শুধু ধন দিয়ে জনগণকে তুষ্ট রাখা যায় না, মানও দিতে হয় সমভাবে
চিত্রকর্ম: সমর মজুমদার
|| মিনার মনসুর ||
বাংলা ও বাঙালির শত শত বছরের ইতিহাস ঘেঁটে ১৬ ডিসেম্বরের সঙ্গে তুলনীয় বা তার কাছাকাছি পর্যায়ের একটি দিনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেজন্যে আমার মনে হয়, একুশে ফেব্রুয়ারি নয়- এমনকি ছাব্বিশে মার্চও নয়- বাঙালির ইতিহাসের মহত্তম দিনটি হলো ১৬ ডিসেম্বর। সেদিনই প্রথমবারের মতো বাঙালি বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছিল যে আমরা পারি। প্রকৃত অর্থে সেদিনই যুগ-যুগান্তরের পরাধীন পরাশ্রিত বাঙালি প্রথমবারের মতো পা রেখেছিল নিজের মাটিতে। যে-মাটির নাম স্বাধীনতা। বললে অত্যুক্তি হবে না যে, বাঙালির সহস্র বছরের স্বাধীনতার সাধনাও পূর্ণতা পেয়েছিল সেদিনই। তবে শুধু এটুকু বললেই সবটা বলা হয় না। সেই সঙ্গে অতি জরুরি যে-কথাটি না বললেই নয় তা হলো, লালসবুজ পতাকা উড়িয়ে আজ যে বাংলার অদম্য তরুণ-যুবকেরা নানা ক্ষেত্রে ক্রমাগত বিশ্বকে চমক দেখিয়ে চলেছে-দিগন্তস্পর্শী সেই সম্ভাবনারও দ্বারোদ্ঘাটন হয়েছিল সেই ১৬ ডিসেম্বরেই। আর যার অতুলনীয় নেতৃত্বের জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় এ অসম্ভব সম্ভব হয়েছিল তার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিই আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে সফল বাঁশিওয়ালা।
গ্লানির বিষয় হলো, বিশাল এ বিজয়ের গৌরবকে খাটো করার জন্যে এখনো নানা জন নানা কথা বলেন। যারা বলেন তারা বিদেশী বা বহিরাগত নন। তারাও এদেশের আলো-হাওয়ায় বেড়ে উঠেছেন। তার চেয়েও পরিতাপের বিষয় হলো, বিজয়ের সুফল যারা সবচেয়ে বেশি ভোগ করেছেন-এক জীবনেই হস্তগত করে নিয়েছেন সহস্র জীবনের ধন-সম্পদ- তারাই বেশি বলেন। এ বিজয়কে ছিনিয়ে আনার জন্যে যারা নিজের জীবন, সম্ভ্রম সবই বিলিয়ে দিয়েছেন অকাতরে-তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। গোপনে পদচুম্বন করেন জন্মলগ্নেই এ দেশটিকে যারা হত্যা করতে চেয়েছিল সেইসব ঘাতক-ধর্ষক-কুলাঙ্গারদের। এদের সম্পর্কেই কয়েক শ বছর আগে সন্দ্বীপের কবি আবদুল হাকিম (১৬২০-১৬৯০) বড় খেদের সঙ্গে লিখেছিলেন: ‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ বাংলাদেশের বিপদ অনেক। তার মধ্যে অন্যতম বড় বিপদটি হলো, এ মানুষগুলো। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের স্বজনের রক্তস্নাত দিনগুলোতেও এদেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ বাংলাদেশের স্বার্থের বিপক্ষে ছিল। সংখ্যাটি যে মোটেও উপেক্ষা করার মতো নয় তা গত কয়েক দশকের (চুয়ান্নের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন থেকে শুরু করা যেতে পারে) নির্বাচনের ফলাফল বিবেচনায় নিলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। এ ভোটাররা যে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের গলায় মালা দিতেও প্রস্তুত তাও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি পঁচাত্তরপরবর্তী বছরগুলোতে।
সুযোগ পেলেই যারা নিজের দেশকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন এবং উঁচুগলায় বলেন, বাংলাদেশ তাদের কিছুই দেয়নি- তারা মূলত জ্ঞানপাপী। তাদের আনুগত্য অন্য কোথাও, অন্য কারো কাছে। সেটা আড়াল করার জন্যেই তারা বাংলাদেশের বিজয় বা স্বাধীনতাকে ব্যর্থ প্রমাণ করার চেষ্টা করেন নানাভাবে। যে যাই বলুন না কেন, ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। আর সেই পরিবর্তন কতো ব্যাপক তা বোঝার জন্যে একটি উদাহরণই যথেষ্ট বলে বিবেচিত হতে পারে। বাংলাদেশের প্রথম বাজেটের আকার যেখানে ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা, সেখানে বাংলাদেশ এখন শুধু পদ্মা সেতুর পেছনেই ব্যয় করছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। আর এ অর্থের পুরোটাই তার নিজের। শুধু তাই নয়, অবিভক্ত বাংলার যে-অংশটি ভারতের ভাগে পড়েছে সেই পশ্চিমবঙ্গকে শুধু নয়, সমগ্র ভারতকেও সামাজিক উন্নয়নের অনেক ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। এ মন্তব্য নোবেলবিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের। অতএব, বিজয় বা স্বাধীনতা আমাদের কিছুই দেয়নি- এ কুতর্ক উপেক্ষণীয় শুধু নয়, ঘৃণার সঙ্গে পরিত্যাজ্যও বটে।
সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের গলায় যারা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র তকমা ঝুলিয়ে দিয়েছিল- যারা বলেছিল এ দেশটির কোনো ভবিষ্যৎ নেই- তারাই এখন সেই দেশটির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বলছেন, বাংলাদেশ যেভাবে এগুচ্ছে এটা ‘ম্যাজিক’ ছাড়া কিছু নয়। দারিদ্র্যের জীর্ণবসন ছুড়ে ফেলে দ্রুত গতিতে দেশ যে মধ্যম আয়ের তুলনামূলকভাবে সম্মানজনক জীবনমানের দিকে এগিয়ে চলেছে তার বহু উদাহরণ এখন চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে। মানুষের গড়পড়তা আয় এবং আয়ু দুটোই বেড়েছে। উত্তরাঞ্চলের দীর্ঘদিনের মঙ্গা এখন ইতিহাসের অন্তর্গত হতে চলেছে। একইভাবে দক্ষিণাঞ্চল থেকে চিরবিদায় নিয়েছে ডায়রিয়াজনিত মৃত্যু। তবে বাংলাদেশের এ সমৃদ্ধিযাত্রাকে বোঝার জন্যে অর্থনৈতিক-সামাজিক পরিসংখ্যানের চেয়েও নির্ভরযোগ্য মানদণ্ডটি হলো মানুষের জীবনযাপন, পোশাকআশাক ও মুখাবয়ব। অপ্রচলিত এ তিনটি সূচকই আপনাকে বলে দেবে যে, ইতোমধ্যে একাত্তরকে তারা অন্তত একশ বছর পেছনে ফেলে এসেছে। সর্বোপরি, তারা ক্লান্ত নয়, তুষ্টও নয়। আরও অনেক দূর যাওয়ার জন্যে তারা টগবগ করছে।
সম্ভাবনার কথা যদি বলি, অসীম দিগন্তই তার সীমানা। প্রায় সব হিসাবনিকাশই বলছে যে, অপরিমেয় সম্ভাবনার ডালা সাজিয়ে সোনালি এক ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের জন্যে। আছে কর্মক্ষম বিশাল এক যুবশক্তি- যারা দেশেবিদেশে যেকোনো চ্যালেঞ্জ গ্রহণে প্রস্তুত। প্রকৃতি ও সংস্কৃতিগতভাবে বৃহৎ বিনিয়োগের জন্যে আবহাওয়া খুবই অনুকূল। দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিই ব্যবহারযোগ্য। জমি ও শ্রম দুটোই তুলনামূলকভাবে সস্তা। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো। প্রকৃতিদত্ত সম্পদও একেবারে কম নয়। গ্যাস যা আছে একেবারে মন্দ নয়। মিঠেপানির মূল্য এখনো আমরা তেমন বুঝি না বটে, তবে এদিক থেকেও বিশ্বে আমাদের অবস্থান ঈর্ষণীয়ই বলা যায়। এত উর্বর জমি-জলাভূমিও বিশ্বে খুব বেশি নেই। এখানে বীজ ছিটালেই শস্য হয়। প্রাকৃতিকভাবেই মাছে ভরে থাকে খাল-বিল-জলাশয়। আর বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় সমপরিমাণ সমুদ্রসম্পদের বিশাল ভাণ্ডার তো এখনো অকর্ষিতই রয়ে গেছে। প্রসঙ্গত লক্ষণীয় যে নানা কারণে জমি জলাভূমি কমছে, কিন্তু বিস্ময়করভাবে শস্য, সবজি ও মাছ উৎপাদনে বিশ্বরেকর্ড করে চলেছে বাংলাদেশ। এখানে আলাদীনের চেরাগটি হলো আমাদের সর্বংসহা কৃষক। এটিও কম গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ নয় বাংলাদেশের।
তারপরও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিঃসংশয় হওয়া কঠিন। এ দেশের অগ্রযাত্রার পথে বাধাও অনেক। তার মধ্যে প্রধান একটি বাধার কথা আগেই বলেছি। ঐতিহাসিকভাবে জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ বাংলাদেশের মূল্যবোধে বিশ্বাসী নয়। মজ্জাগতভাবে তাদের পাকিস্তানপ্রীতি প্রবল। এর কারণ যতটা না ধর্মীয়, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক বলে আমার মনে হয়েছে। বিভেদের এ জায়গাটিতে দেশি-বিদেশি প্ররোচনার প্রবল হাওয়া এসে লাগছে। বিশ্ব যেভাবে ক্রমেই সহিংস হয়ে উঠছে এবং পরাশক্তিগুলো নিজেদের স্বার্থে ধর্মীয় উগ্রবাদকে যেভাবে উসকে দিচ্ছে- তা থেকে বাংলাদেশ কতদিন নিজেকে মুক্ত রাখতে পারবে বলা কঠিন। অন্যদিকে অধিকতর ভয়ের কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ক্রমবর্ধমান হারে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার। বললে অত্যুক্তি হবে না যে, প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় এখন তা যেভাবে ডালপালা বিস্তার করছে, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানেও তেমনটা দেখা যায়নি। অথচ যাদের হাতে ষ্টিয়ারিং তারা এ ব্যাপারে তেমন সচেতন বলে মনে হচ্ছে না।
দ্বিতীয় প্রধান চ্যালেঞ্জটি হলো, নাজুক রাজনৈতিক ব্যবস্থা। স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার ছিল গণতন্ত্র। অথচ দেশ স্বাধীন হওয়ার দীর্ঘ সাড়ে চার দশক পরেও আমরা গণতন্ত্রকে টেকসই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারিনি। নিশ্চিত করতে পারিনি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া। ফলে যতবারই নির্বাচন ঘনিয়ে আসে, ততবারই অনিবার্যভাবে বাড়তে থাকে অনিশ্চয়তার ঝড়ো হাওয়া। এতে শুধু যে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয় তাই নয়, অনেক সময় সামরিক শাসনের মতো বিপর্যয়ও নেমে আসে গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর। আর সেটার ক্ষতি ও ক্ষত সামলে উঠতে লেগে যায় বছরের পর বছর। রাজনীতিকরাই এ ধরনের বিপর্যয়ের প্রধান ভুক্তভোগী হওয়া সত্ত্বেও অজ্ঞাত কারণে তারা এ অনিশ্চয়তার কুজ্ঝটিকা ছিন্ন করতে তেমন আগ্রহী বলে মনে হয় না।
তৃতীয় প্রধান চ্যালেঞ্জটি নিঃসন্দেহে ন্যায্যতা ও সুশাসনের অভাব। এটা ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের গর্ভজাত। এদেশের রাজনীতিকরা ও জনগণ বংশপরম্পরায় এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, স্বীকার করেছে বিপুল ত্যাগ। এসব আন্দোলন ও আত্মত্যাগের ফলশ্রুতি হিসেবে দুবার আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি-প্রথমে পাকিস্তান, পরে বাংলাদেশ। কিন্তু চরম পরিহাসের বিষয় হলো, পরিস্থিতি একটুও বদলায়নি। বরং দিনে দিনে অন্যায্যতা ও অপশাসনের ফাঁস আরও শক্তভাবে চেপে বসেছে জনগণের গলায়। ফলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপুল উন্নয়ন সত্ত্বেও তারা শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। হাঁসফাঁস করছেন। এ অবস্থাটা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর নাজুক গণতন্ত্রের জন্যে মোটেও স্বস্তিকর নয়। কারণ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি এর সুযোগ নেওয়ার জন্যে ওত পেতে থাকে। এ উপমহাদেশের শতবর্ষের অভিজ্ঞতা বলে, অন্যায্যতা ও অপশাসনের প্রধান সুফলভোগী হলো আমলাতন্ত্র আর এর ভিকটিম বা ভুক্তভোগী হলেন রাজনীতিকরা। তাদের বদনাম হয়েছে। ভোগ করতে হয়েছে অবর্ণনীয় নিপীড়ন। কিন্তু তারপরও কেন তারা অন্যায্যতা ও অপশাসনের এ ঔপনিবেশিক ‘সিস্টেম’ টিকিয়ে রেখেছেন তা তারাই ভালো বলতে পারবেন। আমরা কেবল সাধারণ মানুষের কথাই বলতে পারি। রাজকীয় কায়দায় পাইকপেয়াদা দিয়ে ঠেলেঠুলে তাদের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকিয়ে দেওয়া হয় এবং তাদেরকে যখন প্রতিনিয়ত নানাভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে তোমরা ‘প্রজা’ মাত্র, তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো বিশ্বনন্দিত ব্যবস্থার ভিতও ধসে পড়ে। সর্বোপরি, এ ধরনের আচার-আচরণ কোনোভাবেই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে যায় না।
এবারের বিজয় দিবসের মূল বার্তাটি হলো, শুধু ধন দিয়ে জনগণকে তুষ্ট রাখা যায় না, মানও দিতে হয় সমভাবে। এ মান রক্ষার জন্যেই সূর্যসেন-প্রীতিলতারা জীবন বাজি রেখে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়েছে, বঙ্গবন্ধুর ডাকে অকাতরে জীবন ও সম্ভ্রম বিসর্জন দিয়েছে এদেশের লাখো নারী-পুরুষ। অতএব, চেতনার সেই মৌলিক ভিত্তি উপেক্ষা বা অগ্রাহ্য করে উন্নয়নের যত বড়ো প্রাসাদই বানানো হোক না কেন তা টেকসই হবে বলে মনে হয় না।
ধানমন্ডি: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭
লেখক: কবি ও সাংবাদিক
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ ডিসেম্বর ২০১৭/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন