ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

সামাজিক নিষ্ঠুরতা: টেঁটা যুদ্ধের নামে হত্যার শেষ কোথায়?

জাফর সোহেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৬, ১৩ নভেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সামাজিক নিষ্ঠুরতা: টেঁটা যুদ্ধের নামে হত্যার শেষ কোথায়?

ফাইল ফটো

জাফর সোহেল : স্বাধীন একটি দেশ। এর জনগণও মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নেয়। দেশটি কোনো বাইরের দেশের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত নেই। অভ্যন্তরীণ কোনো কারণে গৃহযুদ্ধের ঘটনাও ঘটছে না। এরপরও সেই দেশে সাধারণ মানুষ প্রাণ দিচ্ছে একে অন্যের হাতে। সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত উঠে আসছে সে কথা। একদিন বা এক মাস নয়,  বছরের পর বছর ঘটছে এমন ঘটনা।

সংবাদমাধ্যমে কাজ শুরুর পর থেকে আমার মনে হয় না এমন কোনো মাস গেছে, বাংলাদেশের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলের ‘টেঁটা যুদ্ধ’ নামে একটি বিশেষ প্রকার যুদ্ধের সংবাদ আসেনি। যতটুকু আমার নিজের চোখে ধরা পড়েছে, বেশির ভাগ গল্প মেঘনা-গোমতি, সুরমা-কুশিয়ারা আর যমুনা-ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরবর্তী এলাকা এবং চরাঞ্চলের। জেলা হিসেবে যদি ধরি ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ এসব নাম আসবে আগে। সবচেয়ে বেশি ঘটনা পাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন উপজেলার। মাসে সেখানে দু-একটা ঘটনা আছেই।

সবশেষ গত সপ্তাহে পরপর দুটি ঘটনার সংবাদ আমাদের করতে হয়েছে। এর একটি ঘটেছে নরসিংদীতে, অপরটি কিশোরগঞ্জে। সপ্তাহের শুরুতে নরসিংদীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটির কথা সেখানকার এক গৃহিনীর বক্তব্যে গণমাধ্যমে এসেছে। তিনি বলছিলেন, ‘রাত সাড়ে নয়টার দিকে হঠাৎ করে আমাদের বাড়িঘরে হামলা শুরু করে কয়েকশ’ মানুষ। আমরা এমনকি পাতের ভাতটুকুও শেষ করতে পারিনি। জিনিসপত্র সরাতে পারিনি। সব ভেঙে-চুরে তছনছ করে দিয়েছে। মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাট করে নিয়ে গেছে। এই যে দেখুন আমার কান- স্বর্ণের দুল ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। আমরা তাদের হাতে পায়ে ধরেছি- কোন কাজ হয়নি।’

পত্রিকার পাতায় এ বিবরণ পড়ছিলাম আর আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল! এ কেমন বর্বরতা চলছে আমাদের গ্রামগুলোতে। নিরীহ মানুষদের এভাবে নির্যাতন-নিপীড়ন কারা করছে? সেখানকার প্রশাসনেরই বা কী ভূমিকা? এই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত এক কিশোরী বলছিল, পরদিন তার জেএসসি পরীক্ষা ছিল, কিন্তু সে প্রস্তুতি নিতে পারেনি। নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চরাঞ্চলের এই ঘটনার পেছনে যে কারণটি শুনলাম তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। দুই পক্ষের টেঁটা যুদ্ধে অংশ নেয়নি বলে তাদের ওপর হামলে পড়েছে যুদ্ধে উন্মাতাল একটি পক্ষ! হায় দেশ। নিরপেক্ষও থাকা যাবে না, শান্তশিষ্টও থাকা যাবে না! সবাইকেই উন্মাদ হতে হবে?

সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার টেঁটাযুদ্ধের আরেকটি খবর এলো কিশোরগঞ্জের মিঠামইন এলাকা থেকে। সেখানে টেঁটাবিদ্ধ হয়ে এবং বল্লমের খোঁচায় মারা গেছে একই পরিবারের ৩ সহদোর ভাইসহ ৫ জন! কী নৃশংস ঘটনা! এই ঘটনায় টেঁটাবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন ঐ এলাকার দুই পক্ষের আরো অন্তত ৫০ জন! একটি গোটা এলাকার মানুষ সেখানে যুদ্ধে জড়িয়েছে; তাদের ভাষায় ‘অস্তিত্বের যুদ্ধ’! 

সভ্য সমাজে বসে আমরা যারা উন্নয়ন ও অগ্রগতির গল্প আওড়াই- সমাজের এই নৃশংসতাগুলো, সামাজিক এই বিচ্যুতিগুলো তাদের কতটা ছুঁয়ে যায় তা নিয়ে আমার বেশ সন্দেহ। একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকদের নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার মতো অনুভূতি কী করে তৈরি হলো? সেই অস্তিত্ব রক্ষায় তাদের সবাইকে সম্মিলিতভাবে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হচ্ছে কেন? তাদের অস্তিত্ব রক্ষায় এই স্বাধীন দেশের প্রশাসন কি তবে ব্যর্থ? কিংবা সেখানকার সমাজ, সমাজপতি এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরই বা কী ভূমিকা?

প্রশ্নের আসলে শেষ নেই। সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হলো, টেঁটাযুদ্ধের মতো একটি প্রাণঘাতি ব্যবস্থা কী করে যুগের পর যুগ টিকে থাকে? টেঁটযুদ্ধের উপকরণ- টেঁটা, বল্লম, তীর, ধনুক এগুলো কারা বানায়, কারা বিক্রি করে, কারা মজুদ করে- এই প্রশ্নগুলো কি সেখানকার প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, সমাজপতিদের মাথায় আসে না?

আগের বছর যে যুদ্ধে, যে টেঁটা আর বল্লমে পরিচিত মানুষগুলোর প্রাণ দিতে হয়েছে, পরের বছরও কেন একই রকম যুদ্ধ করতে হচ্ছে, একইরকম অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে? যারা এর নিয়ন্ত্রণকারি থানা-পুলিশ কী ভূমিকা পালন করেছে আমরা জানি না। আমরা জানি না পুলিশ এগুলোকে অস্ত্র মনে করে কিনা?

শুধু পুলিশের কথাই বা বলছি কেন- এসব অঞ্চলের জনপ্রতিনিধিরা এই ধরনের হামলা ঠেকাতে বা জনগণকে নিরস্ত্র করতে কী উদ্যোগ নিয়েছেন? তারা চাইলে তো এলাকায় এসব অস্ত্র তৈরি করা সম্ভব নয়। পাড়ায় পাড়ায় নজরদারি কমিটি করে দিলে তারা এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পারে, প্রশাসনকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে পারে। কিন্তু তারা বরং অনেক ক্ষেত্রে উল্টোটা করছেন বলে আমরা জানতে পারি। নিজেরাই আধিপত্য বিস্তারের নেশায়, জলমহাল দখলের নেশায়, এক মৌসুমেই কোটি টাকার দান মেরে দেয়ার নেশায় বছরের পর বছর এসব হানাহানি টিকিয়ে রেখেছেন এবং উন্মাদনা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। সাধারণ মানুষ অনেকে বুঝে, অনেকে না বুঝে এই প্রাণঘাতি উন্মাদনায় যাগ দিচ্ছে।

এমনকি স্থানীয় অনেকের অভিযোগ আছে- এসব ঘটনা যাতে নির্বিঘ্নে ঘটে সেজন্য আগে থেকে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে উৎকোচ দিয়ে ম্যানেজ করে দুর্বৃত্তরা। যে কারণে প্রায়ই ঘটনা ঘটে যাওযার অনেক পরে পুলিশ হাজির হয়। অর্থাৎ পুলিশ জেনেও চুপ থাকে। নরসিংদীর ঘটনায় এক সহকারী সচিব পুলিশকে একাধিকবার ফোন করেও সাড়া পাননি বলে সংবাদমাধ্যমে অভিযোগ করেছেন।

আমরা যেন আগামী মাসে বা আগামী বছর প্রাণঘাতি টেঁটাযুদ্ধের একই রকম গল্প আর শুনতে না পাই। সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এখনই নিতে হবে। পুলিশ বা প্রশাসন চাইলে পারে না এমন কোনো কাজ নেই। বাংলাদেশের মানুষ এটা বিশ্বাস করে। সুতরাং এক্ষেত্রে পুলিশের যথাযথ আন্তরিক পদক্ষেপ চাই। সবচেয়ে বড় পদক্ষেপটি হওয়া চাই- টেঁটাযুদ্ধের উপকরণ বানানো এবং এর বিকিকিনি বন্ধে কঠিন পদক্ষেপ। টেঁটাযুদ্ধপ্রবণ এলাকাগুলোতে পুলিশের স্থায়ী ক্যাম্পও করা যেতে পারে। দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদেরও। তাদের নজরদারি থাকলে সংঘর্ষ এড়ানো যাবে। অন্তত তাঁরা পুলিশকে আগাম তথ্য দিতে পারবেন। পারলে টেঁটাযুদ্ধবিরোধী সামাজিক কমিটিও করে দেয়া যেতে পারে। কোনোভাবেই একটি স্বাধীন দেশে এভাবে আর প্রাণহানি কাম্য হতে পারে না।

লেখক: সাংবাদিক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ নভেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়