ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

মানবিক মোনাজাতউদ্দিন এবং তাঁর খবরের নায়কেরা

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৫, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মানবিক মোনাজাতউদ্দিন এবং তাঁর খবরের নায়কেরা

মোনাজাতউদ্দিন এবং তাঁকে নিয়ে লেখা বইয়ের প্রচ্ছদ

|| রফিকুল ইসলাম মন্টু ||

খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে কতটা মানবিক হওয়া যায়, কতটা মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়া যায়, তার বিরল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন। গভীরের তথ্য সংগ্রহে এটা ছিল তাঁর ভিন্ন কৌশল। খবরের সন্ধানে তিনি গ্রামের পর গ্রাম হেঁটেছেন, মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন, তুলে এনেছেন গভীরের গল্পগুলো। আর সেই গল্পই খবর আকারে যখন কাগজে ছাপা হয়েছে, তখন পাঠকের মন ছুঁয়ে গেছে। মৃত্যুর ২২ বছর পরেও মোনাজাতউদ্দিনের বহু চরিত্র পাঠকের মনে আছে। খবরের চরিত্র-নায়ক কিংবা পাঠক সবার মাঝেই বেঁচে আছেন গ্রামীণ সমাজ গভীর থেকে তুলে আনা এই সাংবাদিক।

আজ ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৭। চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের ২২তম মৃত্যু বার্ষিকী। এত বছর পরেও তাঁর মৃত্যু সংবাদটি যেন এখনও একেবারেই তরতাজা। বিশ্বাসই হতে চাইছে না বাস্তবে এই মানুষটি এখন আর নেই। বাস্তবে না থাকলেও সবার মাঝেই তিনি আছেন। তথ্য সংগ্রহের কলাকৌশল, সংবাদ লেখার ধরণ, উপস্থাপন, আমাদের প্রতিনিয়ত শেখায়। আমরা উদ্বুদ্ধ হই। তাঁর লেখাগুলো পড়ে এখনও অনুপ্রাণিত হই। নতুন কিছু করার প্রেরণা পাই। একই সঙ্গে মোনাজাতউদ্দিনের সৃষ্টি করা চরিত্রগুলো সংবাদের সূত্র অনুসন্ধানের পথ দেখায়। সংবাদ লেখায় তাঁর চর্চার সেই ধারা অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে।

চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন বাল্যকালে মুকুলফৌজের কর্মী হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। আর সংবাদকর্মে যাত্রা শুরু হয় ‘বগুড়া বুলেটিন’-এ লেখালেখির মধ্য দিয়ে। পর্যায়ক্রমে লেখালেখির চর্চা বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে ১৯৬২ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক আওয়াজ’-এর স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৬৬ সালে উত্তরাঞ্চলের সংবাদ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন ‘দৈনিক আজাদ’-এ। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে নিজের সম্পাদনায় রংপুর থেকে বের করেন ‘দৈনিক রংপুর’। এক সময় ‘দৈনিক পূর্বদেশ’-এ কাজ করেছেন। তৎকালীন বহুল প্রচারিত ‘দৈনিক সংবাদ’-এ কাজ করার প্রবল ইচ্ছা ছিল মোনাজাতউদ্দিনের। এজন্য বহুদিন ধরে চেষ্টাও করছিলেন।

গ্রাম সাংবাদিকতার পথিকৃৎ মোনাজাতউদ্দিন ‘দৈনিক সংবাদ’-এর উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ পান ১৯৭৬ সালে। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত টানা কুড়ি বছর সেখানেই কাজ করেন। সে কারণে মোনাজাতউদ্দিনের জীবনের সবচেয়ে বেশি এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনগুলো এই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়। ঢাকার বাইরের সাংবাদিকদের মজুরি বৈষম্য এখনকার মতো সেকালেও ছিল। ৪ জুন, ১৯৭৬ তারিখে ‘দৈনিক সংবাদ’ থেকে পাওয়া নিয়োগপত্রে উত্তরাঞ্চলীয় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে মোনাজাতউদ্দিনের বেতন ছিল মাত্র ৫০০ টাকা। বহুমূখী টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে ‘দৈনিক সংবাদ’-এ কুড়িটি বছর অতিবাহিত করেছেন তিনি। অবশেষে ১৯৯৫ সালের ২৪ এপ্রিল তিনি ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’-এ সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন তিনি। একই বছর ২৯ ডিসেম্বর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেখানেই কর্মরত ছিলেন।

উত্তরের ১৬ জেলা ছিল মোনাজাতউদ্দিনের কর্মক্ষেত্র। বহু মানুষ তাঁকে চিনতেন, কারও সঙ্গে সরাসরি পরিচয়, কারও সঙ্গে নামে। বেঁচে থাকার সময় তিনি কারও কারও কাছে আতঙ্কের ছিলেন, আবার কারও কাছে ছিলেন পরম বন্ধু। কোন এলাকায় মোনাজাতউদ্দিন এসেছেন মানে, বহু মানুষের ভিড় অভাব অভিযোগের খবর নিয়ে। অন্য সাংবাদিকদের কাছে যে বিষয়গুলো সাধারণত খবরের বিষয় হয়ে উঠতো না, ব্যতিক্রমী দৃষ্টির এই সাংবাদিকের কাছে সেটাই ছিল খবর। তাইতো শহুরে গণ্ডির অনেক বড় খবরের ভিড় ঠেলে মোনাজাতউদ্দিনের কলমে গ্রামের অনেক ছোট কিন্তু মানবিক খবর জায়গা করে নিয়েছে জাতীয় পত্রিকার প্রথম পাতায়। সূক্ষ্ম দৃষ্টির এই সাংবাদিকের চোখ এড়াতো না কিছুই। এক একটি চরিত্রের মুখমণ্ডলের বর্ণনা থেকে শুরু করে হাড়ির খবর পর্যন্ত, সবই উঠে আসতো তাঁর খবরে। তাইতো প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষেরাও মোনাজাতউদ্দিনকে আপন করে নিয়েছিলেন। বিশেষ গুণে, বিশেষ কৌশলে তিনি মানুষের মাঝে ঢুকেছেন।

মোনাজাতউদ্দিনের খবরের নায়কেরা কেমন আছেন? কতটা পূরণ হয়েছে তাদের স্বপ্ন? আর খবরের নায়কদের দৃষ্টিতে মোনাজাতউদ্দিনই বা কেমন মানুষ ছিলেন? ছোট কয়েকটি প্রশ্ন সামনে রেখে উত্তরের জনপদ ঘুরে মোনাজাতউদ্দিনের কিছু চরিত্রের সঙ্গে আলাপ করেছিলাম। খবরে যে মানুষটির ছবি দেখেছি, গল্প পড়েছি, বাস্তবে সেই মানুষটি কেমন? জানার প্রবল ইচ্ছে ছিল। সন্ধানে দেখি, সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে মানুষেরাও। চরিত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করেছি, তিনি কী কৌশলে সংবাদ সংগ্রহ করতেন। জানতে চেয়েছি আলাপচারিতার বিষয়াদি। বুঝতে চেয়েছি ওই সময় থেকে এই সময়ে কী পরিবর্তন এসেছে। বাধার প্রাচীর ভাঙতে পারেননি জয়পুর হাটের পাঁচবিবি উপজেলার সেই সময়ের কিশোর আহসান হাবীব। আলাপের সময় মোনাজাতউদ্দিনের কথা মনে করে কেঁদে ফেলেন আহসান হাবীব। কথাতেই বুঝতে পারি, তথ্য সংগ্রহের সূত্রে গড়ে ওঠা তাদের সম্পর্ক ছিল বেশ নিবিড়।

১৯৭৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ‘দৈনিক সংবাদ’-এ তখনকার কিশোর আহসান হাবিবের স্বপ্নের গল্পটি উঠে এসেছিল মোনাজাতউদ্দিনের ‘উত্তরের পাঁচালী’ সিরিজে। এতে মোনাজাতউদ্দিন লিখেছিলেন:

‘জয়পুরহাট শহরে দেখা উজ্জল মুখ কিশোর আহসান হাবীবের সাথে। সতেরো বছর বয়সের হাবীব পাঁচবিবি উচাই হাইস্কুল থেকে এবার এসএসসি পরিক্ষা দেবে। ওর বাবা ইউনিয়ন পরিষদ অফিসের সেক্রেটরি। হাবীবকে বলেছিলাম, তোমার সমস্যা তোমাকেই সমাধান করতে হবে। তোমার মতো তরুণ যুবকদের দিকেই তো তাকিয়ে আছে দেশ। গ্রামের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে এগিয়ে এসো। হাবীব চঞ্চল হলো। অনেক কথা যেন একসাথে সে বলতে চায়। পারলো না। শুশু বললো- আমিও এসব চিন্তা করি, চিন্তা করে মাথা খারাপ হয়ে যায় কিন্তু কিছুই করতে পারি না। কেননা, সমাজ যে বিরাট বাঁধা। এমনি সংলাপেও আমার মনে আশা জেগেছে। আজ না হোক, কাল সমাজের এই অদৃশ্য বাধাটা থাকবে না। হাবীব সব বাধার প্রাচীর ভেঙে দেবে। সে পারবে। কেননা, আজকের অবস্থাটা সে অন্তত বুঝতে পেরেছে, নিজকে দেখতে পাচ্ছে নিজের আয়না। হাবীব বলেছিল, আমি আমার গ্রামে একটা সমবায় সমিতি গড়বার আশারাখি। এ সমিতি হবে ভূমিহীনদের। তাদের বাঁচিয়ে রাখতে হলে এছাড়া অন্য উপায় নেই।’

আহসান হাবীবের সঙ্গে পাঁচবিবি উপজেলা সদরে আমার দেখা হয়েছিল। কতটা পেরেছেন আহসান হাবীব? তা-ই জানতে চেয়েছিলাম। সাতাত্তরের প্রতিবাদী তরুণ আহসান হাবীব ৪০ বছরেও সামাজিক বাধার প্রাচীর ভাঙতে পারেননি। চাকরি না করে এলাকার ভূমিহীনদের নিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলেন। পিছিয়ে পড়া এই মানুষদের নিয়ে সমিতি গড়ার ইচ্ছা ছিল। যুবকদের নিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দারিদ্র্য আর সামাজিক নিয়ম-নীতির কাছে হার মানতে হয়েছে তাকে। হাবীব জীবিকার তাগিদে ইউনিয়ন ভূমি অফিসে চাকরি নিয়েছিলেন। হয়তো তার বয়স এখন অবসরের কিনারে। সাতাত্তর সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা থাকলেও দারিদ্র্য তাকে পিছিয়ে দিয়েছে। অর্থ সংকটে পরীক্ষা দিতে হয়েছে পরের বছর। কিছুটা বিলম্বে একাশি সালে এইসএসসি পাস করেন। বিএ অধ্যায়ন করলেও পরীক্ষা দিতে পারেননি। স্কুল থেকে শুরু কলেজ জীবনে একইভাবে সংগ্রাম চালিয়েছেন তিনি। এসএসসি পরীক্ষার খরচ যোগাতে পাঁচবিবিতে পত্রিকার এজেন্সি খুলেছিলেন হাবীব। নিজের রোজগারের টাকা দিয়েই এইসএসসির ফরম পূরণ করেন।

তরুণ বয়সে মোনাজাতউদ্দিনকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি হাবীব। হাবীবের তরুণ বয়সে জয়পুরহাটে অনেক ভূমিহীন ছিলেন। তারা পদে পদে বঞ্চিত হতেন। মালিকের কৃষি জমি আবাদ করেও ন্যায্য পাওনা পেতেন না তারা। সেই বঞ্চনা থেকেই ভূমিহীনদের নিয়ে সমিতি গড়ার চিন্তা আসে হাবীবের মাথায়। একাশি সালে ভূমিহীনদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন তিনি। সমিতির নাম দেওয়া হয় ‘উচাই ভূমিহীন সমিতি’। সমিতির নামে জমি ও মজা পুকুর বর্গা নেওয়া হতো। ফসল ফলানো আর মাছ চাষ থেকে পাওয়া অর্থ থেকে মালিকের ভাগ বুঝে দিয়ে বাকি অর্থ ভূমিহীনেরা নিতের সমান ভাগে। হাবীব জানান, সে সময় এলাকার ভূমিহীনেরা কাজ পেতো না। এ এলাকায় বছরে একটি ফসল হওয়ায় ক্ষেতমজুরদের কাজের অভাব ছিল। তাদের খুবই দুর্দিন ছিলো তখন। কিন্তু তাদের নিয়ে তখন কেউ ভাবতো না। অন্যান্য ক্ষেত্রে স্থানীয় উদ্যোগের অভাব ছিল। এসব দিক বিবেচনা করেই চাকরি না করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন হাবীব। চোখের জল মুছতে মুছতে তিনি বলেন, ‘আমি সে কথা রাখতে পারিনি। এই সমাজ আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে দেয়নি।’

 

সংবাদের জন্য মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করছেন মোনাজাতউদ্দিন


হাবীব জানান, এই সমিতি গড়তে গিয়ে নানা বাধার মুখে পড়েন তিনি। কুচক্রী মহল তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। নানাভাবে হয়রানি করা হয় তাকে। ফলে সমিতি গড়ায় নিরুৎসাহিত হয়ে পড়লেও পরের বছর যুবকদের নিয়ে একটি ক্লাব গড়ে তোলেন হাবীব। নাম দেন ‘উচাই সূর্যতরুণ সংঘ’। যুবকদের পড়াশোনায় উৎসাহিত করা আর খেলাধুলার চর্চাই ছিল এর উদ্দেশ্য। যুবকদের নিয়ে এগিয়ে যান হাবীব। চাকরিতে যোগদানের আগ পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যান। এখনও এলাকার যুবকদের আলোকিত মানুষ গড়ার তাগিদ তার। অবসরে তাই যুবকদের কাছেই ছুটে যান। চাকরি আর ক্ষুদ্র ব্যবসা থেকে সহায় সম্বলহীন মানুষকে সাহায্য করেন তিনি। শীতে কিছু শীতবস্ত্র কিনে দেন, দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের বইখাতা কিনে দেন। নিজের কষ্টের কথা উপলব্ধি করে প্রতিবছর এসএসসি পরীক্ষার আগে ফরম পূরণে সহায়তা করেন।

সামাজিক নানা সংকটের সাক্ষী হাবীব বলেন, ‘কষ্ট করে পারিবারিক আর্থিক সংকট হয়তো কাটানো যায়, কিন্তু সামাজিক বাধা অতিক্রম করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। স্বাধীনতার পরের কয়েক বছর দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল না। সমাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য সামাজিক সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। স্থানীয় প্রভাবশালীদের দাপট ছিল অনেক বেশি। ছিল শিক্ষার অভাব, সচেতনতার অভাব। যোগাযোগ সংকটে প্রতিটি এলাকা ছিল চরম অবহেলিত। কাজ করার ক্ষেত্রে সেইসব বাধাই পিছিয়ে দিয়েছে। উদ্যোমীরা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা পূরণ হয়নি।’ 

প্রতিবাদী যুবক আহসান হাবীব ইউনিয়ন ভূমি অফিসে সহকারী ভূমি কর্মকর্তা পদে চাকরি করছেন। কর্মস্থল ক্ষেতলাল উপজেলার মামুদপুরে। এ চাকরিতে যাওয়ার আগে বিরাশি সালের শেষ দিকে রেডিও বাংলাদেশ রংপুরে অনুষ্ঠান উপস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেন কিছুদিন। উচাই বাজারে নিজের বাড়িতেই থাকেন তিনি। কথা বলতে বলতে হাবীব জানালেন তার স্বপ্নের কথা। বাকি জীবনে আলোকিত মানুষ দেখে যেতে চান। এমন একটা সমাজ চান যেখানে সব মানুষ কাজ করবেন। ঘুনে ধরা সমাজের পরিবর্তন ঘটবে। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর এলাকায় উৎপাদনমূখী কাজে জড়িত হতে চান হাবীব। আর তাতে যুক্ত করবেন এলাকার মানুষদের।

মোনাজাতউদ্দিনের আরেকটি চরিত্র আবদুর রহমান ফকির। জয়পুরহাটের বড় নারায়ণপুর গ্রামের মাঝারি কৃষক ছিলেন তিনি। তাকে নিয়ে মোনাজাতউদ্দিন প্রতিবেদন লেখেন ‘উত্তরের পাঁচালী’র একই সিরিজে। প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। বড় নারায়নপুর গ্রামে আবদুর রহমান ফকিরের বাড়িতে গিয়ে কথা বলি তার সাথে। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারির কোনো এক দুপুরে আমার সঙ্গে যখন তার কথা হয়, তখন তিনি খুবই অসুস্থ ছিলেন। বয়সের ভারে ন্যূয়ে পড়েছিল শরীর। তাকে নিয়ে লেখা মোনাজাতউদ্দিনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়:

‘পাঁচবিবির বড় নারায়ণপুর গ্রামের মাঝারি কৃষক আব্দুর রহমান ফকির। প্রচুর আখ ফলিয়ে এবছর পেয়েছে চিনি মিল থেকে আদর্শ চাষী পুরস্কার। এছাড়াও তিনি আবাদ করেন ধান, আলু, পাট, বেগুন, মরিচ ও নানান শাকসবজি। এবছর ৫০ শতক জমিতে কেবল বেগুন আবাদ করেই পেয়েছেন ৬ হাজার টাকা। উৎপাদিত আখ এ পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে সাতশ’ বিশ মণ, ক্ষেতে আরও পড়ে আছে ২০ গাড়ি আখ, অর্থাৎ প্রায় চারশ ৮০ মণ। আবদুর রহমান ফকির নিজের সম্পর্কে আলাপ করছিলেন, আর তার মুখের পেশীগুলো আনন্দে কাঁপছিল। নিজের সংলাপেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, সাতচল্লিশ বছর বয়সের এ জীবনে এসে আবদুর রহমান ফকির আজ সুখী। তার আজকের এই চোখের পলক ফেলায় জীবন মানে কোন সমস্যা নয়।

তিন ছেলে, চার মেয়ে। আট হাজার টাকা খরচ করে ক’দিন হলো তিনি বিয়ে দিয়েছেন বড় মেয়েকে। বাকি তিনজন স্কুলে পড়ছে। বড় ছেলেটি ইন্টারমিডিয়েট পাস করে বাবার সাথে কৃষি কাজ করছে, দ্বিতীয়জন বিকম ফেল করে চাকরি খুঁজছে, তৃতীয় জন ক্লাস এইটে পড়ছে। কিন্তু দ্বিতীয় ছেলের পরীক্ষায় ফেল, অথচ আবদুর রহমান ফকির মাত্র দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা- এসব কোনো দুঃখ নয়। কেননা, বার বার তিনি আমাকে জানাচ্ছিলেন কথার ফাঁকে ফাঁকে, এবছর আরও তিন বিঘা জমি কিনছি স্যার। ... এক বছরে এদেশের একজন মাঝারি কৃষক আবদুর রহমান ফকির তিনবিঘা জমি বাড়ালেন; কিন্তু কারা এই জমির বিক্রেতা? তারা (১) মনির উদ্দিন; (২) মংলা; (৩) কাজীমুদ্দিন; (৪) আসির উদ্দিন। অর্থাভাব এদের জমি বিক্রি করবার কারণ। ... ফকিরের ফি বছর উন্নতিতে আমি খুশি। ওই ওরা চারজন? ওদের অবনতিতে অবক্ষয়ে কী হবে আমার প্রতিক্রিয়া?’

প্রতিবেদন প্রকাশের এত বছর পরে আমি আবদুর রহমান ফকিরকে খুঁজি। জয়পুরহাট জেলা সদরে বসেই তার অবস্থান জানি। জেলা সদর থেকে অনেক দূরের গ্রাম বড় নারায়ণপুর। সেখানে যাই এবং তার বাড়ি খোঁজ করে বের করি। তখনকার সাতচল্লিশের সঙ্গে আরও ৩৩ বছর যোগ করলে তখন তার বয়স ছিল ৭৭ বছর। বাড়িতে ঢুকেই মনে হলো, বেশ সম্পদশালী মানুষ। জমি চাষাবাদ, ভালো ফলন পাওয়া, জমি কেনা- এভাবে তার সম্পদ বেড়েছে। বিপরীতে বহু মানুষ নিঃস্ব হয়েছে। জমি হারিয়ে পথে বসেছে। বয়সের ভারে ন্যূয়ে পড়া আবদুর রহমান ফকির স্পষ্টই মনে করতে পারছিলেন মোনাজাতউদ্দিনের কথা। মানুষটার গড়ন, চেহারা, আলাপের বিষয় অনেকটাই বলে দিতে পারছিলেন আবদুর রহমান। বিনয়, মানবিক দৃষ্টি আর সাবলীল আলাপচারিতায় খবর সংগ্রহ করতেন তিনি।

‘চিলমারীর একযুগ’ ‘কানসোনার মুখ’ ‘শাহ আলম ও মজিবরের কাহিনী’ ‘লক্ষ্মীটারী’সহ অন্যান্য গ্রন্থগুলোতে মোনাজাতউদ্দিনের বহু চরিত্রের সন্ধান মেলে, যাদের জীবনের গল্পগুলোর গভীর অনুসন্ধান করেছেন তিনি। কোন গ্রামের অবস্থা সম্পর্কে বলতে গিয়ে মানুষকে তুলে এনেছেন সামনে। মানুষ কীভাবে সংকট মোকাবেলা করছে, মানুষগুলো কীভাবে বেঁচে আছেন? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন মোনাজাত। এর সঙ্গে মিলিয়েছেন সরকারি-বেসরকারি কর্মকাণ্ডের সুফল কতটা মানুষের দোরগোঁড়ায় পৌঁছেছে, সে বিষয়টি। তাঁর অনেক লেখায়ই উল্লেখ রয়েছে একই এলাকা কিংবা একই ব্যক্তির কাছে বার বার যাওয়ার কথা। ৫-১০ বছর আগের খবরের সঙ্গে বর্তমানের মিল খুঁজে বেড়াতেন তিনি। হয়তো ৫ বছর আগে কোন নারীর গল্প লিখেছিলেন, হঠাৎ করেই মোনাজাতউদ্দিন মনে করতেন, তার কাছে আবারও তথ্যের জন্য যেতে হবে। এভাবে বহু লেখায় চরিত্রের আগে-পরের অবস্থার তূলনামূলক বিশ্লেষণ করেছেন পাঠক মহলে সারা জাগানো এই সাংবাদিক। বার বার সংবাদের চরিত্রের কাছে যাওয়া এবং মানুষের গল্পের ফলোআপ করা ছিল মোনাজাতউদ্দিনের কাজের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। ‘বিউটির ফলো-আপ’ শিরোনামের লেখায় মোনাজাতউদ্দিন নিজেই লিখেছেন:

‘‘... ছয় বছর আগে একবার জিনারদীতে গিয়েছিলাম। সংবাদে সে সময় লিখেছিলাম, আট পর্বের একটা সিরিজ : ‘জিনারদী সমস্যা ও সম্ভাবনা’ এই শিরোনামে। ’৯৩-এর মার্চে ভাবলাম, আরেকবার যাওয়া যাক না ওই গ্রামে। সে-সময় যেসব সমস্যার কথা লেখা হয়েছিল, সেগুলোর অবস্থা এখন কেমন? সুরাহা হয়েছে কি কোনটার? অনেকে অভিযোগ করে থাকেন, আমাদের সংবাদপত্রগুলোতে ফলো-আপ রিপোর্ট খুব একটা হয় না। মূলত এই কারণে গত দশ বছরে তিনশ’র বেশি ফলো-আপ প্রতিবেদন করেছি আমি। ৪ বছর পর কানসোনা গ্রামে গিয়ে খতিয়ে দেখেছি ওই এলাকার মানুষজনের আর্থ-সামাজিক অবস্থা। আমি ভাবলাম, জিনারদীর ক্ষেত্রেও তাই করা যেতে পারে। ‘জিনারদী ৬ বছর আগে ও পরে’ এই বিষয়ের ওপর আরেকটা সিরিজ করতে পারলে তা হবে আরেকটি দীর্ঘমেয়াদি ফলো-আপ।’’

ফলোআপ প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে কোথাও ৫ বছর পর, কোথাও ৭ বছর পর সরেজমিনে যেতেন মোনাজাতউদ্দিন। সেই মানুষগুলোর সঙ্গে সেই ঘটনার সঙ্গে মিলে যেতেন তিনি। খোঁজ নিতেন, খবর প্রকাশের পর কি পরিবর্তন এসেছে। জিনারদী গ্রামের এমনই একটি ঘটনার উদাহরণ মেলে মোনাজাতউদ্দিনের লেখায়। ’৮৭ সালে ওই গ্রামে গিয়ে সিরাজউদ্দিনের বিকলাঙ্গ মেয়ে বিউটিকে নিয়ে লিখেছিলেন। খবরের সঙ্গে ছাপা হয়েছিল ছবি। ৬ বছর পর খোঁজ নিয়ে দেখেন বিউটির সাহায্যে এগিয়ে আসেনি কেউ। বিউটির বাবার অনুরোধ আবারও বিউটিকে নিয়ে লেখার। মোনাজাতউদ্দিন বিউটিকে নিয়ে আবার লেখেন। তুলে আনেন নতুন ছবি। চরিত্রগুলো ভরসা করে মোনাজাতউদ্দিনের ওপর। যুগে যুগে বিশ্বাস ও আস্থা জন্মায় তার প্রতি।

মোনাজাতউদ্দিনের সেই ধারার সাংবাদিকতা থেকে এখনকার সাংবাদিকতা অনেকখানিই বদলে গেছে। এখনকার সাংবাদিকতা মানে নিজেকে অন্যভাবে উপস্থাপন করা, সবার থেকে একটু আলাদা থাকা। নিজের পরিচয়টা বড় করে দেখানোটাও এখনকার সাংবাদিকতার একটা বিশেষ প্রবণতা। সবার মাঝেই একটা ‘কী হনুরে’ ভাব লক্ষ্যণীয়। কোন কোন সাংবাদিক সংবাদ সম্মেলনে গিয়ে আয়োজকদের নাস্তানাবুদ করে ফেলেন। প্রসঙ্গ না বুঝলেও কয়েকটা অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করা চাই। আবার মাঠের অনেক সাংবাদিককে দেখেছি, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তথ্য জানার আগে তথ্যপ্রদানকারীর নাম-ঠিকানা, বাড়িঘরের বৃত্তান্ত জানতে গিয়েই আতঙ্কিত করে ফেলেন। এইসব প্রতিটি স্তরে মোনাজাতউদ্দিন আমাদের শিক্ষক। দুর্নীতিবাজ-অপরাধীদের খবর লেখায় তিনি যেমন কঠোর ছিলেন, তেমনি সাধারণ মানুষের কষ্ট-বঞ্চনার কথাগুলো তিনি তুলে এনেছেন পরম মমতায়। তাঁর হৃদয়গ্রাহী প্রতিবেদনগুলো পড়লেই বোঝা যায়, তথ্য সংগ্রহকালে তিনি মানুষের সঙ্গে কতটা মিশেছেন। আর ভেতরের তথ্য তুলে আনতে মানবিক হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: উপকূল-সন্ধানী সাংবাদিক, মোনাজাতউদ্দিন স্মৃতি পুরস্কারপ্রাপ্ত




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ ডিসেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়