ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীল অনুশীলনমূলক সহায়ক বই

প্রফেসর ড. মো. সদরুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:২০, ৭ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীল অনুশীলনমূলক সহায়ক বই

প্রফেসর ড. মো. সদরুল আমিন : জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর সুপারিশের আলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক শিক্ষা আইন প্রবর্তনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা শিক্ষাক্ষেত্রে একটি মৌলিক ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। দেশে স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে বেশ কয়েকটি শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বা শিক্ষানীতি প্রবর্তিত হয়েছে; তবে ২০১০-এর শিক্ষানীতির পূর্বের কোনো শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বা শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন বা শিক্ষানীতিভুক্ত বিষয়গুলো আইনগত ভিত্তি দেওয়ার কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। এ প্রেক্ষাপটে সরকারের শিক্ষা আইন প্রবর্তনের উদ্যোগ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে প্রশংসার দাবিদার।


প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন ২০১৭-এর খসড়ায় ধারা ২-এর উপধারা ১১, ধারা ১৪-এর উপধারা ১ ও ২ এবং ধারা ৪৭-এর তফসিল ১ এর ‘খ’-এ নোট বই বা গাইড বইয়ের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে তা প্রকাশের বিরুদ্ধে আইন প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষাসহায়ক হিসেবে সৃজনশীল অনুশীলনমূলক বইয়ের সংজ্ঞা ও প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে কোনো আইন প্রস্তাবিত হয়নি। শিক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।

 

সংগত কারণে প্রশ্ন হতে পারে সৃজনশীল অনুশীলনমূলক সহায়ক বই বলতে আমরা কী বুঝি? বাস্তবতার নিরিখে বলতে হয়, ‘যেসব বই কোনো নির্দিষ্ট তথ্যের জন্য বিভিন্ন সময়ে নির্দেশক বা পরামর্শক হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে রচিত হয় সেগুলোকে সহায়ক বা নির্দেশক গ্রন্থ বলে। ব্যাপকভাবে বললে, যে বইয়ের কোনো তথ্য এতটাই পূর্ণাঙ্গ বা সুশৃঙ্খল যে তা তৎক্ষণাৎ সহজবোধ্য হয়ে ওঠে সে বইকে সহায়ক বই বলা যেতে পারে।’

 

তাহলে আমরা দেখে নেই কী কী বৈশিষ্ট্য থাকলে তাকে আমরা ‘সহায়ক বই’ বলতে পারি। বিন্যাস ও ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে একটি সহায়ক বইয়ের নকশা করা হয় যাতে বইটি বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখে। নিচে সহায়ক বইয়ের কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো-

* এটি প্রাথমিকভাবে বিশেষ বিশেষ পরামর্শের জন্য রচিত।

* নির্দিষ্ট তথ্যের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত।

* এটি তথ্য ও ঘটনার সামগ্রিক রূপ।

* তথ্যের বিন্যাস কাঠামো ধারাবাহিক ও সুশৃঙ্খল বিধায় শিক্ষার্থীর জন্য সহজবোধ্য ও দ্রুত স্মরণীয়।

* এতে প্রকৃত ঘটনার ওপর ফোকাস করা হয়।

* জ্ঞানান্বষণে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখে।

* কোনো দুর্বোধ্য বিষয়কে সহজ-সরলভাবে বিশ্লেষণ করে সহজবোধ্য করে তোলে।


সহায়ক বইয়ের বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, কোনো একটি পাঠক্রম বা বিষয়কে সহজ-সরল ও প্রাণবন্তভাবে ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ করে পর্যাপ্ত পরিমাণে তথ্যের সমাবেশ ঘটিয়ে পাঠক্রমটির একটি সামগ্রিক রূপ দেয় সহায়ক বই। ফলে সহায়ক বইটি অনুশীলন করলে শিক্ষার্থী সহজেই তার পাঠ্য বইয়ের পঠিত বিষয়টি সহজে আত্মস্থ করতে পারে। তাই সহায়ক বই শিক্ষার্থীর পাঠ্যপুস্তক পাঠকে কখনো বাধাগ্রস্থ করে না; উপরন্তু উৎসাহ দেয়।

ড. সীনা আক্তার যুক্তরাজ্যে কর্মরত সমাজবিদ। তিনি শিশুর জ্ঞানের বিকাশে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বই পড়ার কথাও বলেছেন। তিনি তাঁর ‘পাঠ্যবই ও মানসম্মত শিক্ষা’ নিবন্ধে লিখেছেন: ‘মানসম্পন্ন শিক্ষায় পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই পড়ার সুযোগ, বইয়ের বিষয়বস্তু এবং শিক্ষাদান পদ্ধতি (teaching methods) অধিক গুরুত্বপূর্ণ। স্বভাবগতভাবেই শিশুরা কৌতূহলী, সেজন্য তাদের জ্ঞানার্জনকে গণ্ডির ভেতর নিয়ে আসা উচিত নয় বরং জ্ঞানের দরজা উন্মুক্ত  করে দেওয়া দরকার। আমাদের দেশে অধিকাংশ অভিভাবকের বাড়তি বই কেনার সামর্থ্য নেই। তাছাড়া অধিকাংশ অভিভাবক পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই পড়াকে মূল্যহীন হিসেবেই দেখেন। ফলে শিশুদের নিজ পাঠ্য বইয়ের বাইরে জানার-শেখার-কল্পনা করার সক্ষমতা তৈরি হয় না। নির্দিষ্ট কিছু পাঠ্যবই পড়ে, মুখস্থ করে এবং পরীক্ষার খাতায় লিখে হয়তো ভালো ফল করা যায় কিন্তু তা জ্ঞানের মহাসাগরে অতি ক্ষুদ্র ঢিলের সমতুল্য।’


‘অনুশীলনমূলক বই’ বলতে পাঠ্য বইয়ের সহায়ক বই বোঝানো হয়ে থাকে। পাঠ্যবইয়ের এই সহায়ক বইগুলো আমাদের দেশে অনুশীলন বই বা প্র্যাকটিস বুক নামেও পরিচিত। একসময় নোট-গাইড থাকলেও সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর পর ওই ধরনের বইয়ের প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে। এখন যেসব বই বাজারে রয়েছে সেগুলো সৃজনশীল অনুশীলন বই এবং এ ধরনের বই Oxford, Cambridge, Pearson-সহ বিশ্বের নামিদামি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান প্রকাশ করে থাকে।

সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন ও উত্তর Text এবং Context উপর ভিত্তি করে হয়ে থাকে। Text পাঠ্যবইয়ে দেওয়া থাকে। এই Text থেকে শিখনফলের আলোকে বিস্তৃত Context থেকে একজন শিক্ষার্থী সম্ভাব্য যত বেশি প্রশ্ন ও উত্তর অনুশীলন করবে তত বেশি সে সমৃদ্ধ হবে এবং শিখন দক্ষতা অর্জন করবে। আমাদের সৃজনশীল অনুশীলনমূলক বইগুলো দেশি-বিদেশি সাম্প্রতিক তথ্য এবং পত্র-পত্রিকা ও জার্নাল থেকে Context সংগ্রহ করে নমুনা প্রশ্ন ও নমুনা উত্তর আকারে সন্নিবেশিত করে দেওয়া হয়। এর ফলে শিক্ষার্থীরা উন্নতমানের প্রশ্ন ও উত্তরের নমুনা পায় এবং সে আলোকে নিজে নিজে উত্তর করার দক্ষতা অর্জন করতে পারে। আর এই অভিপ্রায় নিয়েই এ সকল সৃজনশীল অনুশীলনমূলক বইগুলো প্রকাশিত হচ্ছে।


অনুশীলনীমূলক সহায়ক বই পড়ে না, এমন শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মেধাবী ও ভালো রেজাল্ট করা শিক্ষার্থীদের টেবিলেও এ ধরনের বই থাকে, এমনকি এক বিষয়ে একাধিক অনুশীলনমূলক বই থাকে। শিক্ষার্থীরা আসলে অনুশীলন বই মুখস্থ করে না, এটা মুখস্থ করে লাভও নেই। তারা ওই সব বই থেকে পরীক্ষায় উত্তর দেওয়ার জন্য ধারণা নিয়ে নিজেদের দক্ষতা বাড়ায়। অনেক ক্ষেত্রে কোচিং সেন্টারে যাওয়ার হাত থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করে এ ধরনের অনুশীলনমূলক সহায়ক বই।

অনলাইনের যুগে কোনও তথ্যই এখন অজানা বা গোপনীয় নয়। সার্চ ইঞ্জিন গুগুলে এ সংক্রান্ত তথ্য চাইলে পাওয়া যায়। বিশ্বের একেক দেশে একেক নামে এরকম সহায়ক বা অনুশীলন বই চালু রয়েছে। এগুলো Preparation guide, High School Placement Test Study Guide, Higher-secondary-exa-preparation-guide, Practice Planning and Programming exam (PPP) guide, Question bank with model test papers, Final preparation model test Gate 2016 mock/model test papers, Secrets study guide; Your key to success practice & prepare for 11+ success, Study guide, Preparation tips, Solved papers. প্রভৃতি নামে পরিচিত। ওইসব দেশ এগুলোর অনুমোদন নিয়ে মাথা ঘামায় না। গুণ, মান ও চাহিদা অনুযায়ী এগুলো প্রকাশিত হয় এবং বাস্তব চাহিদা অনুযায়ী ব্যবহৃত হয়। নিচে সারা পৃথিবীতে এ ধরনের বই প্রকাশে উল্লেখযোগ্য Web page  দেওয়া হলো।

1.Please search Google by ‘Cambridge Learner Guide’ and click ‘[PDF] Cambridge Learner Guide for IGCSE Biology’

2.Please search Google by ‘Cambridge Learner Guide’ and click ‘[PDF] Cambridge Learner Guide for O Level Chemistry’

3.Please search Google by ‘Cambridge Learner Guide’ and click ‘[PDF] Cambridge Learner Guide for AS and A Level Mathematics’

4.Please search Google by ‘Cambridge Learner Guide’ and click ‘[PDF] Cambridge Learner Guide for IGCSE Physics’

5.Please search Google by ‘Cambridge Learner Guide’ and click ‘[PDF] Cambridge IGCSE Economics Learner Guide’

6.Please search Google by ‘Cambridge Learner Guide’ and click ‘[PDF] First Language English Learner Guide-Cambridge’

7.Click on-[PDF]Mathematics IGCSE notes Index 1. Decimals and standard ..

8.[PDF]Mathematics Revision Guide - Cambridge University Press

9.Google search on Ôigcse edexcel maths revision notes pdf

10.Google search on edexcel igcse chemistry revision notes

11.Google search on Ô8th std maths book english medium’

12.8th standard textbooks free download - tnschools.co.in

 

আমাদের পাঠ্যবইয়ে অনুশীলনীর সংখ্যা পর্যাপ্ত থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে বেশি অনুশীলনী দেওয়া সম্ভবও হয় না। শিক্ষার্থী এই ঘাটতি পুষিয়ে নেয় এসব সৃজনশীল অনুশীলনমূলক সহায়ক বই দেখে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এ ধরনের সহায়ক বইয়ের প্রয়োজনীয়তা আদৌ আছে কি না? কিন্তু যদি পাল্টা প্রশ্ন করা হয়, দরকার বা চাহিদা না থাকলে এসব বই কেনাবেচা হয় কেন? আসলে সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সমস্যার গভীরে কখনো যায়নি। এই সহায়ক বইয়ের কেন প্রয়োজন, সেটি খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, অনুশীলনমূলক বই শিক্ষার্থীদের জন্য অনিবার্য। এর মূল কারণ উন্নতমানের টেক্সট বইয়ের অভাব এবং শ্রেণিকক্ষে পর্যাপ্ত লেখাপড়া না হওয়া। এখন কোনো শিক্ষার্থী যদি তার লেখাপড়ার ঘাটতি পুষিয়ে নিতে অনুশীলনমূলক সহায়ক বই পড়ে বা অভিভাবক যদি তার সন্তানকে এমন বই কিনে দেয়, তাহলে তা আইন করে বন্ধ করার যৌক্তিকতা থাকতে পারে না।

আমাদের দেশে সহায়ক বইয়ের মান নিয়ে কারো কারো মধ্যে হয়তো প্রশ্ন থেকে থাকবে। সেটি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এসব সহায়ক বইয়ের মান কীভাবে বাড়ানো যায়, সেই চেষ্টা চলতে পারে। কিন্তু এটা বন্ধ করলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ই ক্ষতিগ্রস্থ হবে। ধস নামবে প্রকাশনাসহ এবং সংশ্লিষ্ট শিল্পে।

সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতিতে অনুশীলনমূলক সহায়ক বইয়ের ভূমিকা


শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরনের গুণগত পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশে ২০০৮ সাল থেকে শুরু হয় সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠদান কার্যক্রম, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মুখস্থনির্ভর লেখাপড়া থেকে মুক্তি পাওয়ার কথা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই পদ্ধতি কাঠামোবদ্ধ পদ্ধতি নামে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর  মেধার মাপকাঠি হবে তাঁর সৃজনশীলতা। সারা পৃথিবীর ছেলেমেয়েরা যে পদ্ধতিতে (Bloom's Taxonomy) লেখাপড়া করে, আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরাও সেই পদ্ধতিতে লেখাপড়া করার এবং পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পায়। এসব দেশে এ ধরনের অনুশীলনমূলক সহায়ক বই শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের পাঠ দানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশে ২০১০ সালের এসএসসি পরীক্ষায় বাংলা ও ধর্ম শিক্ষা বিষয়ে প্রথমবারের মতো সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়। এর প্রধান লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীদের মেধাকে সৃজনশীলতার মাধ্যমে জাগিয়ে তোলা। মূল বইয়ের গল্পের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে একটি ছায়া গল্প তৈরি করা। সেই গল্প অবলম্বনে চার ধরনের প্রশ্ন থাকে; জ্ঞানমূলক, অনুধাবন, প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতা। ক্রমান্বয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে শুরু করে এইচএসসি পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে এই সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়। প্রাথমিক স্তরে সৃজনশীলের আদলে চালু করা হয় যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্ন। সরকারের প্রবর্তিত ও সৃজনশীল পদ্ধতি বাংলাদেশে সফলভাবে বাস্তবায়নে এই অনুশীলনমূলক সহায়ক বইগুলো রেখেছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বলা যায়, এ বইগুলোর প্রকাশ না হলে সৃজনশীলন পদ্ধতি এতটা সফলতার মুখ দেখতো না। সৃজনশীলের সুফল ঘরে তুলছে অনুশীলনমূলক সহায়ক বই

সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিতে পরীক্ষা চালু হওয়ার পর প্রশ্ন কাঠামো এমন হয়েছে যে তা নিয়ে একজন শিক্ষক বা শিক্ষার্থীকে প্রচুর পড়তে হয়, ভাবতে হয়, চিন্তা করতে হয়। কেননা তাকে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে গিয়ে নতুন পরিস্থিতিতে উদ্দীপক, প্রশ্ন ও উত্তর করতে হবে এবং সে পরিস্থিতি আবার পাঠ অংশের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে।


সৃজনশীল রচনামূলক ও বহুনির্বাচনি উভয় ক্ষেত্রেই চিন্তন দক্ষতার চারটি স্তর তথা জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতা যাচাইয়ের সুযোগ রয়েছে।

সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিতে মুখস্থের কোনো জায়গা নেই। শিক্ষার্থীকে কেবল তার পাঠ্যবইটি মন দিয়ে ভালো করে বুঝে বুঝে পড়তে হবে, মনের আনন্দে বারবার শুধু পড়ে যেতে হবে। এটুকু করলেই যেকোনো শিক্ষার্থী পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারবে।

সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে জনৈক শিক্ষক উম্মে কুলসুম বেবী একটি ছোটখাটো জরিপ করেছেন। এর আলোকে তিনি লিখেছেন:

‘‘অনেকটা কৌতূহল নিয়েই ছোট একটি জরিপ করলাম শিক্ষার্থীদের মধ্যে। প্রশ্ন করেছিলাম, তোমাদের সরকার ফ্রি বই দিচ্ছে। তা হলে এত চড়া দাম দিয়ে বই কিনছ কেন? ওদের সাদামাটা উত্তর ছিল- সৃজনশীল প্রশ্নের জন্য। আমি আঁতকে উঠলাম। আবার প্রশ্ন করলাম, সৃজনশীল প্রশ্নের জন্য- এর মানে কী? সেই সাদামাটা উত্তর- ক্লাসে ঠিকমতো বুঝি না, তাই গাইড বই কিনি। ক্লাসে তোমাদের শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন বুঝিয়ে দেন না? আবার ওরা চুপ করে থাকল। এতটুকু সৌজন্য তো ওদের শিক্ষকদের বেলায় দেখাতে পারেই। আসলে এখানেই চুপ হয়ে থাকল ওদের মেধা ও সৃজনশীলতা। দেখলাম গাছের মূলেই সমস্যা। আর দুর্বল মূল থেকে শক্ত গাছ বা সুস্বাদু ফল ভোগ করার আশা করাটাও উচিত নয়।’’ (সৃজনশীল পদ্ধতির সুফল পেতে হলে, উম্মে কুলসুম বেবী, ১৭ নভেম্বর ২০১৩, দৈনিক সমকাল)

উম্মে কুলসুমের ওই লেখা থেকে দেখা যায়, সৃজনশীল পদ্ধতি শুরুতেই হোঁচট খায় এটা অপরিচিত নতুন এবং কিছুটা দুর্বোধ্য হওয়ার কারণে। বিশেষ করে শিক্ষকদের বেশির ভাগই এ পদ্ধিতিটি রপ্ত করার আগেই তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। ফলে প্রশ্নপদ্ধতি সম্পর্কে জানা, বোঝা ও চর্চার ক্ষেত্রে বড় ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি হয়। এ কারণে চালু হয় অনুশীলন বই এবং এ ধরনের বই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চালু রয়েছে। এটা কোনোভাবেই নোট বা গাইডের সমার্থক নয়। এ ধরনের সহায়ক বই থেকে প্রশ্ন কমন পড়ারও কথা নয়।

গতানুগতিক পরীক্ষাপদ্ধতিতে প্রশ্ন করা হতো সীমিত কিছু প্রশ্নের ভেতর থেকে। তাই শিক্ষার্থীরা মুখস্থ করতো হাতে গোনা কিছু প্রশ্ন। ফলে, পাঠ্যবইয়ের একটা বিরাট অংশ তাদের জ্ঞানের বাইরে থেকে যেত।

অন্যদিকে সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের কোনো কিছুই মুখস্থ করতে হয় না, কিন্তু পড়তে হয় পুরো পাঠ্যবইটি। কেননা, এই পদ্ধতিতে প্রশ্ন করা হয় গোটা পাঠ্যবইয়ের সবখান থেকে। তা ছাড়া এই পদ্ধতিতে সব সময় পরীক্ষায় আসে নতুন নতুন প্রশ্ন। ফলে, প্রশ্ন  কমন পড়ার কোনো আশা এখানে নেই। তাই শিক্ষার্থীদের আগের মতো অল্প কিছু প্রশ্ন পড়লে আর চলে না, গোটা বইয়ের প্রতিটি অধ্যায় বুঝে বুঝে বারবার পড়তে হয়। এত তাদের জ্ঞানের পরিধি  আগের শিক্ষার্থীদের তুলনায় অনেক বেড়ে যায়।


অনুশীলনমূলক বই থেকে প্রশ্ন : শিক্ষকের যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ‘সৃজনশীল প্রশ্ন কী কেন এবং কেমন?’ প্রবন্ধে সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন কেমন হবে সে বিষয়ে লিখেছেন:

‘গোটা ছাত্রজীবন ধরে প্রতিটি পরীক্ষায় তাদের এমন সব প্রশ্ন করে যাওয়া যার উত্তর মুখস্থ করে তারা দিতে পারবে না। দিতে হবে ভেবে, চিন্তা করে, বুদ্ধি, মেধা আর কল্পনাশক্তিকে পরিপূর্ণ আর জাগ্রতভাবে ব্যবহার করে। এতে তাদের বুদ্ধির চর্চা বাড়বে, মন সক্রিয় হবে। নোট বা পাঠ্যবই মেধাহীনভাবে মুখস্থ না করে নিজেদের বোধ আর চিন্তাশক্তি দিয়ে তারা জীবন ও জ্ঞানের সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবে।’ অন্যত্র বলেছেন, ‘পরীক্ষায় প্রশ্ন কমন পড়ার যুগ এখন শেষ। আগামী ৫০০ বছরেও পরীক্ষায় কোনো প্রশ্ন আর কমন পড়বে না।’

প্রফেসর ফাহিমা খাতুন শিক্ষক প্রশিক্ষণ ম্যানুয়েলের মুখবন্ধে লিখেছেন: ‘শিক্ষার্থীদের কেবল পাঠ্য বইয়ের তথ্য স্মরণ রাখলে চলবে না। তাকে সেই তথ্য বুঝতে হবে, নতুন কোনো পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করতে হবে এবং বিচার বিশ্লেষণ করে প্রশ্নের উত্তরের যৌক্তিকতা বুঝতে হবে।’

তাই বলা যায়, পিএসসি, এসএসসি কিংবা এইচএসসির প্রশ্নগুলো কখনোই কোনো গাইড বই থেকে আসবে না। পরীক্ষার আগে  প্রশ্নগুলো প্রথমবার তৈরি করা হবে। কাজেই যারা গাইড বই মুখস্থ করবে সত্যিকারের পরীক্ষায় তাদের কোনোই লাভ হবে না। বরং উল্টো ব্যাপার ঘটবে, মুখস্থ করে করে পরীক্ষা দেওয়ার কারণে তারা আসল পরীক্ষাগুলোতে নিজে নিজে ভাবনা চিন্তা করে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাবে।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল লিখেছেন: ‘এসএসসি পরীক্ষায় গাইড বই থেকে নেওয়া প্রশ্ন দেখে আমি ক্ষুব্ধ হয়েছি। কিন্তু ইংরেজিতে লেখা পদার্থ বিজ্ঞানের প্রশ্নপত্র দেখে লজ্জায় আমার মাথা কাটা গিয়েছে। একটি এত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় ইংরেজি ভাষার এই নমুনা দেখেও আমার বিশ্বাস হতে চায় না, কেমন করে শিক্ষাবোর্ড শিক্ষার্থীদের হাতে এই প্রশ্ন তুলে দিল? প্রত্যেকটি প্রশ্ন ভুল ইংরেজিতে লেখা, ছোটখাটো ভুল নয় উৎকট ভুল।’


সৃজনশীল পরীক্ষাপদ্ধতিতে মুখস্থবিদ্যার সুযোগ নেই, কোনো প্রশ্নের পুনরাবৃত্তিও হয় না। তাই গত বছরের প্রশ্ন কিংবা কোনো শিক্ষক বা কোচিং সেন্টারের সাজেশন থেকে প্রশ্ন কমন পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। শিক্ষার্থীকে প্রশ্নের উত্তর করতে হয় পাঠের মূল বিষয়বস্তু ও তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বুঝে। কিন্তু ২০১৫ সালের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ইংরেজি বিষয়ে পরপর দুবছর একই অনুশীলনীর প্রশ্ন এসেছে।

এবার দেখা যাক, শিক্ষার্থীরা অনুশীলন বইয়ের ওপর কতটা নির্ভরশীল। গত বছর সমাপনী পরীক্ষার প্রস্তুতির সহায়ক হিসেবে ৯৬.৪ শতাংশ পরীক্ষার্থী গাইড বই, সাজেশন বা হাতে তৈরি নোট কিনেছে। এ কাজে তারা গড়ে ৫৯৪ টাকা খরচ করেছে। এই খরচ পঞ্চম শ্রেণির মোট শিক্ষা ব্যয়ের ৭.২ শতাংশ এবং সমাপনী পরীক্ষা সংক্রান্ত ব্যায়ের ১৫ শতাংশ । (এডুকেশন ওয়াচ ২০১৪, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা কোন পথে? একটি নিরীক্ষা, সারসংক্ষেপ ২৫)

ওই গবেষণা ও জরিপের আলোকেও প্রশ্ন তোলা যায়, যে পরীক্ষায় ৯৬.৪ শতাংশ পরীক্ষার্থী সহায়ক বইয়ের সহায়তা নেয়, সেটিকে অবজ্ঞা করা ঠিক কি না। বাস্তব আরেকটি তথ্য, বাইরে থেকে প্রশ্ন কিনেও পরীক্ষা নেয় অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পাবলিক পরীক্ষা তো দূরের কথা, স্কুল-কলেজের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায়ও গাইড বা অনুশীলন বই থেকে প্রশ্ন না করার ব্যাপারে দুই দফায় সরকারি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। ওই নির্দেশনা উপেক্ষা করলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের এমপিও (বেতনের সরকারি অংশ) বাতিল করার কথাও বলা হয়েছে। বাইরে থেকে প্রশ্ন না কেনার ব্যাপারেও নির্দেশনা আছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের।

শিক্ষা বোর্ড বলছে, প্রশ্ন প্রণয়নকারী শিক্ষককে খুঁজে বের করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু কেবল দায়ী শিক্ষককে শাস্তির আওতায় এনে এ সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয় না।

সৃজনশীল পদ্ধতিতে নিজে প্রশ্ন তৈরি করার যোগ্যতা অর্জনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এর পরও দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষক এখনো সৃজনশীল পদ্ধতি আয়ত্ত করতে পারেননি। (সমকাল, ২০ মার্চ ২০১৫)

অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, বাজার অথবা গাইড থেকে নমুনা প্রশ্ন নিয়ে পাবলিক কিংবা স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় প্রশ্ন করা যাবে না। (শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন, ২০১২)

‘সৃজনশীল পদ্ধতির ওপর যে ধরনের প্রশিক্ষণ দরকার, তা নিশ্চিত করা না গেলে শিক্ষকদের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি আশা করাও বৃথা। স্বয়ং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) এক জরিপে উঠে এসেছে, মোট শিক্ষকের ৩৭ শতাংশই এ পদ্ধতিতে প্রশ্ন করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি। প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যাটা আরও বেশি। (মোহসিনা হোসাইন: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, ২ এপ্রিল ২০১৫, প্রথম আলো)

একই প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন: ‘এ কথা অস্বীকার করার কায়দা নেই, সৃজনশীল গাইড বই বাজারে থাকার কারণ হচ্ছে চাহিদা আর  এই চাহিদার পেছনের বড় কারণ, শিক্ষকদের দক্ষতার ঘাটতি। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকেরা যে পাঠদান করছেন, তাতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা আস্থা রাখতে পারছেন না।’

ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ওই শিক্ষক লিখেছেন, ক্লাসে শিক্ষকেরা যা পড়ান, তা অনেকেই ঠিকমতো বুঝতে পারে না। নমুনা প্রশ্ন মডেল টেস্টের জন্যও অনেকে দ্বারস্থ হয় সহায়ক বইয়ের।


সৃজনশীল পদ্ধতি বাস্তবায়নে প্রশিক্ষণের বিষয়টি বারবার বলা হলেও কার্যত এটি সেভাবে হয়নি। এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষককে একযোগে প্রশিক্ষণ দেওয়া অনেকটা অসম্ভব। তাই জোড়াতালি দিয়ে দু-চারদিনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বেশির ভাগ শিক্ষককে যোগ্য করে তোলা যায়নি। তা ছাড়া রাজনৈতিক প্রভাবে বা ডোনেশনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের অনেকের সাধারণ যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়েই ঘাটতি আছে।

‘শিশুকে জোর করে ভাত খাওয়ানোর মতো করে যেন সৃজনশীলতা নামক ট্যাবলেট গিলিয়ে দেওয়ার প্রবণতা তৈরি না হয়। এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণেরও দরকার রয়েছে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও দিক-নির্দেশনা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। আর প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর দায় শিক্ষকের। উভয় পক্ষের জবাবদিহিও নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন-কাঠামোর ব্যবস্থাপনায়।” (ড ফজলুল হক সৈকত, সমকাল, ১৭ নভেম্বর ২০১৩)

রিসার্চ ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব কমপ্লিট এডুকেশন এর গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে প্রাথমিক স্তরে চালু হওয়া সৃজনশীল পদ্ধতি এখনো অর্ধেকের বেশি শিক্ষক কার্যকরভাবে বোঝেন না তাঁদের মধ্যে ১৩ শতাংশ একেবারেই বোঝেন না। ৪২ শতাংশ অল্পস্বল্প বোঝেন। এই পদ্ধতি বোঝেন ৪৫ শতাংশ শিক্ষক। অন্যদিকে, সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝার জন্য ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থী গাইড বইয়ের সাহায্য নেয়। (রিসার্চ ফর অ্যাডবান্সমেন্ট অব কমপ্লিট এডুকেশন, সংবাদ সম্মেলন ২৫ জানুয়ারি ২০১৬)

একই প্রতিবেদনে বলা হয়, সৃজনশীল পদ্ধতির ক্ষেত্রে ৪৭ শতাংশ শিক্ষক বাজারে প্রচলিত গাইড বইয়ের ওপর নির্ভর করেন। ৩৫ শতাংশ শিক্ষক তাঁদের সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। ১৮ শতাংশ শিক্ষক নিজের জ্ঞান ও ধারণা থেকে শিক্ষার্থীদের পড়ান।

গবেষণা প্রতিবেদনে সৃজনশীল পদ্ধতির বিষয়ে শিক্ষার্থীদের অবস্থানও তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ৬৭ শতাংশ শিক্ষার্থী সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝার জন্য গৃহশিক্ষকের সহায়তা নিচ্ছে। গৃহশিক্ষকের সহায়তা নিচ্ছে না ৩৩ শতাংশ। পরীক্ষাকেন্দ্রে ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রশ্নপত্র বুঝতে পারে না। তবে ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বুঝতে পারে। সৃজনশীল পদ্ধতির ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থী গাইড বইয়ের সাহায্য নেয়। মাত্র আট শতাংশ শিক্ষার্থী গাইড বই থেকে দূরে থাকে।

সবশেষে বলা যায়, সৃজনশীল পদ্ধতি বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। অনুশীলনমূলক সহায়ক বই এই অগ্রগতির পক্ষে সহচর। এটাকে শুধু নেতিবাচকভাবে না দেখে গবেষণা, পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখতে হবে। বিবেচনায় রাখতে হবে-

* প্রচলিত ধারার নোট-গাইড এবং সৃজনশীল অনুশীলনমূলক সহায়ক বই এক নয়।

* অনুশীলনমূলক সহায়ক বই কেবল চর্চার (Practise) জন্য; মুখস্থ করার জন্য নয়।

* অনুশীলনমূলক সহায়ক বই বন্ধ করে দেওয়া হলে দেশের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর পড়ালেখা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হবে, শিক্ষকগণের বিরাট একটি অংশ পাঠদানের ক্ষেত্রে মহাসংকটে পড়বে।

* দেশের প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে, দেশের বই বিক্রয়ের সকল লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে যাবে, দেশের প্রায়  প্রায় ২৩ লাখ ১০ হাজার লোকের জীবন-জীবিকা হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়বে। সর্বোপরি দেশের প্রকাশনা শিল্প ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে।

* আমাদের দেশে অনুশীলনমূলক সহায়ক বই প্রকাশ বন্ধ হলে পার্শ্ববর্তী দেশ (ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা) বাংলাদেশের কারিকুলাম ও সিলেবাস অনুযায়ী বই প্রকাশ করে বাজার দখল করে নিবে। তাছাড়া পূর্বের ন্যায় দেশের মফস্বল শহর থেকে নিম্নমানের বই এসে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছবে। ফলে আমাদের প্রকাশনা শিল্প ধ্বংস হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষাক্ষেত্রেও বিপর্যয় দেখা দিবে।


অতএব, শিক্ষা আইন চূড়ান্ত করার আগে এ বিষয়গুলোর পর্যালোচনা করা অতীব জরুরি। তাছাড়া আইন করে সহায়ক বই বন্ধ করতে হবে কেন এটি আমার বোধগম্য নয়। কেননা যতক্ষণ কোনো বিষয়ের বা বস্তুর প্রয়োজন থাকে ততক্ষণ আইন করে বা চোখ রাঙানি দিয়ে তার ব্যবহার বন্ধ করা যায় না। শ্রেণিশিক্ষার মান সে জায়গায় পৌঁছালে, শিক্ষকরা সৃজনশীল শিক্ষা দেওয়ার মতো করে পুরোপুরি তৈরি হলে, ছাত্ররা স্কুল-কলেজে উৎকৃষ্ট শিক্ষা লাভের প্রয়োজনীয় উপকরণ পেলে তো তাদের আর সহায়ক বইয়ের দ্বারস্থ হতে হবে না। তখন আর শিক্ষক-অভিভাবক কেউ নোট বই, গাইড বই বা সহায়ক বই যাই বলি কোনোটির প্রতিই আকৃষ্ট হবে না। তাই আইন করে অনুশীলনমূলক সহায়ক বই বন্ধ করতে হবে বলে আমি মনে করি না। এতে বরং হিতে বিপরীত হবে। সহায়ক বইয়ের  মান উন্নয়নে দেশের বেসরকারি প্রতিনিধিত্বশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান যে প্রতিযোগিতা ও নিরন্তর গবেষণা করে চলছে তা থেমে যাবে। উপরন্তু পার্শ্ববর্তী দেশ ও মফস্বল শহর থেকে প্রকাশিত নিচুমানের সহায়ক বইয়ে বাজার সয়লাব হয়ে যাবে। তাই নীতিনির্ধারকদের বিষয়টি আরও সুক্ষ্মভাবে ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছি। 


তথ্যসূত্র :

১. প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন ২০১৭

২. ড. সীনা আক্তার, ‘পাঠ্যবই ও মানসম্মত শিক্ষা’, বাংলা ট্রিবিউন, জানুয়ারি ০৫, ২০১৬

৩. উম্মে কুলসুম বেবী, সৃজনশীল পদ্ধতির সুফল পেতে হলে, দৈনিক সমকাল, ১৭ নভেম্বর ২০১৩

৪. আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, সৃজনশীল প্রশ্ন কী কেন এবং কেমন? শিক্ষক প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল, অক্টোবর ২০১২

৫. আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, যুগান্তরের প্রতিক্ষায়, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল, নভেম্বর ২০১৫

৬. প্রফেসর ফাহিমা খাতুন, মুখবন্ধ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল, অক্টোবর ২০১২

৭. ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, দেশের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সর্বনাশ করল কে, বিডিনিউজ ২৪.কম, মার্চ ১৩, ২০১৫

৮. এডুকেশন ওয়াচ ২০১৪, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা কোন পথে? একটি নিরীক্ষা, সারসংক্ষেপ ২৫

 

 

লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক ডীন, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ অক্টোবর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়