ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পাঠ-সহায়ক বই ও বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা

মোনায়েম সরকার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৪৮, ২৬ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পাঠ-সহায়ক বই ও বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা

প্রচ্ছদের অলঙ্করণে তুলির আঁকা ছবি ব্যবহার করা হয়েছে

মোনায়েম সরকার: মানব সভ্যতা শুরু হবার পর থেকেই নিজেকে আলোকাভিসারী করার জন্য নিরন্তর চেষ্টা করছে প্রতিটি মানব সন্তান। আদিম সমাজব্যবস্থার প্রতিটি স্তর পেরিয়ে বর্তমান সভ্যতায় পৌঁছাতে হাজার হাজার বছর সংগ্রাম করেছে মানুষ। একদিন এই মানুষ বনচারী ছিল। যেদিন সে হাতে বৃক্ষশাখা, কিংবা পাথর ধরা শিখলো, সেদিনই পৃথিবীতে উন্মোচিত হয় নতুন দিগন্ত। এরপর আগুনের ব্যবহার মানুষকে এনে দেয় নতুন সাফল্য। মানব সভ্যতার বাঁকে বাঁকে মানবসৃষ্ট যেসব অর্জন আছে তা লিপি আবিষ্কারের পর লিপিবদ্ধ হয় বইয়ের পাতায়। বই মানব সভ্যতা বিকাশে অপরিসীম ভূমিকা পালন করছে।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যবই ও পাঠ-সহায়ক বই নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তর্ক-বিতর্ক চলছে। এসব তর্ক-বিতর্ক এতদিন দূরে বসে উপভোগ করেছি। আজ মনে হলো পাঠ্যবই ও পাঠ-সহায়ক বই নিয়ে কিছু কথা বলি। এই কথাগুলো একান্তই আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধির ফসল। বলা যেতে পারে এগুলো কেবলই আমার ব্যক্তিমনের চিন্তার ফল।

যেসব বই কোনো নির্দিষ্ট তথ্যের জন্য বিভিন্ন সময়ে নির্দেশক বা পরামর্শক হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে রচিত হয় তাদের সহায়ক বা নির্দেশক গ্রন্থ বলে। ব্যাপকভাবে বললে, যে বইয়ের কোনো তথ্য এতটাই পূর্ণাঙ্গ বা সুশৃঙ্খল যে তা তৎক্ষণাৎ সহজবোধ্য হয়ে ওঠে সে বইকে সহায়ক বই বলা যেতে পারে।

বিন্যাস ও ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে একটি সহায়ক বইয়ের নকশা করা হয় যাতে বইটি বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখে। সহায়ক বইয়ের কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো- ১. এটি প্রাথমিকভাবে বিশেষ বিশেষ পরামর্শের জন্য রচিত; ২.          নির্দিষ্ট তথ্যের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত; ৩. এটি তথ্য ও ঘটনার সামগ্রিক রূপ; ৪. তথ্যের বিন্যাস কাঠামো ধারাবাহিক ও সুশৃঙ্খল বিধায় শিক্ষার্থীর জন্য সহজবোধ্য ও দ্রুত স্মরণীয়; ৫. এতে প্রকৃত ঘটনার ওপর ফোকাস করা হয়; ৬. জ্ঞান অন্বেষণে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখে; ৭. কোনো দুর্বোধ্য বিষয়কে সহজ-সরলভাবে বিশ্লেষণ করে সহজবোধ্য করে তোলে।

সহায়ক বইয়ের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কোনো কঠিন বিষয়বস্তুকে সরল অনুবাদ, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সাধারণের পাঠযোগ্য ও বোধগম্য করে তুলতে সহায়ক বই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যুগে যুগে ধর্মপ্রচারক, বিজ্ঞানী, দার্শনিকগণ যে গবেষণা কর্ম বা যে গ্রন্থ রেখে গেছেন তার অধিকাংশই পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও উচ্চশিক্ষা অর্জিত মানুষের জন্য। সাধারণের জন্য তা বোঝা অত্যন্ত দুরূহ। বিধায় সেগুলো বোঝার জন্য যুগে যুগে রচিত হয়েছে সহায়ক বই বা রেফারেন্স বুক। পৃথিবীর তাবৎ বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য রয়েছে কোটি কোটি রেফারেন্স বুক বা সহায়ক বই।

ভারতীয় সভ্যতা বিকাশে ধর্ম ও দর্শনের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বী। তাদের প্রধান ধর্মীয় গ্রন্থ বেদ, গীতা, সংহিতা, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যদি। তাছাড়া বিভিন্ন পুরাণও রয়েছে। প্রতিটি গ্রন্থই সাধারণ মানুষের বোঝার পক্ষে কঠিন। কেননা প্রতিটিই দুর্বোধ্য সংস্কৃত ভাষায় রচিত। সংস্কৃত সাধারণের মুখের ভাষা নয়, এমনকি উচ্চ শিক্ষিতদেরও মুখের ভাষা নয়। এটি একটি কৃত্রিম লিখিত ভাষা। তাই বেদ, গীতা, সংহিতা, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ বোঝার জন্য রচিত হয়েছে প্রচুর পরিমাণে সহায়ক বই।

বেদের মূলভাব বোঝার জন্য বেদের সহায়ক হিসেবে রচিত হয়েছে বেদান্ত। বেদান্ত হচ্ছে ছয়টি সহায়ক বইয়ের সামষ্টিক রূপ। আর্য মুনি ঋষিরা বেদের শাশ্বত সত্যের কথা স্মরণে রেখে তার ভিত্তিতে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন পরিবেশের গতি অনুসারে সময়োপযোগী ও সাধারণের বোধগম্য আরো বিশটি সংহিতা রচনা করেন যার একত্রে নাম স্মৃতি সংহিতা। এতে যেমন রয়েছে ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের রূপরেখা। পাশাপাশি রয়েছে রাজরাজড়াদের প্রতি উপদেশ, আইনের রূপরেখা, নীতি ও নৈতিকতা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সমরবিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য ও সংগীতবিদ্যা অর্জনের দিকনির্দেশনা। রামায়ণের সহায়ক গ্রন্থ প্রচুর। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হলো- রামায়ণ কথা, রামায়ণ কাহিনী, রামায়ণের চরিত্র, রামায়ণের শ্লোক সন্ধান, রামায়ণের সহজ গল্প ইত্যাদি। মহাভারতের সহায়ক গ্রন্থ- মহাভারত কথা, কৃষ্ণচরিত্র, কথা অমৃতসমান ইত্যাদি। এ ছাড়াও হিন্দুধর্ম বোঝাতে ও ধর্মীয় নিয়মনীতি অনুসরণ করতে বিভিন্ন পুরাণ, ষড়দর্শন, উপনিষদ, আগমশাস্ত্র ইত্যাদি সহায়ক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। বিজ্ঞানের জটিল সূত্র ও তত্ত্ব বোঝার জন্য রয়েছে লাখ লাখ সহায়ক বই। নীতিবিদ্যা, অধিবিদ্যা, ভাববাদ, বস্তুবাদ, সংশয়বাদ, অভিজ্ঞতাবাদ, সমাজবিদ্যা, মনোবিদ্যা, সাহিত্য, কলাবিদ্যা সকল ধরনের বিদ্যার জন্য রয়েছে কোটি কোটি সহায়ক বই।

২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার শিক্ষানীতি ২০১০ নামে নতুন শিক্ষানীতি চালু করে। তারপর থেকে শিক্ষা আইন প্রণয়নের নিমিত্তে আইনের খসড়া কপি কয়েক বছর যাবৎ বুদ্ধিজীবী মহলে দেওয়া হয় পর্যবেক্ষণের জন্য। অনেকবার অনেক হাত ঘুরে সম্প্রতি আইনটি নাকি চূড়ান্ত হওয়ার পথে। এটি ‘শিক্ষা আইন-২০১৭’ নামে চূড়ান্ত হবে। তবে প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন ২০১৭-এর খসড়ায় ধারা ২-এর উপধারা ১১, ধারা ১৪-এর উপধারা ১ ও ২ এবং ধারা ৪৭-এর তফসিলে ১ এর ‘খ’-এ নোট বই বা গাইড বইয়ের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে তা প্রকাশের বিরুদ্ধে আইন প্রস্তাব করা হয়েছে, কিন্তু শিক্ষাসহায়ক হিসেবে সৃজনশীল অনুশীলনমূলক বইয়ের সংজ্ঞা ও প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে কোনো আইন প্রস্তাবিত হয়নি। বিগত বছরগুলোতে নানা তর্কবিতর্কের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট যে, আমাদের এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী সহায়ক গ্রন্থের বিপক্ষে রয়েছেন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যারা এর বিপক্ষে তারা কি নোট-গাইড ও সহায়ক বইকে এক পাল্লায় মাপছেন? নাকি সহায়ক বই কাকে বলে তা গুলিয়ে ফেলেছেন? উপরে সহায়ক বই কী? তার বৈশিষ্ট কী? তার প্রয়োজনীয়তাই বা কী- সে বিষয়ে সংক্ষেপে বলতে চেষ্টা করেছি। এবার সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি, পরীক্ষাপদ্ধতি, প্রশ্ন প্রণয়ন ও উত্তর লিখন নিয়ে কিছু কথা বলবো। আমার বিশ্বাস এ বিষয়গুলো তারা জানেন, বোধকরি বোঝেনও। তারপরেও বলছি এ কারণে যে, তাদের ঘুম যেন ভাঙে এবং তারা যেন শুধু বিরোধিতার জন্য সহায়ক বইয়ের বিপক্ষে না গিয়ে আগামী প্রজন্মের প্রতি দয়াশীল হন।

২০১০ সালে বাংলা ও ধর্মশিক্ষা বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে এসএসসি পরীক্ষা গ্রহণের মধ্য দিয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি কার্যকর পদক্ষেপের পথে যাত্রা শুরু হয়। এটি ছিল পৌনে দশ বছর চলে আসা পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রথম কার্যকরী পদক্ষেপ। মুখস্থনির্ভর শিক্ষাকে বিদায় জানিয়ে চিন্তা, বুদ্ধি, মেধা ও কল্পনাশক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে জীবনভিত্তিক ও বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষার্জনের অন্যতম পদক্ষেপ সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ‘সৃজনশীল প্রশ্ন কী, কেন এবং কেমন?’ প্রবন্ধে সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন কেমন হবে সে বিষয়ে লিখেছেন: ‘গোটা ছাত্রজীবন ধরে প্রতিটি পরীক্ষায় তাদের এমন সব প্রশ্ন করে যাওয়া যার উত্তর মুখস্ত করে তারা দিতে পারবে না। দিতে হবে ভেবে, চিন্তা করে, বুদ্ধি, মেধা আর কল্পনাশক্তিকে পরিপূর্ণ আর জাগ্রতভাবে ব্যবহার করে। এতে তাদের বুদ্ধির চর্চা বাড়বে, মন সক্রিয় হবে। নোট বা পাঠ্যবই মেধাহীনভাবে মুখস্ত না করে নিজেদের বোধ আর চিন্তা শক্তি দিয়ে তারা জীবন ও জ্ঞানের সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবে।’ অন্যত্র বলেছেন, ‘পরীক্ষায় প্রশ্ন কমন পড়ার যুগ এখন শেষ। আগামী ৫০০ বছরেও পরীক্ষায় কোনো প্রশ্ন আর কমন পড়বে না।’

যেহেতু পরীক্ষায় কোনো প্রশ্নই কমন পড়বে না, সেহেতু আমি তো শিক্ষার্থীর সহায়ক বই অনুশীলনে দোষের কিছু দেখতে পাচ্ছি না। উপরন্তু বিচিত্র বিষয় একসঙ্গে সংকলন করে শিক্ষার্থীর সৃজনশীল মেধাকে বিকশিত করতে সহায়ক বইগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোর কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। ইদানীং বেশ কিছু পত্রিকা শিক্ষা-সহায়ক পাতা প্রকাশ করছে। এগুলোও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মেধা-বিকাশে যথেষ্ট সহায়তা করছে।

সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিতে পাবলিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর থেকেই বহু তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-পর্যালোচনা, মত-ভিন্ন মত পত্রিকার পাতায় স্থান পাচ্ছিল। যেহেতু বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এখন একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে এবং তার পক্ষে-বিপক্ষে প্রচুর মতামত পত্রিকার পাতায় স্থান করে নিচ্ছে তাই সময় সময় আমিও তাতে চোখ রেখেছি। অনুধাবন করতে চেষ্টা করেছি।

অধুনা প্রচলিত সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিখনফলের আলোকে উদ্দীপক, প্রশ্ন ও উত্তর টেক্স ও কনটেক্সের ওপর ভিত্তিতে করা হয়ে থাকে। সৃজনশীল অনুশীলনমূলক বইগুলোতে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি জাতীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ে সাম্প্রতিক তথ্য এবং বই-পত্র-পত্রিকা-জার্নাল থেকে কনটেক্স সংগ্রহ করে নমুনা প্রশ্ন ও নমুনা উত্তর সন্নিবেশিত হয়। এসব বইয়ের শিখনফলকে কেন্দ্র করে পর্যাপ্তসংখ্যক সৃজনশীল নমুনা প্রশ্ন ও উত্তর ছাড়াও থাকে উত্তর-সংকেতসহ প্রশ্নব্যাংক, উত্তরবিহীন প্রশ্নব্যাংক, মডেল প্রশ্নপত্র, শ্রেণির কাজের নির্দেশনা, রিভিশন অংশ ইত্যাদি। সর্বোপরি ই-লার্নিং উৎসাহিত করার জন্য বইগুলোর সঙ্গে থাকে ইন্টারনেট লিংক ও মোবাইল অ্যাপভিত্তিক অনুশীলনের বিষয়বস্তু। এই বিষয়গুলো যদি আমাদের শিক্ষার্থীরা আত্মস্থ করতে সক্ষম হয়, তাহলে প্রতিভা বিকাশ সহজতর হবে। তাই আমার মনে হয় পাঠ-সহায়ক বই নিরুৎসাহিত না করে কিভাবে এর শ্রীবৃদ্ধি করা যায়, সে বিষয়ে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত।    

 

২৫ অক্টোবর, ২০১৭



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ অক্টোবর ২০১৭/তারা

 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়