এভ্রিলকে আমরা কেন মেনে নিতে পারছি না?
রেজাউল করিম: বিবাহিতা, তালাকপ্রাপ্ত, কৃষকের মেয়ে কিংবা তথ্য লুকানোর অভিযোগে সবাই নানাভাবে জান্নাতুল নাঈম এভ্রিলকে ঘায়েল করছেন। তার সমালোচনা করছেন। কিন্তু একটি বাল্য বিয়ের শিকার কৃষকের মেয়ে শহরে এসে একাকী সংগ্রাম করে নিজেকে যেভাবে বদলে নিলো; যেভাবে সে ঘুড়ে দাঁড়িয়ে পুনরায় পড়াশোনা শুরু করলো, যেভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখলো সে কথা কেউ বলছেন না।
সম্প্রতি আমাদের দেশে অনুষ্ঠিত এক সুন্দরী প্রতিযোগিতায় জান্নাতুল নাঈম এভ্রিল ২৫ হাজার প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে জয়ী হয়েছেন। যদিও এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তারপরও সেরা ১০ জনের মধ্যে সে আসতে পেরেছে এটা কম নয়। তার এই অর্জনের জন্যও আমরা তাকে সাধুবাদ জানাচ্ছি না। আমরা সবাই নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলি। আবার কোনভাবে সংগ্রাম করে একজন নারী যোগ্য এবং ক্ষমতাবান হয়ে উঠলে তার নেতিবাচক দিক কিংবা তার অতীত নিয়ে কথা বলি যাতে সে আর সামনে এগুতে না পারে।
এভ্রিলকে আমি চিনি ঠিক এক বছর আগে থেকে। তখন সে চট্টগ্রাম শহরে থাকে একজন নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে। হ্যামার স্ট্রেংথ জিম-এ তার শরীর চর্চা এবং মিস হ্যামার স্ট্রেংথ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের কারণে তাকে কাছ থেকে দেখা ও জানার সুযোগ হয়েছিলো। আমরা তার বিয়ের কথা জানতাম। আমরা জানতাম সেই বিয়ে ছিল মাত্র তিনমাসের এবং একটি ঠুনকো সম্পর্ক। কিন্তু এরপরও সে অতীত ভুলে যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, এজন্য তার যে যুদ্ধ, তার ভেতরের এগিয়ে যাওয়ার স্পৃহা, সংগ্রামী মনোভাব সবকিছুই তখন থেকেই স্পষ্ট ছিলো। যে কারণে তার তিন মাসের ওই অতীত নিয়ে কেউ আলোচনা করেনি।
এই এভ্রিলই যখন দিনের পর দিন সংগ্রাম করে, সকল প্রতিকুলতার সাথে যুদ্ধ করে নিজেকে প্রস্তুত করেছে। যখন সে আলো ঝলমলে মঞ্চে একজন রীতিমত তারকা বনে গেলো ঠিক তখন আমরা সবাই মিলে তার অতীত নিয়ে টানাহেঁচরা শুরু করে দিলাম। অর্থাৎ মূল বিষয়টা দাঁড়াচ্ছে প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষকের মেয়েটা কেন এগিয়ে যাবে? তাকে টেনে নামিয়ে ফেলতে হবে- এটাই যেন মূল বক্তব্য ও মানসিকতা।
ধরে নিলাম আমেনা শহরে এসে এভ্রিল হয়েছে। হ্যাঁ হয়েছে। তাতে কী? সে নিজের চেষ্টায় এভ্রিল হয়েছে। তাকে কেউ এভ্রিল বানিয়ে দেয়নি। শহরের হাজার হাজার তরুণীর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে সেরা ১০ জনের মধ্যে চলে আসাটাই তার এভ্রিল হওয়ার স্বার্থকতা প্রকাশ করেছে।
সবাই বলবেন সুন্দরী প্রতিযোগিতার নিয়ম ভেঙে নিজেকে অবিবাহিত উল্লেখ করে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে সে। এটা সত্যি এভ্রিল তা করেছে। কিন্তু মাত্র তিন মাসের বাল্য বিয়েটিকে এভ্রিল মনে রাখেনি। সুন্দরী প্রতিযোগিতার ফর্মে লিখা ছিলো- বিবাহিত নাকি অবিবাহিত। এভ্রিল সেখানে কি লিখবে? এখন তো সে বিবাহিত নয়। তাই স্বাভাবিক কারণেই সে অবিবাহিত লিখেছে।
ধরে নিলাম এতেও এভ্রিল প্রতারণা করেছে। সব কিছু মিলিয়ে এভ্রিল সেরা ১০ জনের একজন হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিযোগিতার ফলাফলে প্রতিযোগিতার আয়োজক বিচারকদের রায় উপেক্ষা করে এভ্রিলকে বিজয়ী ঘোষণা করে। আয়োজকরা এই ধরনের প্রতারণার মাধ্যমে এভ্রিলকে সামনে নিয়ে এসে তার চূড়ান্ত অপমান করেছে- এই কথাটি কেউ বলছেন না। আজ যদি এভ্রিল সেরা ১০ জনের একজন হয়েও থাকতো, তবুও সে ঢাকা শহরে একজন তারকা হয়েই থাকতো। তার অতীত নিয়ে কেউ ঘাঁটাঘাটি করতো না।
আজ বিবাহিত তথ্য গোপনের অভিযোগে এভ্রিলের মুকুট কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। খেতাব বাতিল করা হচ্ছে। ঠিক আছে একদিক থেকে এটা হয়তো যৌক্তিক। কিন্তু যে আয়োজক সংস্থা বিচারকদের রায় অমান্য করে তাদের নিজেদের পছন্দের সুন্দরীকে বিজয়ী করেছিলো তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তারা যেন ভবিষ্যতে এই ধরনের প্রতারণামূলক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে না পারে- সেটাই হবে ন্যায়।
লেখক: সাংবাদিক
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ অক্টোবর ২০১৭/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন