ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর অবদান

শাহরিয়ার কবির || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৪, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ১৬:৩৩, ১৬ ডিসেম্বর ২০২১
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর অবদান

(সূচনা পর্ব)

বাঙালি জাতির পাঁচ হাজার বছরের লিখিত ও অলিখিত ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অর্জন হচ্ছে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় বিজয় এবং স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এই স্বাধীনতার জন্য বাঙালিকে যে চরম মূল্য দিতে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া বিশ্বের অন্য কোনো জাতিকে তা দিতে হয়নি। বাংলাদেশের নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় সহযোগী জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও মুসলিম লীগের মতো মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক দলগুলো ‘রাজাকার’, ‘আলবদর’, ‘আলশামস’ প্রভৃতি ঘাতক বাহিনী গঠন করে তিরিশ লক্ষ নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছিল। সরকারি হিসেবে দুই লক্ষ, বেসরকারি হিসেবে পাঁচ লক্ষাধিক নারীকে তাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। এক কোটি মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল।

৭২-এর ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে যেভাবে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জনপদে ঘুমন্ত মানুষের উপর মেশিনগান, মর্টার, ট্যাঙ্ক ও কামান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্বিচারে গণহত্যা আরম্ভ করেছিল তা অব্যাহত ছিল ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত। ইতিহাসের সেই দুঃসময়ে বাংলাদেশের অসহায় মানুষকে বাঁচাবার জন্য এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা বিশ্বে তুলে ধরার জন্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতের সরকার ও সর্বস্তরের মানুষ যেভাবে সহযোগিতা করেছে মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে তা বিরল।

২৬ মার্চ ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা বেতার ও টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ করে এবং রাজধানী ঢাকায় কারফিউ জারি করে বাংলাদেশকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছিল। আক্রান্ত সাধারণ মানুষ জানত যে, ভারত ছাড়া তাদের বাঁচবার আর কোনো পথ নেই। কিন্তু ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যে বৈরি সম্পর্ক তারা পূর্ব পাকিস্তানের বিপন্ন মানুষদের আশ্রয় দেবে কিনা এ নিয়ে অনেকের সন্দেহ ছিল। সেই সংকট মুহূর্তে ২৭ মার্চ আকাশবাণীতে অভয়দাত্রী দেবীর মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কণ্ঠ ভেসে এল- বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধকে তার সরকার সব রকম সহযোগিতা প্রদান করবে।

তার এই বক্তব্যের পরই লক্ষ লক্ষ মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয় প্রভৃতি রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল।

১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ থেকে বিদায় নেয়ার আগে ঔপনিবেশিক বৃটিশ শাসকরা মুসলিম লীগ প্রধান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর তত্ত্ব অনুযায়ী ভারতকে তিন টুকরো পাকিস্তান নামক একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছিল। পাকিস্তানের স্রষ্টা জিন্নাহ এর আগে বলেছিলেন, ভারতে মুসলমান ও হিন্দু দুটো স্বতন্ত্র জাতি, একদেশে যাদের পক্ষে একসঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির ছয় মাসের ভেতরই বাঙালি মুসলমানের মোহভঙ্গ হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের আইনসভায় বাংলা কংগ্রেসের ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যখন প্রস্তাব করলেন নতুন রাষ্ট্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত, তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী কঠোর ভাষায় এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এর ভেতর বিচ্ছিন্নতার গন্ধ আবিষ্কার করেছিলেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের মেয়াদ নয় মাসের হলেও বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের সূচনা ঘটেছে ’৪৮-এর ভাষা আন্দোলন থেকে। ’৪৮-এ সূচিত ভাষা আন্দোলন এবং ’৫৪-র নির্বাচনে পাকিস্তান অর্জনকারী মুসলিম লীগের ভরাডুবির ভেতর ধ্বনিত হয়েছিল সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট এই কৃত্রিম রাষ্ট্রের মৃত্যুঘণ্টা। ’৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে পারে না। ষাটের দশকের শুরুতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার কয়েকজন বিশ্বস্ত সহযোগীকে নিয়ে গোপনে গঠন করেছিলেন ‘ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট’ এবং প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন স্বাধীনতার। তার ছয় দফা এমনভাবে প্রণীত হয়েছিল যাতে বাঙালিত্বের চেতনা এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা সাধারণ মানুষের ভেতর জাগ্রত করা যায়।

বাংলাদেশকে যারা স্বাধীন করতে চেয়েছেন তারা জানতেন, ভারতের সহযোগিতা ছাড়া তা সম্ভব নয়। পাকিস্তানের শাসকরাও এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিল। যে কারণে ’৪৮-’৫২-র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত বাঙালির প্রতিটি আন্দোলন, সংগ্রাম ও জনগণের অভ্যুত্থানকে তারা  পাকিস্তানকে  দুর্বল  করা অথবা ভাঙার ভারতীয় ষড়যন্ত্র এবং কমিউনিস্টদের চক্রান্ত হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে আরম্ভ করে ভাষা আন্দোলনের নায়করা এবং ’৭১-এর মুক্তিযোদ্ধারা সকলেই ছিলেন তাদের কাছে ‘ভারতের চর।’

 


যে ভারত সম্পর্কে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টারা এবং স্বাধীনতার প্রধান শত্রু পাকিস্তানী শাসকরা অভিন্ন দৃষ্টি পোষণ করেছে, যে ভারত ’৭১-এ বাংলাদেশের এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে মুক্তিবাহিনীকে সব রকম সহযোগিতা প্রদান করেছে সেই ভারত সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রণেতারা এবং গণমাধ্যমসমূহ দেশবাসীকে বিশেষভাবে নতুন প্রজন্মকে এক রকম অন্ধকারেই রেখেছেন। এর কারণ হচ্ছে একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও গত ৪৫ বছরে অধিকাংশ সময় এ দেশটি শাসন করেছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, পাকিস্তানপন্থী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি।

’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হয়েছিল এ কথা যেমন সত্য, একইভাবে এ কথাও সত্য যে, বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ কমান্ডের নিকট পাকিস্তান  পরাজিত হলেও তাদের ভাবধারার অনুসারী ব্যক্তিরা এদেশে কম ছিল না- যারা এই পরাজয় মেনে নেয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী প্রভৃতি দলের প্রায়  ৩৭  হাজার  নেতা  ও কর্মীকে দালালীর অভিযোগে গ্রেফতার করা হলেও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সুযোগে এদের দুই তৃতীয়াংশেরও অধিক কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছিল। তখন থেকেই এরা পাকিস্তানের পক্ষে এবং ভারতের বিপক্ষে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের প্রচারণায় লিপ্ত হয়। উগ্র বামদেরও কারও কারও বক্তব্য ছিল এদের মতো।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্যের প্রধান বিবেচনা ছিল রাজনৈতিক। তবে এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অনেকে বলে থাকেন ভারত তার জন্মশত্রু পাকিস্তানকে দুপাশে রেখে প্রথম থেকেই খুবই অস্বস্তিতে ছিল। কারণ দুই সীমান্তে প্রতিরক্ষার জন্য ভারতকে বিপুল ব্যয়ভার বহন করতে হচ্ছিল। যখন পাকিস্তানকে ভাঙার সুযোগ পাওয়া গেছে ভারত সঙ্গে সঙ্গে তা লুফে নিয়েছে। পাকিস্তানী গবেষক ও ঐতিহাসিকদের মতো এ ধরনের মত বাংলাদেশের একাধিক লেখকও পোষণ করেন। বিশেষ করে যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই পাকিস্তানকে অখণ্ড দেখতে চেয়েছেন। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী সরদার আবদুল কাইয়ুম খান ৭ জানুয়ারি ’৯৬ তারিখে ভারতের এক বেসরকারি টেলিভিশন নেটওয়ার্কে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে ভারতের সৃষ্টি।

ভারতে নকশালপন্থী কিছু বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ মনে করেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ক্রমবর্ধমান নকশাল আন্দোলনকে দমন করার জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। এঁরা আরও বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ইন্দিরার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারতের  এই  সব  মতের লেখক গবেষকদের বক্তব্যে কিছুটা সত্যতা থাকতে পারে, কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে সাংবিধানিকভাবে ভারত হচ্ছে একটি গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশ আর পাকিস্তান একটি ধর্মভিত্তিক দেশ যা অধিকাংশ সময় শাসিত হয়েছে প্রত্যক্ষ সামরিক শাসনের অধীনে। পাকিস্তান প্রথম থেকেই ভারতের প্রতি যেমন সামরিক হুমকি ছিল একই সঙ্গে ভারতের সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাজনীতিরও বিরোধী ছিল। পাকিস্তানের বিবেচনায় ভারত একটি হিন্দু রাষ্ট্র এবং হিন্দুরা হচ্ছে মুসলমানদের শত্রু। পাকিস্তানের এই বিবেচনা ভারতের জন্য স্বস্তিদায়ক ছিল না। ’৭০-এর নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের বিজয়ে ভারত আশাবাদী হয়েছিল এ কারণে যে, এর ফলে পাকিস্তানে গণতন্ত্র ফিরে আসবে এবং সামরিক উন্মাদনা কমবে। যেহেতু বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছিল আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক দর্শন, এর ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রও ভারতের জন্য ছিল স্বস্তিদায়ক। এ কারণে ভারত চেয়েছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসুক।

জেনারেল ইয়াহিয়া খান যখন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গড়িমসি করেন তখন স্বাভাবিক কারণেই ভারত উদ্বিগ্ন হয়েছিল। ২৫ মার্চে বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনসাধারণের উপর পাকিস্তানের নজিরবিহীন আক্রমণ, ২৬ মার্চ বেতারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং জেনারেল ইয়াহিয়ার ভাষণে শেখ মুজিবকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা ভারতকে প্রচণ্ডভাবে উদ্বিগ্ন করেছে। ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানী হানাদার  বাহিনী  বাংলাদেশে  যে  নৃশংস গণহত্যা, নির্যাতন ও লুণ্ঠন শুরু করেছিল, যেভাবে লক্ষ লক্ষ সহায় সম্বলহীন মানুষ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছিল, যেভাবে ভারতের পূর্বাঞ্চলের বাঙালি অধ্যুষিত রাজ্যগুলি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন করার জন্য দিল্লীর উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল- সে সব ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে এ কথাই বলতে হয় বাংলাদেশকে তখন সাহায্য করা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জন্য নৈতিক কর্তব্য শুধু নয় প্রধানতম রাজনৈতিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভারতের তৎকালীন নীতি নির্ধারকরা এ কথাও দ্বিধাহীন কণ্ঠে স্বীকার করেছেন পূর্বাঞ্চলের বাংলাভাষী রাজ্যগুলোতে, বিশেষভাবে পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের পক্ষে যে প্রবল জনমত গড়ে উঠেছিল সেটা যদি দিল্লী উপেক্ষা করতো তাহলে পশ্চিমবঙ্গই ভারতের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারতো।

 


২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরিত স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন, যেখানে তিনি ‘বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন’ জানিয়েছিলেন। ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার যে ঘোষণা পাঠ করেন সেখানেও প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের আবেদন ছিল। ভারতীয় বেতার আকাশবাণী থেকেও এই স্বীকৃতি প্রদানের আবেদন প্রচার করা হয়েছে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতারা ভারত চলে গিয়েছিলেন। তাজউদ্দিন আহমদ ৩ এপ্রিল দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যখন সাক্ষাৎ করেন তখনও বাংলাদেশের সরকার ঘোষিত হয়নি কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে কথা বলেছেন।

মার্চের ৩০ ও ৩১ তারিখে কলকাতার কংগ্রেস, সিপিআই, সিপিএম, ফরোয়ার্ড ব্লক প্রভৃতি দলের উদ্যোগে ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম  সহায়ক  সমিতি’,  ‘বাংলাদেশ সংহতি ও সাহায্য কমিটি’, ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক কমিটি’ গঠন করা হয়। আনন্দবাজারের দুই এপ্রিল তারিখে প্রকাশিত ‘মুক্তি সংগ্রামীদের সাহায্য দানে সংস্থা গঠন’ শিরোনামের এক সংবাদে এ সব কমিটি গঠনের খবর ছাপা হয়েছে। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক সমিতির সভাপতি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অজয়কুমার মুখোপাধ্যায়। কার্যকরী সভাপতি ছিলেন উপ-মুখ্যমন্ত্রী বিজয় সিং নাহার এবং সহ-সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক সমর গুহ এমপি। সিপিএম নেতৃত্বাধীন ‘বাংলাদেশ সংহতি ও সাহায্য কমিটি’র সভাপতি ছিলেন জ্যোতি বসু, সাধারণ সম্পাদক সুধীন কুমার এবং কোষাধ্যক্ষ ছিলেন কৃষ্ণপদ ঘোষ। ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক কমিটি’ গঠিত হয় সিপিআই-এর উদ্যোগে। এ সকল সংস্থা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সব রকম সাহায্য প্রদানের পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য কেন্দ্রের প্রতি আহ্বান জানায়। এছাড়া বিশিষ্ট শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরাও মার্চের ৩০ তারিখ থেকে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে অনুরূপ দাবি জানান।

কূটনৈতিক স্বীকৃতির বিষয়টি কৌশলগত কারণে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রথম দিকে এড়িয়ে গেছেন কিন্তু অন্যান্য সহযোগিতার বিষয়ে তিনি প্রথম থেকেই পরিষ্কার বক্তব্য রেখেছেন। ১ এপ্রিল ’৭১ তারিখে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত ‘‘ভারতের জনগণ পূর্ব বাংলার পাশে: সংসদে প্রস্তাব’ শিরোনামে এক সংবাদে বলা হয়: ভারতের জনগণ পূর্ব-বাংলার পাশে আছে। বুধবার সংসদে সর্বসম্মত এক  প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ওদের সংগ্রাম, ওদের আত্মবিসর্জন ব্যর্থ হবে না,  ভারতের  সর্বান্তকরণ সহানুভূতি এবং সাহায্য ওরা পাবেন। এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সংসদের উভয় কক্ষে তুমুল হর্ষধ্বনি ওঠে উল্লাস বয়ে যায়।

দুই পৃষ্ঠাব্যাপী প্রস্তাব উত্থাপন করলেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। তাতে পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানকে অভিনন্দিত করা তো হলই, উপরন্তু অভিব্যক্ত হল তারা যে জয়যুক্ত হবেন এই দৃঢ় বিশ্বাস ও আশা।

নয়াদিল্লীর বিশেষ সংবাদদাতার বরাত দিয়ে সেখানে আরো লেখা হয়: ‘শ্রীমতী গান্ধী যখন বাংলাদেশের মানুষের এই সংগ্রাম ও আত্মোৎসর্গে ভারতের জনগণের সর্বান্তকরণ সহানুভূতি ও সমর্থনের আশ্বাস দেন, উভয় সভাই তখন দীর্ঘস্থায়ী করতালিতে মুখর হয়ে উঠে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, পূর্ব বাংলার জনগণের নির্বাচনে জয়ের পরেই আমাদের বীর প্রতিবেশীদের যে মর্মান্তিক দুঃসময় এসেছে, তা তাদের দুঃখ-দুর্দশার সঙ্গে আমাদেরও একাত্ম করেছে। তাদের সুন্দর দেশের উপর যে ধ্বংসলীলা চলছে, তাতে আমরা উদ্বিগ্ন।

প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পূর্ববঙ্গের সমগ্র জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে দমনের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমদানি করা সশস্ত্র বাহিনীকে সেখানে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের মাধ্যমে সেখানকার জনগণ নির্ভুলভাবে যে বাসনা ব্যক্ত করেছেন, পাকিস্তান সরকার তা মেনে না নিয়ে জনগণের সেই রায়কে অমান্য করার নীতি বেছে নিয়েছেন। পাকিস্তান সরকার আইনসম্মতভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে, ক্ষমতা    হস্তান্তর করতে শুধু অস্বীকারই করেননি, উপরন্তু জাতীয় পরিষদকে তাদের ন্যায্য ও সার্বভৌম ভূমিকা নিতে একতরফা ভাবে বাধা দিয়েছেন। বন্দুক, কামান, ট্যাংক, বিমান ও গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে নগ্ন বলপ্রয়োগের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গের মানুষের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে।

ভারত সরকার ও ভারতের জনগণ সব সময়েই পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ স্বাভাবিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করে এসেছে। একই উপমহাদেশের অধিবাসী হিসেবে ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যের দিক দিয়ে তাদের বন্ধন যুগ যুগ পুরাতন। এই অবস্থায় আমাদের সীমান্তের এত নিকটে যে মর্মান্তিক হত্যালীলা চলছে তাতে সভা উদাসীন থাকতে পারে না। নির্দোষ নিরীহ মানুষের উপর এই যে অভূতপূর্ব ভয়াবহ অত্যাচার চলছে আমাদের দেশের সব অঞ্চলের মানুষ স্বার্থহীন ও দ্বিধাহীন ভাষায় তার নিন্দা করছেন।’’

৪ এপ্রিল নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে তার দেশের উদ্বেগের কথা আবারও উল্লেখ করেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারত নীরব দর্শক থাকতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী শিরোনামের সংবাদে আনন্দবাজার পত্রিকা খবরটি ছিল: ‘প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আজ এখানে নিঃ ভাঃ কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে ঘোষণা করেনঃ ভারতের সীমান্তের ওপারে পূর্ব বাংলায় যা ঘটছে, তাতে ভারতের পক্ষে নীরব দর্শক থাকা সম্ভব নয়- বাঞ্ছনীয় নয়। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সমাপ্তি ভাষণে এই মন্তব্য করায় সদস্যরা বিপুল হর্ষধ্বনি করে ওঠেন।

শ্রীমতি গান্ধী বলেন, ভারত কোন দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কখনও নাক গলায়নি। সেইসঙ্গে বিশ্বের কোন অংশে উৎপীড়ন বা অন্যায় ঘটলে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ জানাতে ভারত কোন দিন কার্পণ্য করেনি। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যা ঘটছে, তা মোটেই স্বাভাবিক নয়। সারা পৃথিবীতে এর প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে।

শ্রীমতি গান্ধী আরো বলেন, এই মুহূর্তে আমরা পূর্ব বাংলার জনগণকে কী ধরনের সাহায্য করতে পারি, তা মাথা ঠাণ্ডা করে আমাদের ভেবে দেখতে হবে।’ কিন্তু বাংলাদেশকে সাহায্য প্রদানে আগ্রহী জনমত ইন্দিরা গান্ধীর এই উদ্বেগ এবং সাহায্যের প্রতিশ্রুতিকে পর্যাপ্ত মনে করেনি। প্রায় প্রতিদিন পত্রিকায় কোনো না কোনো সংগঠন সংবাদ, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বিবৃতি কিংবা লেখা ছাপা হয়েছে যেখানে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের দাবি জোরালো হচ্ছিল।

১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে শতাধিক বিদেশী সাংবাদিকের উপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ তাদের ভাষণে বারংবার বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানিয়েছেন- আপনারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন। আপনারা আমাদের সংগ্রামে সাহায্য করুন। আপনারা ইয়াহিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করুন, যাতে সে তার হানাদার বাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়। (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ এপ্রিল ’৭১)

প্রখ্যাত কথাশিল্পী এবং আনন্দবাজার পত্রিকার তৎকালীন নির্বাহী সম্পাদক সন্তোষকুমার ঘোষ ৩০ এপ্রিল আনন্দবাজারের উপসম্পাদকীয় পাতায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে এক মর্মস্পর্শী চিঠি লেখেন। ‘প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধী বরাবরেষু’ শিরোনামের খোলা চিঠিতে এই খ্যাতিমান কথাশিল্পী লিখেছেন: ‘প্রধানমন্ত্রী, আপনি বাংলাদেশকে এখনও স্বীকৃতি দেননি। জানি না, অন্য কোনো সাহায্য দিয়েছেন কি না। সীমান্তের কয়েকটি অঙ্গনে ঘুরে কোনো প্রকার সাহায্যের বিশেষ কিছু চিহ্ন চোখে পড়েনি। সম্ভবত কূটনৈতিক কাণ্ডজ্ঞান এখনও আপনার হাত বেঁধে রেখেছে। এই সঙ্কোচের মানে বুঝি। কিন্তু দুনিয়ার বাকী সকলে? তারাও বোঝে তো? যতদূর টের পাচ্ছি, সবাই ধরে নিয়েছে, আমরা এর মধ্যে আছি। সেটা যদি রটেই থাকে, তবে আর অহেতুক লজ্জায় কাজ কী? জানি না, আমরা কখনও কোনো ভরসা ও-পারের মুক্তিকামীদের দিয়েছিলাম কি না। হয়তো দিইনি। দিয়ে থাকলে কিন্তু আজ পশ্চাদপসারণের কোনো অর্থ নেই, কোনো ক্ষমা নেই। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির একটি দুটির সক্রিয় হস্তক্ষেপের অপেক্ষা করছেন? যথা, আমেরিকা? আজ স্বতঃই ধারণা হয়, আওয়ামী নেতাদের বুঝি-বা প্রতারিত করেছে আমেরিকাও। পিণ্ডির স্থায়িত্বেই সম্ভবত ভূমণ্ডলের এই ভাগে মারকিন মন আর স্বার্থ আবদ্ধ।  অন্যান্যদের কথা না বলাই ভাল। আওয়ামী লীগ চরিত্রগতভাবে বস্তুত এদেশের প্রাক-স্বাধীনতা কালের কংগ্রেস। জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়া দলের মাধ্যমে এত বড় গণজাগরণ ঘটেছে, এটা কোনো বামপন্থী দেশের বিশ্বাসই হয় না। এদেশেও এই সত্যটা মেনে নিতে প্রগতিবাদীদের খারাপ লাগে। নানা খুঁত তারা বের করেন  আওয়ামী নেতৃত্বের। দলীয় অপ্রস্তুতির, শেখ সাহেবের অন্তর্ধানের। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ত্রুটি ছিল না, একথা বলছি না। দূরদৃষ্টির অবশ্যই অভাব দেখা গেছে। অভাব দেখা গেছে সংগঠনেরও। তবু সব সত্ত্বেও যা ঘটেছে, আজও ঘটছে, তা অবিশ্বাস্য অলৌকিক। ভাষাকে ‘মা’ বলা, সেই মায়ের ভিতর দিয়ে দেশকে মাতৃরূপে গ্রহণ করা এসব সহজ ধারণায় অতীত। পৃথিবীতে মানুষ এযাবৎ বহু যুদ্ধ করেছে। করেছে নিজের জিগীষা মেটাতে, করেছে নারীর জন্য। আর্থনীতিক শোষণের বিরুদ্ধেও করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের সংগ্রাম এ তো শুধু অর্থনীতির জন্য নয়, এ যে সংস্কৃতির জন্য! সাহিত্য আর সংস্কৃতির কি এত শক্তি? আমরা যারা সাহিত্য-সংস্কৃতি ভাঙিয়ে খাই, তারাও এতটা জানিনি। না আমাদের মধ্যে, না অন্যত্র এর পরিচয় পাইনি।…’

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ভারতের বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা তখন সামগ্রিক পরিস্থিতি কিভাবে মূল্যায়ন করেছেন এটি হচ্ছে তার সাধারণ চিত্র। এই লেখায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের চাপও স্পষ্ট। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের বিষয়টি সরকারীভাবে ভারতের বিবেচনায় ছিল না। বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হচ্ছিল এভাবে যে, ভারত বাংলাদেশের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চায়। ইয়াহিয়ার উচিৎ নির্বাচিত গণ প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই ভারত গণহত্যার নিন্দা জানিয়েছে কঠোর ভাষায়, বাংলাদেশের সহায় সম্বলহারা মানুষদের জন্য সীমান্ত খুলে দিয়েছে, মুক্তি সংগ্রামীদের সাহায্য করছে কিন্তু স্বীকৃতিদানের বিষয়টি সেই মুহূর্তে ভারতের জন্য খুবই স্পর্শকাতর ছিল। কারণ ২৬ মার্চের পর থেকেই পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলো এবং গণচীন বাংলাদেশের সমস্যাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা মনে করেছে এবং ভারতের ‘উষ্কানিমূলক’ আচরণের সমালোচনা করেছে।

 


৪ এপ্রিল যুগোশ্লাভ সংবাদ সংস্থা তানযুগ-এর সংবাদদাতা পিকিং থেকে জানাচ্ছে, ‘চীনা পত্রিকাগুলি এই প্রথম বাংলাদেশ সম্পর্কে খবর দিয়েছে। তারা কোনো মন্তব্য করেনি, কিন্তু এমনভাবে তথ্য প্রকাশ করেছে, যা থেকে মনে হয় যে, সেখানকার (বাংলাদেশের) পরিস্থিতি গুরুতর ও জটিল। ভারত পাকিস্তানের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে- পাকিস্তানের এই অভিযোগ চীনা পত্রিকাগুলি ফলাও করে ছেপেছে।’ (আনন্দবাজার পত্রিকা ৫ এপ্রিল ’৭১)

বৃটিশ পার্লামেন্টেও ৩১ মার্চ শ্রমিক দলের এমপি পিটার শোর যখন বাংলাদেশের মানুষের উপর ইয়াহিয়া খান সরকারের বর্বর অত্যাচারের প্রতিবাদ জানান এবং এ ব্যাপারে অনেক ইংল্যান্ডবাসীর ক্ষোভের কথা পাকিস্তানকে জানাবার জন্য পররাষ্ট্র সচিব স্যার আলেক ডগলাস হিউমকে অনুরোধ করেন, তখন স্যার আলেক গণহত্যার ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ কললেও এ কথা তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছেন, ‘পাকিস্তান একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। পাকিস্তান সরকারের রাজনৈতিক ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাই না।’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২ এপ্রিল ’৭১)

একই ধরনের মত মার্কিন সরকারও তখন পোষণ করতো। ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শদাতারা জানিয়েছেন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলো ছাড়া যেহেতু বিশ্বের সকল গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র মার্কিন প্রচারণার প্রভাবে এটা বিশ্বাস করত যে, ভারত সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে গোলযোগ সৃষ্টি করছে সেজন্য তাদের ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানে বিলম্ব করেছে। ইন্দিরা গান্ধীর এই মনোভাবকে কোনো কোনো বিরোধী রাজনৈতিক দল কিংবা পত্রিকার কলাম লেখক সুনজরে দেখেননি, সন্তোষকুমার ঘোষের মতো কংগ্রেস সমর্থকও যেমন তীর্যক মন্তব্য করেছেন। ইন্দিরা গান্ধীর এ ক্ষেত্রে করার কিছু ছিল না। পরে প্রমাণিত হয়েছে তিনি তড়িঘড়ি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে পাকিস্তানের অভিযোগ সত্য প্রমাণ হতো, পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল হতে পারতো যা সামাল দেয়া ভারতের পক্ষে খুবই কঠিন হতো।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃতিদানের জন্য প্রথম থেকেই ভারতের ওপর চাপ দিচ্ছিল। ৬ মে স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচার করা হয়: ‘ভারত এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে।’ এর আগে  বাংলাদেশ  সরকারের  এক  মুখপাত্র  আনন্দবাজার  পত্রিকার  প্রতিনিধিকে জানিয়েছিলেন, ‘আগামী সাত দিনের মধ্যেই অন্তত চারটি দেশ নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে। এই দেশগুলি হলো- এশিয়ার সিঙ্গাপুর ও বার্মা এবং ইউরোপে ফ্রান্স ও যুগোশ্লাভিয়া। ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার স্বীকৃতিও মন্ত্রিসভা আশা করছেন।’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ এপ্রিল ’৭১)

(আগামী পর্বে সমাপ্য)

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ ডিসেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়