সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহার কতদূর?
জাফর সোহেল || রাইজিংবিডি.কম
জাফর সোহেল: ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’- বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের প্রথম জোরালো চার শব্দ। ঐতিহাসিক এই স্লোগান দিয়ে বাঙালি অর্জন করেছে মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ঘটনা একদিকে যেমন বিরল, তেমনি অনন্য গৌরবের। ভাষার জন্য বুকের রক্ত দিয়েছে পৃথিবীতে বাঙালিই প্রথম। রক্তের বিনিময়ে অবশ্য বাঙালি কেবল ভাষা পেয়েছে তা নয়, এর ধারাবাহিকতায় এ জাতি অর্জন করেছে তার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন- স্বাধীনতা।
মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার পেলেও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার আজও নিশ্চিত করতে পারিনি আমরা। বরং সরকারি কাজে, পথে-ঘাটে, মাঠে ময়দানে, শিক্ষা-দীক্ষায় সবকিছুতে ভিনদেশী ভাষার একচেটিয়া দাপট। রাজধানী ঢাকা শহরের এ-মাথা, ও-মাথা একবার প্রদক্ষিণ করলেই বিষয়টি টের পাওয়া যাবে। ব্যাংক-বীমা, দেশি-বিদেশি কোম্পানি, বেসরকারি সংস্থা, সরকারি-বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল- সব কিছুর নাম ইংরেজিতে লেখা! অথচ এসব ক্ষেত্রে বাংলায় সাইনবোর্ড লেখা বাধ্যতামূলক করে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা? দেদারসে ব্যবহৃত হচ্ছে ভিনদেশী ভাষা। এমনকি রাজধানীর কোন কোন এলাকায় গেলে মনে হবে- এটা বুঝি বিদেশ! সেখানে কোথাও বাংলার অস্তিত্ব নেই।
উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না তা দেখবে সরকার। সরকারি প্রতিষ্ঠানেরই অনেকগুলো সেই নির্দেশনা মেনে চলছে না। ২০১৬ সালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বর প্লেটসহ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে পুনরায় অনুরোধ জানায়। একই সঙ্গে গণমাধ্যমেও বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে বলা হয়। বলা হয় এফএম রেডিওতে বাংলা ও ইংরেজির মিশ্রণে অদ্ভুত ভাষা ব্যবহার বন্ধে উদ্যোগের বিষয়েও। কিন্তু এখন পর্যন্ত উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বা সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের চিঠি চালাচালির কোন ফল দেখা যাচ্ছে না। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এমন অবহেলার কী শাস্তি হতে পারে? শাস্তি তো দূর, এ বিষয়ে কেউ কোন প্রশ্ন তুলছেন না।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমেরও যে এক্ষেত্রে একটা ভূমিকা রাখার বিষয় আছে তাও যেন সবাই ভুলে গেছেন। এদেশে বেশিরভাগ গণমাধ্যমের নাম ইংরেজিতে। কেন? এই গণমাধ্যমগুলোর কটি বিদেশী বা ইংরেজি ভাষার লোকেরা দেখেন? এফএম রেডিওগুলো এখনো দেদারসে বাংলা-ইংরেজি-হিন্দি মিশ্রণে বিকৃত ভাষা ব্যবহার করে চলেছে। এসব নিয়ন্ত্রণ করার বা দেখার কি কেউ নেই? কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন অবশ্য তাদের নাম বাংলায় প্রচার করছে। যেমন- সময় টেলিভিশন তাদের সংবাদের নাম এবং সবগুলো ‘কনটেন্ট’ বা বিষয়ের ক্ষেত্রে বাংলা অনুসরণ করছে। সব বেসরকারি চ্যানেল সংবাদের শুরুর ‘কাউন্ট ডাউন’ ইংরেজিতে দেখায়; সেখানে উল্লিখিত টেলিভিশনটি বাংলায়- ৫,৪,৩,২,১ এভাবে দেখায়। যমুনা টিভি তাদের পর্দায় ইংরেজি নামের পাশাপাশি বাংলায় ‘যমুনা টিভি’ লেখা শুরু করেছে। বেশিরভাগ টেলিভিশন ‘সংবাদ’ কে বলে ‘নিউজ’। সেটা তারা শিরোনামে যেমন বলে তেমনি প্রতিবেদক তার কণ্ঠেও বলেন! এখন জাতি কী করে ‘সংবাদ’ শব্দটি মনে রাখবে? সবাই তো শিখবে ‘নিউজ’। এরকম আরো অনেক উদাহরণ আছে। আইন বাস্তবায়নকারীরা যেমন উদাসীন তেমনি জাতির বিকল্প পথ প্রদর্শকের ভূমিকায় থাকা গণমাধ্যমও উদাসীন।
আমার কথা হলো, বাংলাদেশি একটি টেলিভিশন চ্যানেল প্রয়োজনে বিদেশি ভাষার বুলেটিন রাখতে পারে; কিন্তু নিজের দেশের সংবাদ উপস্থাপনে বিদেশি ভাষার ব্যবহার করা মোটেই উচিত নয়। এর প্রয়োজন যেমন নেই, তেমনি এই বাহুল্য বর্জনও অসম্ভব নয়। বাংলাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে, এর চর্চা টিকিয়ে রাখতে হলে এদেশের গণমাধ্যমকে এই বিষয়ে আরো সচেতন হতে হবে। জনগণ গণমাধ্যম থেকে অনেক কিছু শেখে। তারা অনুসরণ করে। আগে এক সময় যেমন আমরা পাঠ্যবই অনুসরণ করতাম। বলতাম, বইয়ে যা লেখা আছে তাই সঠিক। তেমনি এখন অনেকে বলেন- ‘টিভিতে এভাবে বলেছে বা এরকম দেখিয়েছে, অতএব এটাই সঠিক’।
বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজসমূহের ভূমিকাও এক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষার্থীদের ভর্তি প্রক্রিয়া থেকে নিয়ে পরীক্ষা, সিলেবাস, প্রশ্নপত্র, সনদপত্র সবকিছুতেই ইংরেজি ব্যবহার করছে। কেন? বাংলা ভাষায় কি শিক্ষা কার্যক্রম চালানো যায় না? ধরে নিলাম শুরুর দিকে সম্ভব ছিল না। বিদেশী ভাষার বই যেমন পড়তে হয়েছে তেমনি শিক্ষাদানেও বিদেশী শিক্ষক নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু রক্ত দিয়ে ভাষা অর্জনের ৬৬ বছর পরেও কেন নিজের ভাষায় বিদ্যা অর্জন করতে পারবে না এদেশের নতুন প্রজন্ম? চিন্তার বিষয় এই যে, সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, এই ৬৬ বছরে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য কটি বই অনুবাদ করা হয়েছে? উত্তরে প্রতিষ্ঠানটিকে নিশ্চুপই থাকতে হবে। কারণ, বলতে গেলে কাজটি উল্লেখযোগ্যভাবে হয়নি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের একটি বিভাগে পড়েছি। স্নাতক, স্নাতকোত্তর মিলে বাংলায় বই পেয়েছি মোটে দুটি! অথচ এই সময়ে আমাকে মোট বই পড়তে হয়েছে অন্তত শ’খানেক। বিশ্ববিদ্যালয় কি এই এতগুলো বছরে এসব বইয়ের অন্তত ২০-২৫টা শিক্ষার্থীদের জন্য অনুবাদ করে দিতে পারত না? অবশ্যই পারত। কিন্তু করা হয়নি। কোলকাতা থেকে বাংলায় অনুবাদ করা কয়েকটি বই আমরা পেয়েছি। একটা দেশের রাজ্য সরকারের পক্ষে যা করা যায়, আমাদের গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষেও কি তা করা সম্ভব নয়? এই দীনতার জবাব কী?
বিদেশী ভাষা শেখা বা তার ব্যবহার থাকতেই পারে। প্রয়োজনের তাগিদে তা ব্যবহার হবে। কিন্তু সেই ভাষার ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা কোনভাবেই মাতৃভাষাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। পৃথিবীর যত জাতির সমৃদ্ধ ভাষা রয়েছে তারা সবাই রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তিগত কাজে প্রথম প্রাধান্য দেয় নিজের ভাষাকে। চীন, জাপান, ফ্রান্স, স্পেন এমনকি আরব দেশগুলোতে এই প্রক্রিয়াতেই নিজ নিজ ভাষাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আপনি জাপানে গিয়ে পড়াশোনা করবেন? প্রথমে সে দেশের ভাষার ওপর কোর্স করে নিতে হবে। এমনকি ইংরেজি জানলেও চলবে না। একই কথা প্রযোজ্য চীনের ক্ষেত্রেও। কারণ, তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিজের দেশের ভাষায় পরিচালিত।
আমাদের দেশের অনেক শিক্ষককে বলতে শুনি, ইংরেজি মাধ্যমে পড়া ভালো- তা স্কুলে হোক আর বিশ্ববিদ্যালয়ে হোক। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে পরীক্ষা দেয়ায় উৎসাহিত করা হয়। কারণ, এতে ইংরেজিতে দক্ষতা তৈরি হয়। আর ইংরেজিতে ভালো হলেই সব জায়গায় ভাল চাকরি পাওয়া যাবে। এটা সম্পূর্ণ একটা ভুল দৃষ্টিভঙ্গি। ইংরেজি বা কোন ভাষায় দক্ষতার জন্য আলাদা কোর্স করে নিলেই হয়। সংশ্লিষ্ট ভাষায় দক্ষতা বাড়াতে কার্যকর কিছু বই পড়লে, সে অনুযায়ী চর্চা করলে কাজ হয়ে যায়। এজন্য শত শত বই ইংরেজিতে পড়ার কোন দরকার নেই। ধরুন, একজন শিক্ষার্থী বাংলায় স্নাতক পাস করলেন। এখন এই শিক্ষার্থী কি ইংরেজিতে দক্ষ হতে পারেন না? সেই দক্ষতা অর্জনের তো আরো অনেক উপায় আছে। ভাষা শিক্ষা আর বিদ্যার্জন তো এক বিষয় নয়। বাংলাদেশে এই দুটো বিষয়কে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে।
সুতরাং সময় এসেছে এসব বিষয়ে নতুন করে একটু চিন্তা করার। বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে পাওয়ার খুশিতে বসে না থেকে কীভাবে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ ভাষাকে সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠা করা যায় তার জোরালো প্রচেষ্টা নিতে হবে। সে প্রচেষ্টা সরকারের তরফে যেমন তেমনি গণমাধ্যম এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষেই থাকতে হবে। থাকতে হবে আমি আপনি- ব্যক্তিগত পর্যায়ের প্রচেষ্টাও। কারণ, আমার দোকানের সাইনবোর্ড নিশ্চয়ই সরকার লেখে না, আমিই লিখি।
লেখক: সাংবাদিক
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন