ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

প্রশ্ন ফাঁস : অবক্ষয়ী সমাজচিত্র

সাইফুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫২, ১ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রশ্ন ফাঁস : অবক্ষয়ী সমাজচিত্র

অলঙ্করণ : সংগৃহীত

সাইফুজ্জামান : সব দেখেশুনে মনে প্রশ্ন জাগে, এ কোন সমাজে বাস করছি? যেখানে নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ প্রায় তলানিতে এসে পৌঁছেছে। প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটেছে। এসেছে পৃথিবী জয় করার যন্ত্র। হাতের মুঠোয় সেলফোন। ঘরে-বাইরে সেলফি তোলার প্রতিযোগিতা। কেউ কাউকে পরোয়া করছে না। মুহূর্তে ছবি তুলে আপলোড হয়ে যাচ্ছে ফেসবুকে ও বিভিন্ন মাধ্যমে। মুঠোফোনে ইংরেজি লিপিতে বাংলা টেক্সট লেখা হচ্ছে। হাতে লেখা চিঠির প্রচলন উঠে গেছে। আবেগ, ভালোবাসা ও সহমর্মীতার জায়গা দখল করে নিয়েছে প্রযুক্তি।

সম্প্রতি এসএসসি পরীক্ষা চলাকালে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন মুঠোফোনের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমান সরকার জনবান্ধব। ফলে তারা বিষয়টি দ্রুত আমলে নিয়ে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের সাথে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রশ্নপত্র পদ্ধতির পরিবর্তন, প্রশ্নপত্র ছাপানোয় আরো সতর্কতা ও ভিন্ন ব্যবস্থায় পরীক্ষা গ্রহণ, এমনকি পরীক্ষা চলাকালে কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র মুদ্রণ করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত রয়েছে কয়েকটি গ্রুপ। তাদের কয়েকজনকে শনাক্ত করা সম্ভব হলেও মূল হোতারা ধরা ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। প্রশ্নপত্রসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রছাত্রীদেরও পুলিশ আটক করেছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ সূত্র থেকে জানা যায়, বিজি প্রেসে প্রশ্ন কম্পোজ, এডিট, প্রিন্ট ও প্যাকেজিংয়ের সাথে জড়িত রয়েছে ২৫০ জন কর্মী। এদের মধ্য থেকে একটি গ্রুপ প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকতে পারে। জানা গেছে, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির ট্রেজারি বা নিরাপত্তা হেফাজত থেকে প্রশ্নপত্র গ্রহণ করার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্তদের অনেকে যথাযথভাবে অর্পিত দায়িত্ব পালন করছেন না। তাছাড়া কেন্দ্রের সংখ্যা অতিরিক্ত হওয়ায় নির্দিষ্ট জনবলের পক্ষে নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও সম্ভব হচ্ছে না। পরীক্ষা শুরুর আধা ঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্র গ্রহণ করায় কোনো না কোনোভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে।  পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা স্মার্ট ফোন ব্যবহার করছেন। এদের করো মাধ্যমেও প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে।(সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮)

প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে সংশ্লিষ্টরা বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছে। প্রতিরোধে প্রথমে ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেয়া, ফেসবুক কার্যক্রম স্থগিত রাখার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা হয়েছিল। দেখা গেল এসব করা হলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার গতি থমকে যাবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বোর্ড ও শিক্ষা অধিদপ্তরের ২৯ জন কর্মকর্তাকে ঢাকার বাইরে বদলিও করা হয়েছে।

বুদ্ধিজীবী, শিক্ষা ব্যবস্থায় জড়িত ব্যক্তি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতবিনিময় ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা সম্ভব হতে পারে। কোন বিশেষ পদ্ধতি প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করবে এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। এখন শোনা যাচ্ছে, প্রশ্নপত্র আগে থেকে মুদ্রণ করা হবে না। পরীক্ষা চলাকালে কেন্দ্রের আগে থেকে তৈরী করা প্রশ্ন ব্যাংক থেকে নির্বাচিত প্রশ্নপত্র ধারণ করে তাৎক্ষণিকভাবে মুদ্রণ করে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। সেইতো ডিভাইস, ইন্টারনেট ও তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার! কতটুকু নিরাপদ থাকবে এই ব্যবস্থা। চোর, ডাকাত ও তাদের গড ফাদারেরা নিত্য নতুন ফাঁদ পেতে চলেছে। সমাজের স্বাভাবিক গতিধারা বিঘ্ন করে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের নৈতিক চরিত্র নষ্ট করা যাদের কাজ তাদের সম্মিলিত ভাবে মোকাবেলা করা জরুরি। শুধু যে পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে তা নয়। চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা, স্কুল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা কোথাও বাদ নেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ধারা।

অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিবেদিত প্রাণ শিক্ষকের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। পঞ্চাশ ও ষাট দশকে বিজ্ঞান প্রযুক্তির এতো উন্নয়ন ঘটেনি। ছিল মহৎ প্রাণ শিক্ষক।  শুদ্ধ ভাষার ব্যবহার ও বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের চর্চা সে সময় হতো। স্কুলে শিশুর মানসিক বিকাশের পর্যাপ্ত সুযোগ ছিল। অলিগলিতে কোচিং সেন্টার তখনও গজিয়ে ওঠেনি। গ্রামে বিদ্যুৎ, ফোন, টেলিগ্রাম ও ইন্টারনেট ছিল না। লেখাপড়ায় শিক্ষিত একদল মানুষ নিজে যেমন বিকশিত হতো ও অন্যদের মেধা-জ্ঞান বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো। হায় সেই সোনালি দিন কোথায় হারিয়ে গেল!

এখন অনেক বিদ্যালয়ে মাঠ নেই। পরিবারের আবেগ, উত্তাপ ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত একদল ছেলেমেয়ে ভারি বইয়ের ব্যাগ বয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ছুটোছুটি করছে বিদ্যালয় ও কোচিং সেন্টারে। জাতি গঠনে শিক্ষার বিকল্প নেই। সুশিক্ষিত ও মানবিক জনগোষ্ঠীই পারে দেশ ও জাতিকে উন্নয়ন ধারায় সম্পৃক্ত করতে। এদের বাদ দিয়ে অগ্রগতি সম্ভব নয়। তাদের ভবিষ্যৎ সুন্দর ও নিরাপদ করার জন্য অবশ্যই প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ করতে হবে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ মার্চ ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়