (!) বৌদ্ধভিক্ষুদের ওপর আক্রমণ চালায়।
একদিকে নিজের দেশের নাগরিকদের কাছে আর অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গাদের অসুর হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। অপরদিকে দেশটির ইতিহাস থেকে রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব মুছে ফেলতে স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়েও আনা হয়েছে পরিবর্তন। গত বছর দেশটির সংস্কৃতি ও ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ইতিহাস বিষয়ক পাঠ্যবই প্রকাশের পরিকল্পনা করেছে যাতে রোহিঙ্গাদের কথা একেবারেই উল্লেখ থাকবে না। খোদ মন্ত্রণালয়ের দাবি, মিয়ানমারের ইতিহাসে কোনো সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে কখনো রোহিঙ্গা নামে আখ্যায়িত করা হয়নি!
১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর দেশটির প্রায় ৭০০ বছরের আদি বাসিন্দা রোহিঙ্গাদের জীবনে শুরু হয় দুর্ভোগের নতুন অধ্যায়। ১৯৭০ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সনদ দেওয়া বন্ধ করা হয়, ১৯৭৪ সালে কেড়ে নেওয়া হয় ভোটাধিকার। রোহিঙ্গাদের নির্মূলে ১৯৭৮ সালে শুরু হয় অপারেশন ‘কিং ড্রাগন’। ওই বছর আড়াই লাখ রোহিঙ্গা তাড়া খেয়ে বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে প্রবেশ করে। এরপর মিয়ানমারে ১৯৮৪, ১৯৮৫, ১৯৯০ ও ২০১২ সালে রোহিঙ্গা উচ্ছেদে একের পর এক অভিযান চালায় সামরিক জান্তা। এসব অভিযানে রোহিঙ্গাদের হত্যা-ধর্ষণ ছিল নিয়মিত ব্যাপার। ১৯৮২ সালে মিয়ানমার সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে। রোহিঙ্গাদের সংখ্যা যাতে না বাড়ে সেজন্য তাদের বিয়েতে পর্যন্ত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
রোহিঙ্গা নিধনে চরমপন্থি বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরও পরোক্ষভাবে মদদ জুগিয়েছিল সামরিক জান্তা। এদের উস্কানিমূলক প্রচারণায় রাখাইনে একাধিকার দাঙ্গার বলি হতে হয়েছে রোহিঙ্গাদের। গত পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে সেনাবাহিনী ও চরমপন্থি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের হামলায় বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে আসতে হয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গাকে। আর একই সময়ে হত্যার শিকার হতে হয়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে।
গত বছর সাধারণ নির্বাচনে অং সান সু চির দল এনএলডি প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলোর সঙ্গে ভোটযুদ্ধে বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করে মিয়ানমারের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে। সু চির এ বিজয় রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আশা জুগিয়েছিল। ভাবা হয়েছিল, হয়তো এবার সু চি রোহিঙ্গাদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে কিছু একটা করবেন। কিন্তু স্টেট কাউন্সিলর সু চি কি আদতে কিছু করেছেন?
গত বছর অক্টোবরে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা পুলিশের চৌকিতে হামলা চালিয়েছে দাবি করে রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধন অভিযানে নামে সেনাবাহিনী। প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশ আশ্রয় নেয় প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা। ওই সময় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন স্যাটেলাইট ব্যবহার করে রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন এলাকার ছবি সংগ্রহ ও প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেসব ছবিতে প্রকাশ পায় রোহিঙ্গাদের শত শত গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্য। রোহিঙ্গা নারীদের ব্যাপকহারে ধর্ষণ ও নির্যাতনের অভিযোগ ওঠার পর জাতিসংঘের কর্মকর্তারা একে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ এবং ‘জাতিগত নিধন’ হিসেবে অভিহিত করেন। ‘গণতন্ত্রপন্থি’ হিসেবে আখ্যা পাওয়া সু চি অন্যদিকে জান্তা আমলের মতোই জাতিসংঘের এই অভিযোগ অসত্য বলে উড়িয়ে দিলেন। জাতিসংঘ রাখাইনে স্বাধীন তদন্ত দল পাঠানোর চেষ্টা করলে মিয়ানমার সরকার তাতে বাধা দেয়।
সে সময় বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সু চি বলেন, ‘আমি মনে করি না সেখানে জাতিগত নিধন চলছে। সেখানে যা হচ্ছে, তা বোঝাতে ‘জাতিগত নিধন’ শব্দ ব্যবহার করা খুবই কঠিন হয়ে যায়।... মুসলমানরাই মুসলমানদের হত্যা করছে৷’ এমনকি তিনি গণমাধ্যমকে দুষলেন যে, তারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে অসত্য সংবাদ প্রচার করছে। অথচ জানুয়ারিতে যখন রোহিঙ্গাদের অবস্থা জানতে বিবিসির সংবাদদাতা জোনাহ ফিশার রাখাইন রাজ্যে রওনা হয়েছিলেন তখন মিয়ানমার সরকারের নির্দেশে তাকে মাঝপথে আটকানো হয়।
১৯৯১ সালে নোবেল কমিটি সু চিকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার যে তিনটি কারণ উল্লেখ করেছিল তার মধ্যে একটি ছিল জাতিগত শান্তি বজায় রাখায় তার শান্তিপূর্ণ ও অবিরত প্রচেষ্টা। ‘জাতিগত শান্তি’ শব্দটির মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়টিও উঠে আসে। অথচ ঠিক ২৫ বছর পর সু চি নিজেকে প্রমাণ করলেন একজন সাম্প্রদায়িক নেত্রী হিসেবে।
গত বছর বিবিসির সাংবাদিক মিশাল হোসেনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের সময় সু চিকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের আচরণ নিয়ে বেশ অপ্রিয় ও কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। ওই সাক্ষাৎকারের পর সু চি মন্তব্য করেছিলেন, ‘সে (মিশাল হোসেন) যে একজন মুসলমান কেউ তো আগে আমাকে জানায়নি।’
আন্তর্জাতিক আলোচনা-সমালোচনার মুখে গত বছরের আগস্টে রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘ তার প্রাক্তন মহাসচিব কফি আনানকে প্রধান করে ৯ সদস্যের আন্তর্জাতিক কমিশন গঠন করে। এটি গঠনে উদ্যোগ নিয়েছিলেন সু চি। এই তদন্ত কমিশন গত বৃহস্পতিবার তার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ৬৩ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও চলাফেরার ওপর বিধিনিষেধ তুলে নেওয়াসহ ৮৮টি সুপারিশ করা হয়ছে। এই তদন্ত কমিশন গঠনের সময় সু চি বলেছিলেন কমিশনের প্রতিবেদন মেনে নেবেন। কিন্তু গত অক্টোবরে রাখাইনে সেনাবাহিনীর দমন অভিযানের পর জাতিসংঘের তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন মানতে অস্বীকৃতি জানান তিনি।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো যে, রোহিঙ্গাদের দুর্দশা লাঘবের পথের প্রথম পদক্ষেপ নেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মাথায় জানানো হলো, রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে হামলা চালিয়েছে। এর জের ধরে সেনাবাহিনী রাখাইনে অভিযান চালাচ্ছে। আনান কমিশনের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করার জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সরকারের এটি কৌশল তা একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়। এর আগেও যখন রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানের জন্য মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ এসেছে তখনই হামলার অজুহাত তুলে রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়েছে সেনাবাহিনী।
গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে নতুন করে শুরু হওয়া সেনা অভিযান ও রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়ে এখনো মুখ খোলেননি সু চি। তবে অবাক করার বিষয় হচ্ছে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) কর্মীদের ‘সন্ত্রাসী’ বলে আখ্যা দিয়েছে সু চি’র কার্যালয়। স্টেট কাউন্সিলর দপ্তরের এই মন্তব্য এটাই ইঙ্গিত দেয় যে রোহিঙ্গাদের দমন অভিযানের পেছনে পুরোপুরি সমর্থন আছে ‘গণতন্ত্রপন্থি’ নেত্রীর।
বিবিসির সাংবাদিক জোনাহ ফিশার লিখেছিলেন, সু চিকে যখন মিয়ানমারের সামরিক শাসকরা রেঙ্গুনে গৃহবন্দী করে রেখেছিল, তখন তার সঙ্গে কথা বলার জন্য, তার সাহসী প্রতিরোধের কাহিনি তুলে ধরার জন্য অনেক সাংবাদিক জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন। তবে আং সান সু চি ক্ষমতায় যাওয়ার পর সবকিছু যেন বদলে গেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতোই তিনি এখন সাংবাদিকদের প্রচন্ড অপছন্দ করেন। রোহিঙ্গা নিয়ে সু চির অবস্থান দেখে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক, তাহলে কি সামরিক জান্তার মতোই সু চি রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে লুকোচুরি খেলছেন?
লেখক: সাংবাদিক।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ আগস্ট ২০১৭/শাহেদ/শাহনেওয়াজ
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন