ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ভাষার মাস ও বইমেলা যেন এক মাসের বাঙালিয়ানা || আহমদ রফিক

আহমদ রফিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৫, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভাষার মাস ও বইমেলা যেন এক মাসের বাঙালিয়ানা || আহমদ রফিক

পাকিস্তানি পূর্ববঙ্গে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়ায় ছাত্রসমাজ রাস্তায় নামে। শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। সূচনা যদিও ১৯৪৭-এর নভেম্বর থেকে, কিন্তু এর নিয়মতান্ত্রিক সংগঠিত রূপ প্রকাশ পায় ১৯৪৮-এর মার্চ থেকে। এরপর ১৯৫০-এ কেন্দ্রীয় মূলনীতি কমিটির উর্দু রাষ্ট্রভাষা সুপারিশের বিরুদ্ধে ছাত্র ও রাজনৈতিক মহল বিশেষ করে শহর ঢাকায় ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। স্থগিত করা হয় মূলনীতি কমিটির অন্যান্য অগণতান্ত্রিক সুপারিশ।

তবু মুসলিম লীগ শাসক শ্রেণী উর্দু রাষ্ট্রভাষার পক্ষে প্রচারণা চালাতে থাকে। এমনকি চলে আরবি হরফে বাংলা লেখার ষড়যন্ত্র। এসবের পরিণাম ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় ঢাকায় ছাত্রদের তরফ থেকে ভাষার লড়াই। একুশে ফেব্রুয়ারিতে এর বিস্ফোরক পরিণতি। পুলিশের গুলিতে জনাকয়েক ছাত্র-অছাত্র শহীদ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এ আন্দোলন সারাদেশের শিক্ষায়তনে ছড়িয়ে যায়। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীতে প্রতিবাদী চেতনার বিস্তার ঘটে।

একুশের গুরুত্বপূর্ণ স্লোগান ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’, ‘সর্বস্তরে বাংলা চালু করো’ এবং ‘শহীদস্মৃতি অমর হোক’। একুশের উত্তর প্রভাব এবং অনুষঙ্গ হলো সাহিত্য সংস্কৃতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে গুণগত ইতিবাচক পরিবর্তন মূলত জাতীয়তাবাদী প্রগতিশীলতার ধারায়। এর দুটো গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবস এবং শহীদ মিনার। শহীদ দিবস একাধারে প্রতিবাদী দিবস, শোক দিবস ও ভাষা দিবস। ফেব্রুয়ারি মাস হয়ে ওঠে ভাষার মাস যা নানাবিধ আনুষ্ঠানিকতায় পালিত হতে থাকে। যেমন বাংলা একডেমি প্রাঙ্গণে আলোচনা অনুষ্ঠান, বইমেলা ইত্যাদি। দেশে এ উপলক্ষে চলে একুশে উদযাপনের কর্মসূচি, যেমন আলোচনা সভা, আবৃত্তি, গান ইত্যাদি। ঢাকায় বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলা এখন জাতীয় অনুষ্ঠানে পরিণত। এতে রয়েছে লেখক, প্রকাশক, পাঠকের গভীরসংশ্লিষ্টতা। যত বছর বাড়ছে লেখক, প্রকাশক, পাঠক ক্রেতার সংখ্যা বাড়ছে। স্থান সংকুলান হচ্ছে না বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। বছর কয়েক ধরে মেলা প্রাঙ্গণ সম্প্রসারিত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। কিন্তু সেখানে স্টলগুলোর স্থান নির্ধারণ সমতাভিত্তিক সুবিন্যাস্তভাবে হচ্ছে না। তাই পেছন দিকের বিক্রেতারা মার খাচ্ছে। পাঠক ক্রেতারা ওই দূর অবস্থানে যথেষ্ট সংখ্যায় যায় না।

এ অভিযোগ স্বল্পসংখ্যায় হলেও ছোট ও মাঝারি প্রকাশকের। আমার মনে হয় এ অভিযোগ মেলা কর্তৃপক্ষের খতিয়ে দেখা ও ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। স্থান বিন্যাসের যুক্তিসঙ্গত পরিবর্তন ঘটানো দরকার। অন্যথায় বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশস্ত চৌকোণা খেলার মাঠে বইমেলা স্থানান্তর করা দরকার। সেক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রকাশকদের ত্রয়ী সংস্থা সম্মিলিতভাবে মেলার আয়োজন করতে পারে। খেলার মাঠটি আকার আকৃতির দিক থেকে মেলার জন্য উপযুক্ত স্থান।

ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত বইমেলা জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে, এর গুরুত্বও বেড়েছে। মূলত লেখক-প্রকাশকদের লক্ষ্য বইমেলা। আমাদের অভ্যাসগত কারণে প্রধানত লেখকদের দিক থেকে থাকে শেষ দুই-তিন মাসের তাড়াহুড়া। এর প্রভাব কি পড়ে না লেখার মান অর্জনের ক্ষেত্রে, তেমনি প্রকাশকদের মূদ্রণ-পারিপাট্যে? আমার বিশ্বাস পড়ে। এটা আকাঙ্ক্ষিত নয়, অন্তত সাহিত্য সৃষ্টিকর্মের উৎকর্ষে বিবেচনায় প্রকাশকদের বক্তব্য, তারা সারাবছর ধরে বই প্রকাশ করেন। কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। কারণ, মেলা বহির্ভুত সময়ে বইয়ের লেখা যেমন কম, প্রকাশনাও তেমনি। এটা বইমেলার নেতিবাচক দিক। কিন্তু এর দায় বইমেলার নয়, অন্তত পুরোপুরি নয়; দায় লেখক তথা সাহিত্যকর্মীদের।

এ বইমেলা শুরু হওয়ার আগে লেখকগণ বছরজুড়ে তাদের সাহিত্যসৃষ্টির কর্মে ব্যস্ত থাকতেন, এখন অনেকেই বইমেলা সামনে রেখে লেখার কাজে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। তেমনি অধিকাংশ প্রকাশক। এ অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটানো দরকার। প্রসঙ্গত একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো যে, বইমেলা উপলক্ষে বই লেখা ও প্রকাশ সংখ্যাগত দিক থেকে অনেক বেড়েছে, সে তুলনায় লেখার মানগত উৎকর্ষের উন্নতি ততটা নয়। যেন তড়িঘড়ি করে ক্যানভাসে তুলির শেষ টানে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা। হয়তো এটা সবার ক্ষেত্রে সত্য নয়, তবে অনেকের ক্ষেত্রে সম্ভবত সত্য। পরিমাণ বা সংখ্যা এবং গুণগত মান এ দুইয়ের সামঞ্জস্য বিধান খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

দুই

একই সূত্রে লক্ষনীয় ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি ঘিরে গভীর ও আবেগের প্রকাশ সত্ত্বেও সাধারণভাবে মাতৃভাষা তথা বাংলাভাষার ব্যবহারিক দিকে গভীর চর্চার ক্ষেত্রটি ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। সেখানে শিক্ষায়তনে ইংরেজি মাধ্যমের ব্যাপক দুর্মূল্য দাপট। এই দাপট যেমন শিক্ষাদান ও শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে তেমনি জীবিকার ক্ষেত্রেও। করুণমুখ বাংলাভাষা সেখানে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে। তাই বাংলার ভাষিক অনুশীলন দ্রুত কমতে শুরু করেছে, সেখানে শ্রম, সময় ও আন্তরিকতার অভাবও দেখা যাচ্ছে। স্বভাবতই অবহেলার পরিণামে বাংলার শুদ্ধচর্চা, নির্ভুল বলা ও লেখার ক্ষেত্রটি ছোট হচ্ছে। জাতীয় পর্যায়ের শিক্ষাক্রমে যেমন প্রবণতার প্রভাব পড়ছে তেমনি পড়ছে এর বাইরে। বানান-ভুল, শব্দ ব্যবহারে ভুল, উচ্চারণে ভুল, কথকতায় বা বক্তৃতায় বা টিভির টকশোতে ইংরেজি বাংলার দোআশলা স্থূল ব্যবহার চেতনায় আঘাত করে না। বরং ক্ষেত্র  বিশেষে তা ‘স্মার্টনেস’ এর প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। এফএম রেডিওর স্থূল, কখনো আপত্তিকর বাংলা- ইংরেজির ব্যবহারিক প্রচার আপাত বিচারে সরস ও তির্যক মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা বাংলা ভাষার করুণ অবস্থারই প্রমাণ তুলে ধরে। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, এসব দেখার কেউ নেই। নিয়ন্ত্রণের কারো তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না। বাংলা ভাষার ব্যবহার সত্যিই এক ব্যাপক উদাসীনতার শিকার।

তিন

কেন বাংলা ভাষার এ দুরবস্থা, ক্রমশ পিছু হঠা? এর কারণ বুঝে ওঠা কঠিন কিছু নয়। বিশেষ করে ষাটের দশকের শেষার্ধে বাংলা ভাষার ব্যবহারে ও বাঙালিয়ানায় যে ব্যাপক ঢেউ উঠেছিল তা কেন দ্রুত ভাটার টানে নেমে গেল, আর ফিরে এলো না, সে বিষয়টুকুও দুর্বোধ্য নয়। সহজ বিচার-বিশ্লেষণে এর কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্বপ্নের পাকিস্তান নিয়ে বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়বাদী উন্মাদনার কারণ ছিল ‘শিক্ষা পদমান মর্যাদায়; বৈষম্য থেকে মুক্তি এবং তা প্রতিযোগিতাহীন স্বতন্ত্রভুবনে অর্থাৎ পাকিস্তানে। অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত রক্তের বিনিময়ে অর্জিত পাকিস্তানেও দেখা গেল তারা এখানেও বৈষম্য ও শোষনের শিকার। এবং তা অধিক ও একাধিক মাত্রায়। পথম আঘাত ভাষার ওপর, উপলক্ষ রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ। সে ক্ষেত্রে একমাত্র উর্দুর অবস্থান হয়ে দাঁড়ায় কঠিন বাধা।

ছাত্রসমাজ স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়ায় এ বাধার অচলায়তন ভেঙে ফেলে। এবং তা সফল ভাষা আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায়। অর্থনৈতিক-সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী চেতনার সর্বজনীন প্রকাশ ঘটে বাঙালিয়ানার মাধ্যমে। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে জোরালো স্লোগান ওঠে একুশ দফা থেকে ছয় দফা হয়ে ১১ দফা ও ১৪ দফায়। ষাটের দশকের শেষ দিকে বাঙালিয়ানার জোয়ার শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে, মধ্যবিত্ত ও বিত্তহীন শ্রেণী নির্বিশেষে। শ্রেণী চেতনা পিছু হটে। এ জোয়ারে হাল ধরে রাজনৈতিক দল। এক পর্যায়ে আরোপিত যুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে। শিক্ষিত শ্রেণী পেশাজীবী ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর বাঙালির হাতে এবার সব ক্ষমতা এসে যায়। আসে বিত্তবৈভব অর্জনের সুযোগ। এ শ্রেণী ইংরেজি আমলের ফসল, ঔপনিবেশিক রাজভাষা ও সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত। এই শ্রেণীর আকাঙ্ক্ষিত সর্বমাত্রিক স্বার্থপূরণ হয় স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায়।

সংগ্রামকালীন অঙ্গীকার, ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতির প্রকাশ ঘটে ১৯৭২-এ একটি সেক্যুলার সংবিধান প্রণয়নে, যেখানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষিক মর্যাদার আসনে বসানো হয়। কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে অর্থাৎ জাতীয় জীবনের প্রধান ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক রাজভাষা ও রাজসংস্কৃতির অবস্থান অক্ষুন্ন থেকে যায়। একুশের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এই শ্রেণীগত স্বার্থের কাছে হার মানে। শ্রম ও সময়সাপেক্ষে ভাষিক পরিবর্তনের দায় গ্রহণ ও পালন করে না সুবিধাবাদী-সুবিধাভোগী শ্রেণীগুলো। তাই পাকিস্তান আমলের মতো ঔপনিবেশিক রাজভাষা ইংরেজি ও ভাষিক সংস্কৃতি উচ্চশিক্ষা ও উচ্চ আদালতসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে বহাল থাকে। একমাত্র পরিবর্তন সংবিধানের রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বীকৃতি এবং শিক্ষাক্ষেত্রে দ্বাদশশ্রেণী পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমের ব্যবহার। শেষোক্ত বিষয়টির দুর্ভাগ্যজনক দিক হলো শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যমে বিভাজিত করে শেষোক্তদের উচ্চশিক্ষায় সমস্যা সৃষ্টি করা। বাংলাভাষা ও বাঙালিয়ানা এভাবে নিজ হাতেই আহত ও রক্তাক্ত। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এবং একাত্তরের লড়াইয়ের ঐতিহ্য নির্বাসনে। এক কথায় বিশিষ্টদের শ্রেণীস্বার্থ সব সমস্যার মূলে। নিম্নবর্গীয়দের লড়াইয়ের ফসল ওই শ্রেণীর অধিকারে। এমন এক আর্থ-সামাজিক ও শাসন ব্যবস্থায় চলছে বাংলাদেশ।

ভাষার মাস পালন, বইমেলা কি এক মাসের বাঙালিয়ানায় উল্লিখিত শ্রেণী সমস্যার সমাধানে এক পাও এগুতে পেরেছে বা পারছে? না, পারছে না। গোটা বিষয়টাই আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত ‘এক মাহিনাকা সুলতান’-এর মতো। পরবর্তী এগারো মাস আরামদায়ক ঘুম। একুশের সংস্কৃতি চর্চা সচেতন মনে শুধু প্রশ্নই রেখে যায়, প্রতিকারের আন্দোলন গড়ে তোলে না।

লেখক: রবীন্দ্র গবেষক ও প্রাবন্ধিক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়