ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডলদের মৃত্যু নাই

আরিফ রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০১, ২ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডলদের মৃত্যু নাই

কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডল

এক.

‘নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান

ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই...’

কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডল আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। খবরটা শুনেই আমার মাথায় এই পঙ্‌ক্তিগুলো এলো। কবিগুরু কি কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডলকে ভেবেই এটি লিখেছিলেন? আমি ভাবি আর আশ্চর্য হই! তারপর বুঝি, কমরেড জসিম মণ্ডল তো একা নন। শোষকশ্রেণীর বিরুদ্ধে যুগে যুগে কত শত জসিম মণ্ডল জীবন বিলিয়ে দিয়ে গেলেন। তবে হ্যাঁ, কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডলের ভেতর কি একটা যেন আলাদা জিনিস আছে। সেই কি একটা জিনিস হচ্ছে বাংলার মাটি-কাদা-ঘাম। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা, পাকিস্তান থেকে বাংলার স্বাধীনতা, বাংলার স্বাধীনতা থেকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, এমনকি নব্বইয়ের কোটা পার হয়ে  যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গড়ে ওঠা শাহবাগ আন্দোলনেও বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রেরণা জুগিয়েছেন। দাবি করেছেন জামাত-শিবির নিষিদ্ধকরণের।  শেষ জীবন পর্যন্ত ছাত্রদের প্রেরণা যুগিয়েছেন, সমাজ বদলের ডাক দিয়ে বলেছেন: ‘‘হুজুরের পানিপড়া দিয়ে, স্লোগান দিয়ে এই সমাজ এক চুলও পরিবর্তন করা যাবে না। শ্রমিকের রাজনীতি বুঝে, অঙ্ক করে জীবন বাজী রেখে লড়াই করে এই সমাজ ভাঙতে হবে। এবং ভাঙিতেই হবে।”


তিনি শুধু ভাঙার ডাক দিয়েই ক্ষান্ত হননি। অভয় বাণী শুনিয়েছেন। বলেছেন: ‘‘আমি কমিউনিস্ট পার্টি করেছি এবং এখনো করছি পেটের যন্ত্রণায়, ক্ষুধার তাড়নায়, বাঁচার জন্যে ও অন্যকে বাঁচাবার জন্যে। এই হাত দিয়ে ব্রিটিশকে গুলি করেছি, পাকিস্তানিদের মেরেছি, মুক্তিযুদ্ধ করেছি আজো আমি এই সমাজ ভাঙার জন্য কাজ করছি। তোমরা না ছাত্র! তোমরা না যুবক! তোমাদের ভয় কিসের?”


দুই.

কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডল রাজনীতি শুরু করেন একেবারে ছোট; দশ-এগারো বছর বয়সে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকায় প্রকাশিত দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকারে সবিস্তারে সেসব দিনের কথা বলেছেন নিজ মুখে: ‘‘কলকাতায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে ১০-১১ বছর বয়সে আমার কমিউনিস্ট জীবন শুরু। বাবার চাকরিসূত্রে তখন আমরা কলকাতায় নারিকেলডাঙা রেল কলোনিতে থাকতাম। বাবা রেলওয়ের টালি ক্লার্ক ছিলেন। কলোনির চারদিক ছোট প্রাচীর ঘেরা ছিল। বন্ধুবান্ধবরা সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রায়ই প্রাচীরের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে গল্পগুজব করতাম। তখন তো হিন্দু-মুসলমান প্রশ্ন ছিল না, সবাই অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। আমরা দেখতাম, মিছিল যাচ্ছে, মিছিলকারীরা নানা স্লোগান দিচ্ছে। স্লোগানগুলো ভালো লাগত। কমিউনিস্ট পার্টির মিছিল গেলে দেখতাম, ওদের স্লোগানগুলো অন্য পার্টির চেয়ে আলাদা। সেগুলো আরো ভালো লাগত। আমরা চার-পাঁচজন মিলে বলাবলি করতাম, চল তো মনুমেন্টের নিচে গিয়ে শুনি ওরা কী বলে? ওখানে ওরা আমাদের এ সমাজ ভাঙার কথা বলত।

কেন ভাঙতে হবে সে ব্যাখ্যা দিয়ে বলত, পৃথিবীতে দুটি শ্রেণি-একটি ধনী, অন্যটি গরিব। গরিবের সংখ্যাই বেশি। এরাই সব তৈরি করে; কিন্তু এদেরই খাবার জোটে না। আমি তো গরিব লোকের ছেলে, প্যান্টুলেনে তালি দিয়ে পরতে হয়। আমি বলতাম, কথাগুলো তো ঠিকই বলে। এদের রাজত্ব কবে হবে?”


জসিম মণ্ডল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন সৈনিক হিসেবে।  মুম্বাই, মাদ্রাজসহ বিভিন্ন বন্দর থেকে যেসব কামান, বারুদের গাড়ি আসত, সেগুলো ট্রেনে আসামে পৌঁছে দিতেন। ট্রেনের ইঞ্জিনের বয়লারে কয়লা ভরতেন। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত যুদ্ধে সব রকমের সাহায্য করেছেন।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করেছেন। ছিলেন কমরেড জ্যোতি বসুর ঘনিষ্ঠ সহচর। ১৯৪০-৪১ সালে কলকাতা থেকে ট্রেনে চেপে জ্যোতি বসু ঈশ্বরদী এসে দু'তিন দিন থেকে একে একে সান্তাহার, পার্বতীপুর, লালমনিরহাট প্রভৃতি এলাকায় রেল শ্রমিকদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। সে সময় শ্রমিকদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে তাকে এমএলএ প্রার্থী করা হলে জ্যোতি বসুর কাছে মুসলিম লীগের প্রার্থী হুমায়ুন কবির বিপুল ভোটে পরাজিত হন। জ্যোতি বসুর লাল ঝাণ্ডার পক্ষে মুসলিম লীগের কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে সে সময় জসিম মণ্ডলের মাথা ফেটে যায়।

তাদের দেখে কলোনির লোকেরা ঠাট্টা করতেন- ‘‘এরা বলে ব্রিটিশ খেদাবে! এরা বলে ধনী উচ্ছেদ করবে!" কিন্তু লাল ঝাণ্ডা যে সাচ্চা লোকদের পার্টি এটাও তারা বলতেন। তারা জানতেন, এই পার্টিতে এমন সব লোক আছেন, যা অন্য কোনো পার্টিতে নেই।


৪৭ সালে মা একদিন তাঁকে বলেছিলেন, ‘বাবা জসিম! পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করিস না। পাকিস্তান হলে আমরা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারব।’ এ সময় তিনি মাকে বলেন, ‘মা, পাকিস্তান ধনী লোকের জন্য, আমাদের জন্য না। আমি পাকিস্তানের পক্ষে থাকব না।’

সেইসব দিনের কথা স্মরণ করে তিনি পরবর্তী সময়ে বলেছেন: ‘‘...ওই সময়ে পাকিস্তান সরকার রেলশ্রমিকদের রেশনে খুদ (চালের ক্ষুদ্র অংশ) দিত। একদিন খুদ নিয়ে মাকে বললাম, ‘তোমার পাকিস্তান সরকার খাবার জন্য এগুলো দিয়েছে। এটাই পবিত্র চাল! মুসলমানদের চাল!' তখন মা পাকিস্তানের পতাকা বাড়ি থেকে নামিয়ে ঝাঁটা দিয়ে পতাকার ওপর কয়েকটি বাড়ি দিয়ে আমাকে বললেন, ‘এই খুদের বিরুদ্ধে আন্দোলন কর।’ ওই দিন থেকে আমি আর আমার মা পার্বতীপুরের রেল কলোনিতে যারা বাস করত তাদের নিয়ে সংগঠিত হতে থাকলাম।”


৪৯ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে গ্রেফতার হন জসিম মণ্ডল। জেলখানার ভেতরে নিম্নমানের খাবার দেয়া হয়। এ নিয়ে হাজতখানার ভেতরেই আন্দোলনে নামলেন। শাস্তি বেড়ে গেলো। এক মাস ঘানি টানার সাজা পেলেন। ঘানি টানার বিরুদ্ধে কথা বললে তাকে উলঙ্গ করে মাঘের শীতে ঠাণ্ডা পানির মধ্যে ডুবিয়ে রাখা হয়। তিনি এর স্মৃতিচারণ করে বলেছেন: ‘‘...জেলখানায় নিম্নমানের খাবার নিয়েও আন্দোলন শুরু করি। জেলখানায় আন্দোলনের ফলে এক মাস ঘানি টানার শাস্তি দেয় জেল কর্তৃপক্ষ। ঘানি টানার বিরুদ্ধে কথা বলা ও জেল কর্তৃপক্ষের বকাবকির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে আমাকে উলঙ্গ করে মাঘের শীতে ঠাণ্ডা পানির মধ্যে ডুবিয়ে রাখা হয়। খবর পেয়ে আমার স্ত্রী তৎকালীন জেলা প্রশাসককে অবহিত করলে তিনি জেল পরিদর্শনে এসে আমাকে উলঙ্গ দেখতে পান। এ সময় তিনি পোকাওয়ালা সেদ্ধ ছোলা খাবার দেওয়া, ঘানি টানাসহ সব বন্ধ করে দেন। ওই সময় থেকে আজ পর্যন্ত পাবনা কারাগারে আর কখনো ঘানি টানা হয়নি কয়েদিদের দিয়ে। আমার আন্দোলন সফল হয়।"


তিন.

কমরেড জসিম মণ্ডল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সপরিবারে অংশ নেন। তার বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় পাকবাহিনী। এ সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেছেন, ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ভারতের কলকাতা, দিল্লি, আগ্রা, শিয়ালদহসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে অর্থ, খাবার, পোশাকসহ বিভিন্ন সামগ্রী সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছেন।

জীবনে ১৭ বছর তিন কারাগারে কাটিয়েছেন। ব্রিটিশ আমলে ২ বছর, পাকিস্তান আমলে ১৩ বছর, স্বাধীনতার পর জিয়ার আমলে আরও ২ বছর। ছেচল্লিশের দাঙ্গায় তিনি বীরের ভূমিকা পালন করেছিলেন। খুদবিরোধী আন্দোলন করেছেন মায়ের সাথে। জেলখানায় ঘানি টানার বিরুদ্ধে লড়েছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খাপড়া ওয়ার্ডে জেলখানায় সাত কমিউনিস্টের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো জেল সুপার বিলের সঙ্গে করেছেন আপোষহীন আচরণ। তাঁর সারাটা জীবন আন্দোলনে কেটেছে। কোনদিন  ঢাকামুখী রাজনীতি করেননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন: ‘‘যে কথা আমরা ঢাকায় বলি, সেটি যদি গ্রামে না নিয়ে যাই, আমতলা, বাঁশতলা, কাঁঠালগাছের নিচে, হাটে, ঘাটে, মাঠে, গ্রামের মানুষের কাছে না নিয়ে যাই, তাহলে কীভাবে হবে? সে জন্য ঢাকায় আসতে চাইনি। আমার কথা হলো, পার্টিকে গ্রামে নিতে হবে।"


তিনি একটাই স্বপ্ন দেখেছেন- সমাজতন্ত্র। বিশ্বাস করতেন সমাজতন্ত্র হবেই। তার ভাষা ছিল সহজ ভাষা, মাটি আর মানুষের ভাষা, গরিবের ভাষা। নিজেই বলেছেন: ‘‘সিক্স পর্যন্ত পড়েছি। তবে মার্ক্সবাদ শুনে, পড়ে শিখেছি। তা ছাড়া মানুষের সঙ্গে মিশি। আমার বক্তৃতা গরিবরা বেশি শোনে। কারণ গরিব যে ভাষায় শুনতে চায়, সেই ভাষা আমি জানি। ওই জীবনযাপন করি, ওভাবে চলাফেরা করি।”

কমরেড জসিম মণ্ডলের সেই ভাষা ছিল বড় পরিষ্কার। আজকালের কঠিন ভাষায় মার্ক্স কপচানো বামপন্থীদের ভাষায় তিনি কথা বলতেন না। তার বক্তব্য ছিল সহজ কিন্তু জোরালো, বোধগম্য এবং একই সাথে যুক্তিযুক্ত। তিনি বলেছেন: ‘‘আমি তৈরি করবো কাটারীভোগ চাল। আমি সেই ধান বুনবো। সেই ধান নিড়াবো। সেই ধান কাটবো। বাড়িতে নিয়ে এসে সেই ধান মাড়াই করবো। সেই ধান আমার বউ সিদ্ধ করবে, শুকাবে। ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে চাল বের করবে। গন্ধে ঘর ভরে যায়। সেই চাল আমার ছেলে খেতে পাবে না। সেই চাল আমার মেয়ে খেতে পাবে না। সেই চাল বাড়িঅলা খেতে পাবে না। সেই চাল খাবে কিডা? আল্লাহ্ যার কপালে রেখেছে। কার কপালে রেখেছে? গুলশানে যে থাকে। ধানমন্ডিতে যে থাকে। বনানীতে যে থাকে। জমিদারের পুলা যে। জমিদারের মেয়ে যে। জোতদারের মেয়ে যে। তারাই খাবে কাটারী ভোগ। তৈরি করবো আমি, আর খাবে সে। আপনাদের কাছে আমি বলি- এই সমাজ মানি না। এই সমাজ ভাঙতে হবে, সমাজতন্ত্র গড়তে হবে।’’


তাঁর ভাষণে, তাঁর আলোচনায়, তাঁর সাক্ষাৎকারে বারবার উঠে এসেছে এই সমাজকে ভেঙে সাম্যের সমাজ গড়ার ডাক। তিনি বারবার বলেছেন: ‘গরিবরা চুরি করে না, তারা পরিশ্রম করে উপার্জন করে। চুরি করে শালার বড়লোকেরা। এই অঙ্ক বুঝিতেই হইবে। এই সমাজ পঁচা গলা। এ সমাজ ভাঙিতেই হইবে।’

* ২৫ আগস্ট ২০১৭, দৈনিক ‘কালের কন্ঠ’ প্রকাশিত কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডলের সাক্ষাৎকার


 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ অক্টোবর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়