ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

রাজ্জাক ভাইয়ের জীবনীগ্রন্থ লেখা নিয়ে আমার বক্তব্য: ছটকু আহমেদ

ছটকু আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১৫, ৫ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রাজ্জাক ভাইয়ের জীবনীগ্রন্থ লেখা নিয়ে আমার বক্তব্য: ছটকু আহমেদ

ছটকু আহমেদ

গত ২৫ নভেম্বর ২০১৭, দুপুর একটা পঞ্চাশ মিনিট। এই দিনের উল্লিখিত সময়ে শিল্পী সমিতির নির্বাচিত সভাপতি শক্তিশালী অভিনেতা আমার সন্তানতুল্য মিশা সওদাগরের উপস্থিতিতে রাজ্জাক ভাইয়ের পরিবারের সাথে আমার একটা সমঝোতা বৈঠক হয়। রাজ্জাক ভাইয়ের জীবনী গ্রন্থ প্রকাশ করার ব্যপারে আমরা সেদিন বসেছিলাম। সেখানে উপস্থিত ছিলেন লক্ষ্মী ভাবী, বাপ্পা, ময়না, সম্রাট অর্থাৎ রাজ্জাক ভাইয়ের পরিবারের সব সদস্য। এ ছাড়াও তাদের শুভাকাঙ্খী, সেক্রেটারি এবং আইনী উপদেষ্টাও উপস্থিত ছিলেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম রাজ্জাক ভাই জীবিত অবস্থায় অসুস্থ শরীর নিয়ে কাশতে কাশতে যেসব কথা মৃত্যুর আগে আমাকে ভিডিও রেকর্ড করিয়ে লিখতে বলে গেছেন এবং একটা চিঠিতে সই করে অনুমতিও দিয়ে গেছেন; রাজ্জাক ভাইয়ের মৃত্যুর পর সেসবে আমার আর কোনো রাইট নেই। মৃত্যুর পরে সব রাইট নাকি পরিবারের।

আমি আইনী লড়াই চালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম কারণ কথাটা আমার যৌক্তিক মনে হয়নি। মৃত সেলিব্রেটিকে নিয়ে অনেকে বই লিখে তাদের অনুভূতির কথা জানাবে, তাতে পরিবারের অনুমতি লাগার কথা নয়। তাছাড়া আমার কাছে রাজ্জাক ভাইয়ের লিখিত অনুমতি রয়েছে। এমনকি তার কথাগুলো ভিডিও রেকর্ডও করা আছে। কিন্তু লক্ষ্মী ভাবীর ইমোশনের কথা ভেবে তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমি রাজ্জাক ভাইকে নিয়ে তার আত্মজীবনীমূলক লেখাটা আপাতত স্থগিত রেখেছি।  একটা সমঝোতা হয়েছে তাতে বাপ্পার রেকর্ড করা কথা রয়েছে। সেখানে তিনি বলেছেন: ‘আমি বাপ্পারাজ ও ছটকু আঙ্কেল দুজন মিলে একমত হলাম যে, আমার আম্মা ও পরিবারের সকলের ইমোশনের প্রতি শ্রদ্ধা থেকে ছটকু আঙ্কেল তার প্রকাশিতব্য যে বই, সেটি তিনি আপাতত লিখবেন না। পরবর্তীতে আমরা যদি মনে করি প্রকাশ করবো তখন ছটকু আঙ্কেলের সহায়তা নিয়ে আরো সুন্দর, আরো বড় পরিসরে প্রকাশ করবো।’

কিন্তু সমঝোতার দুই দিন পরেই বাপ্পা ও সম্রাট দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ সেই সমঝোতার কথা না বলে উল্টো বললো, ছটকু আহমেদকে বই প্রকাশের অনুমতি দেইনি। বাবার অপমানের সময় যারা মুখ বুজে ছিলেন তাদের মন্তব্য নিয়ে বই প্রকাশ করতে যাচ্ছেন তিনি। এটা খুবই দুঃখজনক। সমঝোতায় কিন্তু এরকম কোনো কথা একেবারেই হয়নি। একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে সম্রাট আরো বললো, পরিবারের লোকজনই বাবার জীবনীগ্রন্থ লিখবে। লেখকের বোর্ড বসবে। তার বক্তব্যে আরো বোঝা গেল, রাজ্জাক সাহেব সম্পর্কে তারা বেশি জানে। অন্য কেউ লিখলে ভুল তথ্য লিখে ফেলবে। যে কেউ ভুল তথ্য দিয়ে বই প্রকাশ করে ব্যক্তিগত ফায়দা লুটবে। অথচ এ ধরনের প্রচণ্ড আপত্তিজনক কথাগুলো কিন্তু সেদিন সমঝোতার সময় একবারের জন্যও বলা হয়নি।

আমার কথা হচ্ছে, পরিচালক আজিজুর রহমান, রহীম নেওয়াজ, নাজমুল হুদা মিন্টু, শাহ আলম কিরন, মনতাজুর রহমান আকবর, চিত্রগ্রাহক জেড এইচ মিন্টু, সুরকার আলাউদ্দিন আলী, সহকারী পরিচালক শাকিল, চিত্রনায়ক ফারুক, সোহেল রানা- এরা রাজ্জাক ভাই সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন, যা বইটিতে তুলে না ধরলে বইটি অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। আর তারা রাজ্জাক সাহেবের অপমানের সময় মুখ বুজে ছিলেন কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। রাজ্জাক সাহেবকে কেউ অপমান করেনি যে কারণে তারা কাঁদা ছোড়াছুড়ি করে রাজ্জাক ভাইকে জনগণের কাছে অপমানকর পরিস্থিতিতে নিয়ে যেতে চাননি। পরিচালক সমিতির কক্ষে চার দেয়ালের মধ্যে পরিচালক গাজী মাহবুব ও বদিউল আলম খোকনের মধ্যে প্রচণ্ড উত্তেজনায় রাজ্জাক ভাই সম্পর্কে যে সন্তব্য বেরিয়েছিলো তার জন্যে মন্তব্যকারী ক্ষমা প্রার্থনা করেছে। তারপরও সেই বিষয়কে সমিতির বাইরে নিয়ে গিয়ে রং চাপিয়ে চুইংগামের মতো টেনে বড় করে কলঙ্কজনক করে জনগণের কাছে উপিস্থিত করে রাজ্জাক সাহেবের কাছে ভালো সাজতে গিয়ে সো কল্ড চামচারাই চরমভাবে রাজ্জাক ভাইকে অপমান করেছে। দীর্ঘ বায়ান্নো বছরের চলচ্চিত্র জীবনে রাজ্জাক ভাই তিলে তিলে যে মান সম্মান অর্জন করেছেন তা কারো উত্তেজনাকর এক মন্তব্যে শেষ হয়ে যাবে-ওই চামচা জাতীয় মূর্খরা তা ভাবলো কেমন করে? রাজ্জাক ভাইয়ের সম্মান কি এতই ঠুনকো?

বাপ্পা  ও সম্রাট বলেছে পরিবারের লোকজন বই লিখবে, বোর্ড বসাবে, যদিও সমঝোতার মধ্যে এই কথা ছিলো না। তবুও স্বাগত জানাচ্ছি তাদের শুভবুদ্ধি হবার জন্যে। তাদের অনেক টাকা আছে, তারা বই লিখুক, বোর্ড বসাক, তাদের মতো করে তারা লিখুক। আমিও লিখি। দেখা যাক পাঠক কারটা বেশি গ্রহণ করে। বোর্ড আর পরিবারের লোকই যদি ভালো লিখতে পারতো তবে রাজ্জাক সাহেব আমাকে ডেকে লিখতে বলতেন না। রাজ্জাক সাহেব তাদের চেয়ে কম বুদ্ধিমান ছিলেন না। তারা আর্কাইভ করবে, খুব ভালো কথা। কিন্তু আর্কাইভে যদি রাজ্জাক সাহেবের দশ-বারোটা জীবনীগ্রন্থ বা বই না থাকে তবে সেই আর্কাইভ ধুয়ে কি পানি খাবে? তাদের তো উচিত যারা বই লিখছে তাদের সবাইকে সহযোগিতা করা, আর্থিক অনুদান দেয়া। তা না আইনি আশ্রয় নিয়ে লেখা বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর কারণ কী?

তারা বলছে, তারা রজ্জাক সাহেব সম্পর্কে বেশি জানে।  রাজ্জাক ভাই নিজের মুখে তার জীবনীর কথা যা বলেছে তার চেয়ে অন্য কেউ বেশি জানে এটা ঠিক কথা না। রাজ্জাক সাহেবের কথা রাজ্জাক সাহেবই ভালো জানেন। তারা পরিবার পারিবারিক জীবন বেশি জানতে পারে কিন্তু রাজ্জাক সাহেবের চলচ্চিত্র জীবন সম্পর্কে রাজ্জাক ভাই এবং রাজ্জাক ভাইয়ের সাথে যারা কাজ করেছে সেইসব শিল্পী ও কলাকুশলিরাই বেশি জানেন। আর আমার দরকার তার চলচ্চিত্র জীবন যেটা আগামী প্রজন্মের শিল্পীদের জন্যে অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। তাছাড়া আমার লিখিতব্য গ্রন্থে পরিবারিক জীবনের কথা রাখার জন্যে আমি তার পরিবারের সাথে দিনের পর দিন কথা বলতে চেয়েছি। তারা সহায়তা করেনি। ওরা বলছে যে, কেউ ভুল তথ্য নিয়ে বই বের করে ব্যক্তিগত ফায়দা লুটবে এটা খুবই আপত্তিজনক। আমি যে কেউ নই। সরকারি প্রোকৌশলীর চাকরি ছেড়ে দীর্ঘ ৪৫ বছর ফিল্মে কাজ করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কার থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রে যত পুরস্কার আছে সবই আমি পেয়েছি। আমি যে কেউ হলে তোমরা তো কিছুই না। তোমাদের যা পরিচয় সব রাজ্জাক সাহেবকে দিয়ে। আর আমি নিজে পরিশ্রম করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছি। আমি যে কেউ হলে রাজ্জাক সাহেব আমাকে ডাকতেন না। আর ভুল তথ্যের কথা প্রসঙ্গে বলি। আগে আমার লেখা শেষ হোক, বই বের হোক তখন যদি ভুল তথ্য থাকে তখন তো আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে বই নিষিদ্ধ করার পথ খোলাই ছিল। আর ব্যক্তিগত ফায়দা বলে তারা কী বোঝাতে চাইছে? তিন শতাধিক চলচ্চিত্রের কাহিনি লেখক, অসংখ্য গল্প, প্রবন্ধ, চিত্র সমালোচনার লেখক ছটকু আহমেদের কি ব্যক্তিগত ফায়দা হবে এই বই লিখে? হবে একটাই আর সেটা হলো,  রাজ্জাক সাহেবের শেষ ইচ্ছাটা পূর্ণ হবে, যার প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল।

আমি আগেও বলেছি, রাজ্জাক ভাইয়ের পরিবারের সাথে কোনো রকম কাঁদা ছোড়াছুড়িতে আমি যাবো না। তাই যা সত্য তাই তুলে ধরলাম। আশা করবো কারো কথায় না নেচে, রাজ্জাক ভাইয়ের সম্মানের দিকে তাকিয়ে যে সমঝোতা হয়েছে সে অনুসারেই সবার চলা উচিত। ধন্যবাদ।

লেখক: চলচ্চিত্র পরিচালক ও গদ্যকার

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ ডিসেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়