ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় কতটা এগিয়ে বাংলাদেশ?

তরিকুল ইসলাম তারেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৬, ৮ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
 নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় কতটা এগিয়ে বাংলাদেশ?

তরিকুল ইসলাম তারেক: ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। প্রতি বছরের ন্যায় এবারো বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় দিনটি পালিত হবে। রংবেরঙের মঞ্চে তুখোড় বাকপটুতায় নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলবেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। টিভি, টক’শো, ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট মিডিয়ার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবেন নারী।

তারপরও প্রতিদিন ‘প্রেমের ডাকে সাড়া না দেয়ায় এসিড নিক্ষেপ’ ‘যৌতুক না পেয়ে স্বামীর নির্যাতন’ ‘ছয় বছরের কিশোরীকে ধর্ষণ’ ইত্যাদি শিরোনাম সংবাদপত্রে উঠে আসে। নারীকে মানুষ হিসেবে না দেখে যেন নারী হিসেবে দেখতেই বেশি ভালোবাসি আমরা। নারী দিবস পালনের অনুভূতিটা যেন মুখের বুলিতেই সীমাবদ্ধ না থাকে, তা যেন কার্যকর হয় এটাই চাওয়া।

‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি, চির-কল্যাণকর

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

কোন কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারী

প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে, বিজয়-লক্ষ্মী নারী।’

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘নারী’ কবিতায় এভাবেই আজকের সভ্যতার পেছনে নারীর গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। ‘নারী’ শব্দের প্রথম অক্ষর ‘না’। তাই হয়তো প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীদের ‘না’ শুনতে হয়। সভ্যতা বিকাশে নারীর ভূমিকা অসামান্য। আমরা যে মানব চক্রে পৃথিবীতে এসেছি তার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ নারী। তারা বিভিন্ন সম্পর্কে মানব সমাজে অবস্থান করে। এই নারী কখনো মা, কখনো বোন, কখনোবা স্ত্রী হিসেবে মানব সমাজে সম্পর্কযুক্ত। ধর্মেও রয়েছে নারীর উচ্চ মর্যাদা। অথচ আমরা এ কথা মেনে নিতে চাই না যে, আমাদের দেশ সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে নারী-পুরুষকে একত্রে কাজ করতে হবে। ‘লাইসেন্স’ গল্পে প্রখ্যাত উর্দু সাহিত্যিক সাদাত হাসান মান্টো জনৈক নারীর গল্প লিখেছেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর তার ঘোড়ার গাড়ির লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া হয়। কেননা স্বামীর অবর্তমানে সে নিজেই ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছিল। কিন্তু সমাজ তার এই স্বাধীন উপার্জন মেনে নেয় না। তাকে বেপর্দা নারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অবশেষে তার কাছ থেকে ঘোড়ার গাড়ির লাইসেন্স কেড়ে নিয়ে তাকে বাজারে বসার পরামর্শ দেয়া হয়।

একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এ কথা প্রচলিত আছে যে, নারীরা শারীরিকভাবে পুরুষদের তুলনায় দুর্বল প্রকৃতির হয়। অধিকাংশ পুরুষ এমনকি নারীরাও এই মতবাদে বিশ্বাসী। কথাটা হয়তো কিছুটা সত্য। কিন্তু পৃথিবীর এমনও দেশ আছে যেখানে নারীরা বেশি শারীরিকভাবে শক্তিশালী। সেসব দেশে নারীপ্রধান পরিবার প্রথা প্রচলিত এবং নারীরা ঘরের বাইরে গিয়ে উপার্জন করেন। তাহলে মূল সমস্যা আমাদের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি এবং নারীর প্রতি দুর্বল মানসিকতা।

আমাদের সমাজ নারীদের সুযোগ করে দিতে চাইছে না। সুযোগ পেলে তারাও আকাশ ছুঁয়ে দেখতে পারে, সমুদ্র থেকে মণিমুক্তা সংগ্রহ করে আনতে পারে। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, সমাজ সে সুযোগ তৈরি করতে আগ্রহী নয়।

এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে নারীরা কাজ করছে ৬৫ ভাগ। বিপরীতে আয় মাত্র ১০ ভাগ। কর্মক্ষেত্রে নারীর মজুরি পুরুষের তুলনায় অনেক কম। পৃথিবীতে নারী-পুরুষের সংখ্যানুপাত প্রায় সমান। দুনিয়ার মোট সম্পদের ১০০ ভাগের ১ ভাগ মাত্র নারী। এভাবেই যুগ যুগ ধরে নারীরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। নারী আন্দোলনের ইতিহাসও অল্পদিনের নয়। ১৮৫৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা মজুরি বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমেছিলেন। কিন্তু সেই শান্তিপূর্ণ মিছিলে চলে সরকারবাহিনীর দমন পীড়ন। ১৯০৮ সালে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হয়। ক্লারা ছিলেন জার্মান রাজনীতিক এবং কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন। এরপর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন।

সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বৎসর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। সিদ্ধান্ত হয় ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ নারী দিবস পালিত হতে লাগল। বাংলাদেশেও ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতার লাভের পূর্ব থেকেই এই দিবসটি পালিত হতে শুরু করে। অতঃপর ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। সেই থেকে দিনটি জনপ্রিয়তা লাভ করে আজকের পর্যায়ে এসেছে।

অনেক বাধাবিপত্তি এবং দৃষ্টিভঙ্গির অসামঞ্জস্যতা সত্যেও নারীরা আজ অনেকটাই এগিয়ে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ কথা আরো সত্য। বাংলাদেশের বড় দুই রাজনৈতিক দলের প্রধান নারী। প্রশাসনসহ বিভিন্ন পেশায় নারীদের অবস্থান সুদৃঢ়। নারী ক্ষমতায়নে সরকার নারী কোটার ব্যবস্থা করেছে। বাংলাদেশে গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকাংশ নারী। কৃষিক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ সেই অতীত থেকে। এভাবে নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পেতে থাকলে একসময় নারীরাও পুরুষদের সঙ্গে সমান তালে চলতে পারবে বলে মনে করি। এবং বাংলাদেশ সেই পথেই হাঁটছে।

নারী শুধুমাত্র পুরুষ দ্বারা অধিকার বঞ্চিত হয় না। এ জন্য নিজেরাও অনেকাংশে দায়ী। পুরুষের পাশাপাশি নারীদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। চিন্তার সংকীর্ণতা থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে। নিজের পথ নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে। পাশাপাশি সবাইকে বলি, আসুন আমরা নিজেরা পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করি। নারীর যথাযথ সম্মান দেই। তাদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাই সম্ভাবনাময় দিনের দিকে। এতে আমাদেরই লাভ। দেশের লাভও কম নয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ মার্চ ২০১৮/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়