ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

লোকসংস্কৃতির ধারাবাহিক চর্চা সময়ের দাবি

আনোয়ার হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩২, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
লোকসংস্কৃতির ধারাবাহিক চর্চা সময়ের দাবি

আনোয়ার হক: সবুজ-শ্যামল প্রত্যন্ত গ্রাম-বাংলার আনাচে-কানাচে অনেকটা অবহেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে লোকসংস্কৃতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। আমাদের আত্মপরিচয়ের মূলে রয়েছে লোকজ সংস্কৃতি তথা ঐতিহ্যের বিভিন্ন উপাদান। নিজস্বতায় ভরা এসব উপাদানই আমাদের শেকড়, আমাদের এগিয়ে চলার মূল প্রেরণা।

বাঙালির ঐতিহ্যবাহী জীবনঘনিষ্ট নানা উপাদান নিয়ে ধারাবাহিক কাজ করার অভিপ্রায়ে মূলধারার সংস্কৃতি বিকাশের লক্ষ্যেই মূলত কাজ শুরু করি আমরা। সময়ের চাহিদায় এক পর্যায়ে গড়ে ওঠে জাতীয়ভিত্তিক সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠন ‘দিয়াড়’। হাঁটি হাঁটি পা পা করে সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুতের জন্য চলছে সাংগঠনিক নানা কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠার প্রথম ও দ্বিতীয় বছরে বাঙালির প্রাণের উৎসব বাংলা বর্ষবরণসহ বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে আয়োজন করা হয় সাহিত্য-সংস্কৃতির আড্ডা, আনন্দ আয়োজন, গবেষণা, প্রকাশনা, সভা-সেমিনার। একই সঙ্গে চলছে মূলধারার সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছে এমন সংগঠনগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক বৈঠক-আলোচনা। লোকজসংস্কৃতির অন্যতম জনপ্রিয় অনুষঙ্গ গম্ভীরা, আলকাপ, কাহানি, বিয়ের গীত, ঝার্ণিখেলা, লাঠিখেলাসহ বিভিন্ন গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িতদের সংগঠিত করতে চলছে ধারাবাহিক কার্যক্রম।

আমাদের মূলভিত্তি লোকসংস্কৃতির বিকাশ, সুরক্ষা, উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে প্রচার-প্রসার এবং সুস্থধারার সংস্কৃতিসমৃদ্ধ আগামী গড়তে কাজ করছে ‘দিয়াড়’। মাটি-মানুষের সঙ্গে চমৎকার সম্মিলন ঘটিয়ে গ্রামবাংলার স্বকীয়তা ধরে রেখে নিজস্ব সংস্কৃতির ধারা বিকাশে কাজ করে যাচ্ছেন দিয়াড় কর্মীরা। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠার এক বছরের মাথায় আয়োজন করা হয় প্রথম জাতীয় গম্ভীরা উৎসব। সময়ের পরিক্রমায় চলতি বছরের ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় গম্ভীরা উৎসবের আয়োজন। আগামী বছর থেকে আরও বড় পরিসরে আয়োজন করা হবে আলকাপ-গম্ভীরা-বিয়ের গীত-ঝার্ণিখেলাসহ লোক সংস্কৃতির  আকর্ষণীয় উপাদান নিয়ে দিয়াড় লোক উৎসব।

বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী একটি ধারা গম্ভীরা। মূলত বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ও ভারতের বাংলার মালদা অঞ্চলে গম্ভীরার উৎস এবং প্রসার। চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলের গম্ভীরার মুখ্য চরিত্রে নানা-নাতি সব এলাকা, সব বয়সী মানুষের খুবই জনপ্রিয়। শিব > গম্ভীর > গম্ভীরা। পরবর্তী সময়ে গম্ভীরা গানের ধরন যায় বদলে। বর্ণনামূলক এ গানের সুরে একসময় দেবদেবীকে সম্বোধন করে বলা হতো গ্রামীণ দারিদ্রক্লিষ্ট মানুষের সুখ-দুঃখ। কখনও সারা বছরের প্রধান ঘটনা এ গানের মাধ্যমে আলোচিত হতো। পালা-গম্ভীরায় অভিনয়ের মাধ্যমে এক একটা সমস্যা তুলে ধরা হতো। চৈত্র-সংক্রান্তিতে বছরের সালতামামি উপলক্ষে পালা-গম্ভীরা পরিবেশন করা হতো।

বর্তমানে ‘গম্ভীরা’ বলতে বিশেষ একটি অঞ্চলের লোকসঙ্গীতকেই বোঝায়। ভারতের মালদা থেকে গম্ভীরা গান তৎকালীন বৃহত্তর রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জে দারুণভাবে প্রচলন হয়। এক পর্যায়ে স্বাভাবিকভাবে গানের আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুতেও পরিবর্তন আসে। ক্রমে লোকসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ এ অনুষঙ্গ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোরসহ উত্তরবঙ্গ তথা সারাদেশেই দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

পূর্বে গম্ভীরা গানের আসরে শিবের অস্তিত্ব কল্পনা করা হতো। বর্তমানে গম্ভীরা গানের আসরে শিবের পরিবর্তে ‘নানা-নাতি’র ভূমিকায় দুজন অভিনয় করেন। নানার মুখে পাকা দাড়ি, মাথায় মাথাল,পরনে লুঙ্গি, হাতে লাঠি। আর নাতির পোশাক ছেঁড়া গেঞ্জি, কোমরে গামছা ইত্যাদি। একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের গ্রামের ছবি। ‘নানা-নাতি’র সংলাপ ও গানের মধ্য দিয়ে দ্বৈতভাবে গম্ভীরা গান পরিবেশিত হয়। এক সময় গম্ভীরা গান একতাল, ত্রিতাল, দাদরা, খেমটা, কাহারবা প্রভৃতি সুরে গাওয়া হতো। বর্তমানে সুরের কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ ছাড়া লোকনাট্যের বহু বিষয়, চরিত্র ও সংলাপও গম্ভীরায় সংযুক্ত হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শেখ সফিউর রহমান (সুফী মাষ্টার), সোলায়মান মোক্তার, কুতুবুল আলম, রকিবউদ্দীন, বীরেন ঘোষ, মাহবুবুল আলম, ফাইজুর রহমান মানী প্রমুখ গম্ভীরা গানের বিশিষ্ট শিল্পী। তাঁরা নতুন নতুন সুর সৃষ্টির মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে গম্ভীরাকে সারা বাংলাদেশে জনপ্রিয় করে তোলেন। এর বাইরেও শুধুমাত্র চাঁপাইনবাবগঞ্জেই নিয়মিত দল রয়েছে প্রায় ২০টি। গম্ভীরা নিয়ে নিয়মিত কাজ করছে তারা। তবে গম্ভীরা পরিবেশন শুধু নয়, এর বিকাশ তথা সার্বিক উৎকর্ষ সাধনের মহৎ লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই কাজ শুরু করে ‘দিয়াড়’। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গম্ভীরাকে ছড়িয়ে দিতে আমাদের পরিকল্পিত প্রয়াস অব্যাহত থাকবে।

সুন্দর আগামী গড়ার দৃপ্ত শপথে বলীয়ান দিয়াড় কর্মীরা মূলধারার সংস্কৃতি সুরক্ষায় রাখবেন অগ্রণী ভূমিকা। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আধুনিক বাংলাদেশ গড়তে অব্যাহত থাকবে সাংস্কৃতিক আন্দোলন। পেছাবে না বাংলাদেশ। অপশক্তি-কুপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে আমরা গড়বো ইস্পাতকঠিন সাংস্কৃতিক ঐক্য। আসুন আমরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে বাঁচাই। মাটি-মানুষের সংস্কৃতিকে বাঁচাই। শেকড়ের সন্ধানে থাকুক সমন্বিত প্রচেষ্টা। জাতীয়ভিত্তিক সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংস্থা ‘দিয়াড়’ সময়ের সঙ্গে দেশ-জাতি-লোকসংস্কৃতি-প্রজন্মকে এগিয়ে নিতে ধারাবাহিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে। সমন্বিত কর্ম প্রয়াসে আমাদের লোকসংস্কৃতি তথা ভিত্তিমূল আরও মজবুত হবে নিশ্চয়ই।

লেখক: সদস্যসচিব, দিয়াড়




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/তারা  

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়