ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

এশিয়া সফরে কী বার্তা দিলেন ট্রাম্প?

রাসেল পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৫, ১৬ নভেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এশিয়া সফরে কী বার্তা দিলেন ট্রাম্প?

রাসেল পারভেজ : যখন কোনো ব্যক্তি গর্বের সঙ্গে নিউ ইয়র্কের প্রাণকেন্দ্রে কাউকে হত্যা করার কথা বলেন এবং তার পরেও প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন, এরপর তিনি এমন আরেকজন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করেন, যিনি ইতিমধ্যে খুন করেছেন এবং জনপ্রিয়তা ধরে রেখে কাজ করে যাচ্ছেন, তখন তাদের কাছ থেকে মানবাধিকারের বিষয়ে খুব বেশি কিছু আশা করা যায় কি? না।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতের্তের বহুপ্রতীক্ষিত বৈঠক থেকে এর প্রমাণ পাওয়া গেল।

প্রকৃত সংখ্যা গণনা খুবই দুরুহ হলেও এটি নিশ্চিত, গত দেড় বছরে ফিলিপাইনে প্রেসিডেন্ট দুতের্তের স্বঘোষিত মাদকবিরোধী যুদ্ধের নামে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেক শিশু রয়েছে এবং মাদক ব্যবসার সঙ্গে নামমাত্র যোগসূত্র পাওয়া গেছে- এমন লোকদেরও হত্যা করা হয়েছে।

আত্মরক্ষার অজুহাতে পুলিশ তাদের হত্যা করেছে কিন্তু পুলিশের বৈশ্বিক আচরণবিধির নিরিখে এসব হত্যার মধ্যে অনেক বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা রয়েছে। পাশাপাশি পুলিশের পরিচয়ে মুখোশধারীরা সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ীদের খুন করেছে। এসব মুখোশধারীরা অনেকে পুলিশের কাজের সঙ্গে যুক্ত অথবা তারা পুলিশের ইউনিফর্মহীন কর্মকর্তা। এসব ঘটনা মানবাধিকারের বিপর্যয়। যদিও প্রেসিডেন্ট দুতের্তে ফিলিপাইনকে মাদক মুক্ত করার দোহাই দিয়ে হত্যা জায়েজ করে নিচ্ছেন।

গত বছর ফিলিপাইনে এসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কড়া সমালোচনা করে দুতের্তের গালির শিকার হয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ওবামাকে ‘বেশ্যার পুত্র’ বলে গালি দিয়েছিলেন দুতের্তে। এরপর ফিলিপাইনের এই একরোখা প্রেসিডেন্ট অহংকারের সঙ্গে বলেন, একই ইস্যু সামনে আনলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বেলায়ও তাই ঘটবে। তবে তার আতঙ্কিত হওয়ার দরকার নেই।

ট্রাম্পের মুখপাত্রের বয়ান অনুযায়ী, ফিলিপাইন সফরে এসে দুতের্তের সঙ্গে মানবাধিকারের বিষয়টি তুলে ধরেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট। দুই প্রেসিডেন্টের যৌথ বিবৃতিতে ইস্যুটি এমনভাবে আনা হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত অর্থহীন। একই ঘটনা ঘটেছে চীন ও ভিয়েতনামেও। এই দুই দেশে ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে সীমাহীন নির্যাতন করা হয় এবং তাদের দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

সিঙ্গেল মাদার বা ‘মাদার মাশরুম’ নামে বেশি পরিচিত একজন ভিয়েতনামি ব্লগার এনগুয়েন এনগক এনহু কুইয়ানহকে গত মার্চ মাসে মার্কিন ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প সাহসীকতা পুরস্কারে ভূষিত করেন। এর তিন মাস পর ‘রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণায় লিপ্ত থাকার অভিযোগে’ ভিয়েতনামের একটি আদালত তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন। কিন্তু দেশটি সফরের সময় ভিয়েতনামি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এনহু কুইয়ানহের বিষয়ে ট্রাম্প কথা বলেছেন- এমন কোনো প্রমাণ নেই।

বিরোধী মতের রাজনীতিক ও প্রধান বিরোধী দলের বিরুদ্ধে চরম দমন-পীড়ন চালানোর অভিযোগ রয়েছে কম্বোডিয়ার প্রেসিডেন্ট হান সেনের বিরুদ্ধে। সেদেশে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক ইনস্টিটিউট’ বন্ধ করে দিয়েছেন হান সেন এবং তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে যুক্তরাষ্ট্র ষড়যন্ত্র করছে বলে অভিযোগ তুলেছেন। মেলানিয়াকে সঙ্গে নিয়ে সেই হান সেনের পাশে দাঁড়িয়ে হাস্যোজ্জ্বল ছবি তুলেছেন ট্রাম্প।

যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আনা হান সেনের অভিযোগকে ‘গুরুত্বপূর্ণ বা বিশ্বাসযোগ্য কোনো প্রমাণ ছাড়া’ মনগড়া অভিযোগ বলে অভিহিত করেছেন কম্বোডিয়ায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত। কম্বোডিয়ার শীর্ষ নেতার সঙ্গে ছবি তোলার সময় বিষয়টি ট্রাম্পের জানা ছিল কিনা অথবা জানলেও তা গুরুত্ব দেননি কেন, তা পরিষ্কার নয়।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে থাইল্যান্ড থেকে মালয়েশিয়ায় চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ অভিযোগ রয়েছে। থাইল্যান্ডে সামরিক শাসনের চতুর্থ বছর চলছে। যেখানে সেনাশাসন বা রাজতন্ত্রের সমালোচনাকারীদের বছরের পর বছর জেলখানায় বন্দি করে রাখা হচ্ছে। মালয়েশিয়া, যেখানে দেশের উন্নয়ন তহবিলের (ওয়ানএমডিবি) অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে খোদ প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকই অভিযুক্ত এবং যেখানে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে তিনি ১৯৭০ সালের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে দুর্বৃত্তায়নের শাসন কায়েম করছেন, তা নিয়ে কোনো কথা নেই ট্রাম্পের।

ট্রাম্প তার এশিয়া সফরে বুঝিয়ে দিলেন, এখনো পর্যন্ত তার ধ্যানজ্ঞান শুধু বাণিজ্যে, মূল্যবোধ বা মানবাধিকারে নয়। ফিলিপাইনের রাজধানী ছাড়ার আগে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের বোয়িং বিমান কেনার বিষয়ে ভিয়েতনামি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার আলোচনা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, ফিলিপাইনের সঙ্গে সুগভীর সম্পর্ক স্থাপনে সফল হয়েছেন, সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তাকে তার সহকর্মী জিজ্ঞাসা করেন, মানবাধিকার নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কোনো কথা বলেছেন না কেন? জবাবে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে তিনি বলেন, এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশ যেমন জাপান কেন এ নিয়ে কথা বলছে না? অর্থাৎ ট্রাম্পের অবস্থান তার প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যেও মতবিরোধ রয়েছে। আর জাপান তো সাধারণত অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে তাদের পররাষ্ট্রনীতির বিজ্ঞাপন দেয় না। তাদের বিদেশনীতি ভাষা সব সময় কোমল এবং তারা প্রচুর বৈদেশিক সাহায্য দিয়ে সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক ধরে রাখে। কিন্তু এই সেই যুক্তরাষ্ট্র, যারা স্নায়ুযুদ্ধের পর এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের আলো জ্বেলে রেখেছে। এ অঞ্চলের সরকারগুলোকে শুধু জাতিসংঘ সনদের বাধ্যবাধকতার কথা মনে করিয়ে দেওয়া নয়, এসব দেশে বেসরকারি সংস্থা-সংগঠন এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলকে অর্থায়ন, প্রশিক্ষণ ও সাহস দিয়ে সরকারকে জবাবদিহির কাঠগড়ায় আনতে সাহায্য করে যুক্তরাষ্ট্র।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়াবিষয়ক ‍উপ-পরিচালক ফিল রবার্টসন বলেছেন, ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টি সব সময় সরকারি নেতাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোকেই বোঝায়, যেসব নেতা বিরোধী দলের নেতা-কর্মী, এনজিও কর্মী ও সামাজিক নেতাদের ওপর দমন-পীড়ন চালাতে প্রস্তুত। নেতাদের হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কুক্ষিগত করা ও এর ফলে অবাধ দুর্নীতির জয় জয় অবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মানবাধিকার রক্ষার চেষ্টা করা হয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘কিন্তু আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে মানবাধিকারকে কেন্দ্রে ও সামনে আনেননি ট্রাম্প এবং কোনো ধরনের প্রতিরোধও তিনি গড়ে তোলেননি।’

রোহিঙ্গা সংকট
ফিলিপাইনের ম্যানিলায় ১০-১৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত আসিয়ান সম্মেলনে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সান সুচি অংশ নেন। ট্রাম্পের সঙ্গে আসিয়ান নেতাদের ক্রস-হ্যান্ডশেক সেশনে হাস্যোজ্জ্বল সু চিকে দেখা যায়। কিন্তু এই সম্মেলনে রোহিঙ্গা সংকট গুরুত্ব পায়নি। সম্মেলনের চূড়ান্ত বিবৃতিতেও রোহিঙ্গা সংকটের ইস্যুটি রাখা হয়নি। অবশ্য এক্ষেত্রে আসিয়ান দেশগুলোর চুক্তি একটি বড় বাধা। কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে আঞ্চলিক এই জোটের গঠনতন্ত্রে।

আসিয়ান ইন্টার গভর্নমেন্ট কমিশন অন হিউম্যান রাইটসও (এআইসিএইচআর) রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। কারণ এই কমিশনের পরিচালনা পরিষদের সদস্যরা সরকারগুলোর মনোনীত কর্মকর্তা। মানবাধিকারকর্মী ও সমালোচকদের মতে, এআইসিআইচআর একটি দন্তহীন ও দুর্বল প্রতিষ্ঠান। সরকারের বাইরে যাওয়ার মুরোদ নেই তাদের। তা ছাড়া কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে জবাবদিহিরও বাধ্যবাধকতা নেই। যে কারণে সংস্থাটি নামসর্বস্ব।

জাতিসংঘের হিসাবমতে, গত আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে শুরু হওয়া মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেদেশের সেনাবাহিনীর বর্বর অভিযানের মুখে জীবন বাঁচাতে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বিষয়ের দোহাই দিয়ে এবং আসিয়ানের নীরবতা কাজে লাগিয়ে মিয়ানমারের ডি ফ্যাক্টো সরকারপ্রধান সু চি তাদের সেনাবাহিনীর বর্বরতা সমর্থন করে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে পরিচালিত শত শত বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠন বলছে, এক আতঙ্কিত সময় পার করছে তারা।

আসিয়ান সরকারগুলো ট্রাম্পের বেনিয়া চরিত্র দেখে উৎসাহিত হবেন এটিই স্বাভাবিক। চীনের উত্থানের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রকে এগিয়ে রাখতে তিনি শুধু মুনাফায় নজর দিচ্ছেন- কোথায় কী করলে যুক্তরাষ্ট্রের লাভ হবে, প্রবৃদ্ধি হবে- ট্রাম্পের খেয়াল শুধু সেদিকেই, মানবাধিকারে নয়। চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সরকার ব্যবস্থা পশ্চিমা গণতান্ত্রিক মডেলের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। দেশের উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র ছাড়াও অন্য ব্যবস্থা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে- চীনা প্রেসিডেন্ট বিশ্বকে সেই বার্তা পরিষ্কার ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন। গণতন্ত্র, মানবাধিকার এসব নিয়ে চীনের মাথা ব্যথা নেই। ফলে পশ্চিমী গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোয় প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না। ফলে এসব দেশে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা ও মানবাধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুত আন্দোলন হয়তো দীর্ঘস্থায়ী হবে না। ট্রাম্পের এশিয়া সফরের মধ্য দিয়ে সেই বার্তাই ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হলো।

৫ নভেম্বর জাপান দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সফর শুরু করেন ট্রাম্প। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইন সফরে ট্রাম্প দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। এক. উত্তর কোরিয়ার পরমাণু অস্ত্র কার্যক্রম ও দেশটির বিরুদ্ধে সম্ভাব্য পরমাণু হামলা এবং দুই. বাণিজ্য। উত্তর কোরিয়ার হামলা থেকে রক্ষার জন্য জাপানকে সব ধরনের সামরিক সহায়তা দিতে চেয়েছেন ট্রাম্প। তবে এই সহায়তা নিতে জাপানকে কয়েক শত বিলিয়ন ডলার গুণতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে আরো অস্ত্র বিক্রি করতে চেয়েছেন। চীনের সঙ্গে বিভিন্ন খাতে ২৫৩ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য চুক্তি করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন ট্রাম্প। তার সফরজুড়েই রয়েছে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি ও বাণিজ্য যেখানে মানবাধিকার গৌণ হয়ে রইল।

লেখক : বিশ্লেষক- আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ নভেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়