ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

শিশুর শিক্ষা, শিক্ষক ও অভিভাবকের দায়িত্ব

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫৩, ৫ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শিশুর শিক্ষা, শিক্ষক ও অভিভাবকের দায়িত্ব

মাছুম বিল্লাহ : বিশ্বজুড়ে বিশাল অপার সম্ভাবনার নাম মানবশিশু। এই সম্ভাবনাকে অবশ্যম্ভাবী করার জন্য একান্ত প্রয়োজন শিশুর বিকাশ, শিশুর শিক্ষা। শিশুকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষার বিকল্প নেই। শিশুর বিকাশে প্রয়োজন শিশুবান্ধব শিক্ষা, শিশুবোধক বই, শিশুতোষ শিক্ষা উপকরণ। শিশুর মনের উৎকর্ষ সাধনই শিশু বিকালের মূল কথা। শিশুবোধক বই শিশুকে আকৃষ্ট করে, পঠনে অভ্যস্ত করে। পঠনদক্ষতা শিশুর শিক্ষা বিকাশের জন্য অত্যাবশ্যক।

শিশুবিজ্ঞানে শিশুর শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়। যথাযথ শিক্ষা ছাড়া শিশুর পূর্ণাঙ্গ বিকাশ সম্ভব নয়। যে কোন শিক্ষাব্যবস্থা চারটি প্রধান স্তম্ভ নির্দেশ করে। যেমন জানতে শেখা, করতে শেখা, বাঁচতে শেখা ও মিলেমিশে বাস করতে শেখা। মানুষ সারাজীবন যা কিছু শেখে, তার সবাই এ চারটি স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে শেখে। শিশু এর থেকে ব্যতিক্রম কিছু নয়। এই শিখনের ভেতর দিয়ে শিশু তার ব্যক্তিত্ব, জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলবে তা নয়, সৃষ্টি করবে, বিশ্লেষণ ক্ষমতা ও কাজ করার ক্ষমতা সর্বোপরি চিন্তার জগৎকে বাস্তবতার নিরিখে সমৃদ্ধশালী ও মজবুত করার ক্ষমতা। শিশুর কল্পনাশক্তি অসাধারণ, কারণ শিশু উন্মুক্ত চিন্তা করতে পারে, প্রশ্ন করতে পারে নিঃসংকোচে। এই চিন্তা করার শক্তিই রঙিন কল্পনার গোড়ার কথা। শিশুর পঠনদক্ষতা  শিশুকে শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তোলে, শিক্ষাকে প্রসারিত করে। শিক্ষার মাধ্যমে কল্পনাশক্তির বিকাশ না ঘটলে চিন্তাশক্তি স্তিমিত হয়ে যায়।

শিশু প্রতিনিয়ত শেখে। কারণ জীবনধারনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, নিজের চেষ্টায় এবং অন্যের সহযোগিতায় শিশুকে সবকিছু ক্রমে ক্রমে রপ্ত করতে হয়ে।  আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় সম্পৃক্ত হওয়ার আগে শিশুবোধক বিভিন্ন পরিচিত বিষয়ের জীবজন্তু, পশুপাখি, ফুল, ফল, জামা, জুতা, খেলনা, মজাদার খাবারদাবার, নৌকা-গাড়ি, বইখাতা, রং-তুলি নানাবিধ জিনিসপত্রের ছবির সঙ্গে পরিচিত হওয়া, সর্বোপরি পড়ে শুনানো এবং বর্ণের সঙ্গে পরিচিত হওয়া জরুরি। এই বর্ণ পরিচিতির মধ্য দিয়ে শিশু পড়ার অভ্যাস রপ্ত করে। এই অভ্যাস থেকেই গড়ে ওঠে পঠন অভ্যাস। সেই অভ্যাস থেকেই ধীরে ধীরে পঠনদক্ষতা বাড়ে এবং এই দক্ষতাই শিশুকে পড়ার প্রতি আকৃষ্ট করে, জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে। শিশুর চাহিদা, আগ্রহ ও সামর্থ্যের কথা বিবেচনা করে তাদের অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্ব দিয়ে যে শিক্ষার আয়োজন করা হয়, তাই শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা। এ ধরনের শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীরা যাতে হাতে-কলমে কাজের মাধ্যমে সহজে ও আনন্দচিত্তে  শিক্ষার বিষয়বস্তু আয়ত্ব করতে পারে।

শিক্ষাবিদ মন্তেসরির মতে শিশু স্বাধীনতা উপভোগ করে তার পছন্দসই খেলাধুলা করে, শাসনের পরিবর্তে শৃঙ্খলা মানতে শিখবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তি নিকেতনের শিশুদের শিক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে এসে তাদের আনন্দের সঙ্গে লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক দক্ষতা চর্চা এবং প্রকৃতির মাঝে বসে শেখার ব্যবস্থা করেছিলেন। শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা শিশুর তিনটি বৈশিষ্ট্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সেই তিনটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- শিশুর প্রয়োজন, আগ্রহ ও সামর্থ্য। গতানুগতিক শিক্ষায় এগুলো থাকে অবহেলিত। বয়স্কদের প্রয়োজনের বিচারেই শিশুর শিক্ষা পরিকল্পিত ও পরিচালিত হতো। কিন্তু আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশুর স্থান সর্বাগ্রে। শিশুকেন্দ্রিক এই শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মানোভাব প্রশ্রয় না দিয়ে সহযোগিতার মনোভাবকে উৎসাহিত করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মৌলিক সৃজনশীলতা সৃষ্টি, বিস্তারিত এবং সঠিকভাবে লেখার দক্ষতা অর্জন করা। সাবলীলভাবে লেখার দক্ষতার বিষয়টি একাডেমিক সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে পেশাগত জীবনেও অত্যাবশ্যকীয় বলে বিবেচিত হয়। পরীক্ষামূলকভাবে ২০০৮ সাল থেকে শিক্ষার্থীদের মুখস্থ নির্ভরতা থেকে মুক্ত করার আশায় চালু হেয়েছে ‘সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি’। যেখানে শিক্ষার্থীর তাত্ত্বিক জ্ঞানের সঙ্গে বিশ্লেষণক্ষমতা উদ্ভাবনী চিন্তা ও সৃজনশীলতার বিকাশ হওয়ার সুযোগ রয়েছে।

ভালো লেখার দক্ষতা অর্জনের জন্য শিক্ষকদের যা যা করা উচিত: (ক) শিক্ষার্থীদের মধ্যে  প্রেরণা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করা (খ) কীভাবে লিখতে হবে তার নিয়মগুলো জানানো ( যেমন শব্দ গঠন, সঠিক শব্দের ব্যবহার ইত্যদি)। (গ)  লেখার অনুশীলন প্রদান (ঘ)শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে গঠনমূলক মতামত প্রদান করা। (ঙ) ভালো লেখা খাতাগুলো অন্যদের পড়ে শুনিয়ে কেন ভালো তা ব্যাখ্যা করা (চ) দুর্বল লেখার দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে কীভাবে তা উতরে যেতে হবে তা বলে দেওয়া। (ছ) ক্লাসে নিয়মিত লেখার অনুশীলন করানো এবং সর্বদাই সবকিছুতে উৎসাহ প্রদনা করা। শিক্ষক যদি নিয়মিত প্রেরণা দেন, তাহলে শিক্ষার্থীরা তাদের লেখার উন্নতি করার চেষ্টা করবে এবং নিয়মিত প্রচেষ্টা চলতে থাকবে। ভালো লেখার জন্য শিক্ষার্থীদের যথাযথ পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করতে হবে। যখন শিক্ষার্থীরা তাদের নিজেদের দক্ষতা সম্পর্কে সুষ্পষ্ট, নির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়া জানাতে পারবে, তখন কীভাবে তা আরও উন্নত করা যায় তা নিয়ে ভাববে এবং ভবিষ্যতে আরো ভালো করার চেষ্টা করবে। এ কৌশলগুলো সংগঠিত করে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের শিক্ষার্থীদের ভালো ফলাফল করায় উদ্ধুদ্ধ করতে পারে।

শিক্ষকদের নিজেদের  লেখার  দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য যা যা করা প্রয়োজন:  (ক) লেখার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে লিখতে হয় না, পড়তে হয়। নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের লেখা যেমন একাডেমিক, কবিতা, বিজ্ঞান, কথাসাহিত্য, সাধারণ গদ্য ইত্যাদি পড়লে শব্দের সঠিক ব্যবহার, প্রতিশব্দ, বাক্য গঠন সম্পর্কে ভালো ধারণা জন্মে। তাই তাদের প্রচুর পড়তে হবে, তা না হলে লেখার দক্ষতা বাড়ানো কঠিন। (খ)  নিয়মিত অনুশীলন যে কোনো কাজকে নিখুঁত করে তোলে, এটি মূলত জীবনের যে কোনো কাজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। প্রতিদিন ধারাবাহিকভাবে লিখুন। অগ্রগতি ধীরে ধীরে হতে পারে। সপ্তাহ অনুশীলনের সঙ্গে সঙ্গে আপনার লেখার মান ভালো হবেই। নিজের অগ্রগতি জানতে হলে মাস কিংবা বছর আগে আপনার লেখার নমুনা পড়ে দেখুন এবং পার্থক্যটা আপনি নিজেই অনুভব করতে পারবেন। (গ) আপনার লেখাটি জোরে জোরে পডুন, এ কৌশলটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যখন আপনার লেখাটি জোরে জোরে পড়বেন, তখন বুঝতে পারবেন কোথাও কোন ভুল হয়েছে কিনা, লেখাটি অসম্পূর্ণ বা পুনরাবৃত্তিমূলক হয়েছে কিনা। পরে আপনার ভুলগুলো শুদ্ধ করে লেখাটিকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন। (ঘ) একজন লেখক বা শিক্ষকের লেখার দক্ষতা উন্নয়নের চাবিকাঠি। তাই তার লেখার অভ্যাস এবং দক্ষতা বাড়াতেই হবে।

পড়ার সঙ্গে প্রথম বা প্রাইমার কথাটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পড়ালেখার সূচনা পাঠ বা প্রারম্ভিক পাঠই হলো প্রথম বা প্রাইমার। প্রাইমার হতে হবে শিশুবোধক। প্রথম বই অবশ্য বিদ্যালয়ে ব্যবহারের জন্য রচিত হয়। প্রাইমার শুধু ভাষা ব্যবহারের যৌক্তিক পথ দেখিয়ে দেয়। আর তা হলো পড়া ও লেখার পথ। পড়া ও লেখার দক্ষতা বিনির্মান করাই প্রাইমারের মূল উদ্দেশ্য। শিশু প্রথমত শুনতে শুনতে শেখে। বই পড়লে, পড়ে বুঝলে এবং বুঝে লিখতে পারলে সে শিক্ষা আরও পোক্ত হয়। ছাপার অক্ষরে বাংলা ভাষায় প্রথমে শিশুদের বর্ণ শিক্ষার জন্য ব্যবহৃত হতো। পরবর্তী সময়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকৃত বর্ণপরিচয় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত সহজ পাঠ প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ শিশু ও বয়স্কদের বর্ণ শেখার জন্য পঠিত ও ব্যবহৃত হতো। সময়ের বিবর্তনে সর্বস্তরের শিক্ষা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে, প্রাইমারের প্রকরণ এবং প্রয়োগের বিবর্তন ঘটেছে। এখন সুনির্দিষ্ট পাঠক্রমভিত্তিক ও পদ্ধতিনির্ভর এবং শিক্ষার্থীর মনন, পারিপার্শ্বিকতা ও চাহিদা অনুযায়ী প্রাইমার রচিত হয়ে থাকে। ইদানিং সুনির্দিষ্ট পাঠক্রমভিত্তিক প্রাইমার ছাড়াও হরেকরকম সহায়ক বই শিশুদের জন্য প্রকাশিত হচ্ছে। রঙিন ছবি ও মজাদার ছড়া, গল্প  যা শিশুদের পঠনদক্ষতা বাড়াতে সহায়ক। তবে আমাদের দেশে সেসব বইয়ের অপ্রতুলতা রয়ে এখনও গেছে।

শ্রেণিকক্ষে সহায়ক সমাগ্রীর সবচেয়ে পরিচিত ও উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে সহায়ক পুস্তক, অনুশীলন খাতা, চার্ট, পোস্টার, কার্ড, গ্লোব, মডেল এবং শিক্ষকের আলোচনা-পর্যালোচনা । কোনো লিখিত বিষয় সঠিকভাবে অনুধাবনের জন্য ভাষার যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়, তাকে পড়া বা পঠন হিসেবে অভিহিত করা হয়। অক্ষর চিনে ভাষায় লিখিত রূপ দেওয়া, মনের অনুশীলনের মাধ্যমে অর্থ অুনধাবন করার মধ্য দিয়ে পঠন বা পড়া সম্পন্ন হয়। পড়ার মূল বিষয় হলো দেখা, মনের চোখ দিয়ে দেখা, অনুধাবন করা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে পারা এবং প্রায়োগিক ক্ষেত্রে এর ব্যবহার করা। পড়া বা পঠন দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতা সম্প্রসারণ ও সমৃদ্ধ হয়, তাকে ঘটনার উৎস খুঁজে বের করতে অনুপ্রাণিত করে। পড়ার ক্ষেত্রে নৈপুণ্য অর্জনের জন্য শিশুকে অক্ষর পরিচিতি প্রদান করতে হয়, তার শব্দ-ভাণ্ডার বৃদ্ধি করতে হয়। এটি করা সম্ভব বাক্যনুক্রমিক পদ্ধতি ও শব্দানুক্রমিক উভয় পদ্ধতিতে।

হাতের লেখা খারাপ হলে তা পাঠককে আকৃষ্ট করে না। বিশেষত শিক্ষার্থীদের জন্য হাতের লেখা  গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তা পরীক্ষায় নাম্বারপ্রাপ্তিতে ভূমিকা রাখে। হাতের লেখার চর্চা ছোট থেকে করতে হয়। অবশ্য বড় হওয়ার পরও কিছু কৌশল অনুসরণ করে হাতের লেখা ভালো করার সুযোগ আছে।  (১) সুন্দর হাতের লেখা দেখে দেখে অভ্যাস করা (২) এক প্যারা থেকে আরেক প্যারার মাঝে এক ইঞ্চি ফাঁকা রাখা (৩) বামে ও পরে সোয়া এক ইঞ্চি ফাঁকা রাখলে হাতের লেখা সুন্দর দেখায় (৪) প্রি-প্রাইমারী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে হাতের লেখা দ্রুত করার দিকে জোর না দিয়ে সুন্দর করার ওপর জোর দেয়া উচিত। বাংলা ও ইংরেজি লাইন টানা খাতায় লেখা চর্চা করানো উচিত। (৫) প্রাইমারী পর্যায়ে হাতের লেখার পরিষ্কার ও সুন্দর করার পাশাপাশি দ্রুত করার ওপরও জোর দিতে হবে। অক্ষরগুলো যেন খুব ছোট না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।

অবুঝ শিশু অবুঝ প্রাণীর মতো অরক্ষিত, নির্ভরশীল। তাদের চলমান পরিস্থিতির সাথে অভিযোজন করার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হচ্ছে শিক্ষা। আমরা অনেকে মনে করি, শিশুদের লেখাপড়া শেখানো কী এমন কঠিন কাজ? আসলে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে, বাড়িতে একটি শিশু থাকলে কতজন তার দেখাশুনা করে। দুর্ঘটনামুক্ত রাখার জন্য অনেকের দৃষ্টি থাকে তার দিকে। শিশু জন্মের পর প্রথমে কান্নার মাধ্যমে তার চাওয়া-পাওয়া, দুঃখ-কষ্ট প্রকাশ করে। আবার হাত-পা নেড়ে হাসিমুখে তার তৃপ্তির আনন্দ প্রকাশ করে। এই কান্না বা চাহনির মাধ্যমে মা শিশুর আকাঙ্খা, চাহিদা ইত্যাদি সম্পর্কে সমাগ্রক ধারণা নেয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশু প্রথমে কাছের মানুষের সঙ্গে শব্দের মিল করতে শেখে, মা-বাবা ডাকতে শেখে। অনেক সময় অভিভাবকদের অজ্ঞতার কারণে এ সময় শিশুদের ওপর নেমে আসে নানা নির্যাতন। অনেক অভিভাবক মনে করেন  শাসন না করলে শিশুরা বড় হয়ে মানুষ হবে না। শিশুর ক্ষুধা নেই অথচ তার সামনে খাবার নিয়ে যাওয়া হয়, জোর করে খাওয়ানো হয়, শিশু বমি করে দেয়। তারপরও জোর করে খাওয়ানো হয়। ফলে শিশুর জেদ বাড়তে থাকে। তার মধ্যে চাপা ক্ষোভ একদিন অন্যভাবে প্রকাশিত হয় যা সমাজের জন্য অমঙ্গলজনক।

শিশুর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বয়স হওয়ার আগেই পড়াশোনার জন্য অভিভাবকদের সীমাহীন ব্যস্ততা পরিলক্ষিত হয়। শুরু হয় বাংলা, ইংরেজি, বর্ণমালা, সংখ্যা শেখানো ও লেখানোর তোড়জোর। শিশুর হাতের লেখা স্পষ্ট হতে শুরু হয় সাধারণত পাঁচ বছর থেকে। শিশুর প্রথম পাঠ বর্ণমালা হওয়ায় সে লেখাপড়ায় আনন্দ অনুভব করে না। ফলে লেখাপড়ায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। দুই বছরের শিশু প্রথমে ধীরে ধীরে বিভিন্ন বস্তুর নাম বলে। অনেক সময় নাম না বলতে পারলেও কিছু জিনিস চিনতে শেখে। অভিভাবকদের ফরমায়েশ পালনের মাধ্যমে অনেক জিনিস চিনতে ও নাম বলতে শেখে। তিন বছরের শিশুর ক্ষেত্রে ছোট ছড়া গান, অভিনয় ও আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষা শুরু করতে হবে। এ বয়সে শিশুরা রঙিন ছবিযুক্ত বই নাড়চাড়া করতে ভালোবাসে। ছবি দেখিয়ে পরিচিত জিনিসের নাম সম্পর্কে শিশুদের ধারণা দেয়া যায়।  চারপাশের পরিবেশের বাস্তব জিনিস দেখিয়ে ধারণা দেয়া যেতে পারে। পরিবেশের রং, ফুল-ফল, গাছ তরকারি, ঘরের আসবাব, দৈনন্দিন সমাগ্রীর নাম শেখানো যেতে পারে।

চার বছরের শিশুকে মা-বাবা ও আত্মীয়-স্বজনের নাম, বাসস্থানের অবস্থান, আশপাশের এলাকার নাম শেখাতে হবে। নিজের হাতে খাওয়ার কৌশল, নিরাপদ থাকা, খোলা বা বাসি খাবারের খারাপ দিক সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। আগুন, পানি, বিদ্যুৎ, ধারালো অস্ত্র, ধুলাবালি থেকে নিরপদ দূরত্বে রাখার কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে। রাস্তায় চলাচলের নিয়ম সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। খাওয়া, গল্প, খেলা কিংবা বেড়াতে যাওয়ার সময় শিশুকে ফল-ফুল, মাছ, তরকারিসহ বিভিন্ন জিনিসের নাম ও ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। কোনো অবস্থায় কিছুর নাম মুখস্থ না করিয়ে ছবি দেখিয়ে শেখাতে হবে। দৈনন্দিন ছোটখাট ফরমায়েশ আদব বা অনুরোধের সুরে করাতে হবে। শিশুকে বেশি বেশি কার্টুন, গল্প, ছড়া, কবিতা, অভিনয় ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে আনন্দময় পরিবেশে শেখাতে হবে। শিশু যা কিছু পারে তাই আঁকবে। এই আঁকার মাধ্যমে সহজ বর্ণগুলো লিখতে সাহায্য করতে হবে। কোনো অবস্থায়ই ধারাবাহিকভাবে ক, খ, গ বা অ, আ, ই, নয়। যেমন সোজা দাগের মাধ্যমে আ শেখাতে পারি। দাগের সাহায্যে ত্রিভুজ, আঁকা শিখিয়ে ব, ও, ক লেখাতে পারি । পর্যায়ক্রমে বাবা, কাকা ইত্যাদি শব্দ শিশুকে বানান করে শেখাতে বা লেখাতে পারি। এভাবে আঁকার মাধ্যমে বিভিন্ন বর্ণ ও শব্দ শেখাতে পারি। জোর করে লেখানোর প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, যে শিশু পরিবেশের যত বেশি বস্তু বা জিনিস সম্পর্কে জানবে, সে শিশু তত বেশি  জ্ঞানার্জন করবে।

শিশুর কলম ধরা বা হাতের সঞ্চালন ক্ষমতার বয়স যখন হবে, তখন সে সহজে দেখে দেখে স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ , ইংরেজি বর্ণমালা লিখে ফেলবে। অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানে রেখে শিশুদের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য স্বাধীন মতামত প্রকাশ করার সুযোগ দিতে হবে। এ বয়সে শিশু সবকিছু পারিবারিক পরিবেশ থেকে শেখে। এ জন্য অভিভাবকদের খারাপ অভ্যাসগুলো বর্জন করতে হবে। শিশুরা যে কোন বিষয়ে কৌতুহলপ্রিয়। যে কোন বিষয় তারা নিজেরাই দেখতে, ধরতে ও শুনতে পছন্দ করে। এসব ক্ষেত্রে শিশুদের যদি উৎসাহ দেয়া যায়, তবে তার নিজস্ব জ্ঞানের পরিধি বাড়ে। যেমন প্রশংসামূলক বাক্য বলা, তালি দেওয়া ও বাহবা দেওয়া।

বড়দের সালাম দেওয়া, না বলে অন্যের জিনিস না ধরা, কুশলবিনিময় করা, সদা সত্য কথা বলা, জায়গামতো জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখা, যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা না ফেলা ইত্যাদি বিষয়গুলো নীতি-নৈতিকতার সাথে জড়িত যা শিশুদের প্রাকটিক্যাল জ্ঞানের মাধ্যমে শেখাতে হবে।  দ্বিতীয় শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী যদি মিনিটে অন্তত ৪০টি শব্দ পড়তে পারে, তাহলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সেই শিশু পঠন-দক্ষতা অর্জন করেছে বলে ধরে নেওয়া হয়। ইংরেজি ভাষা পাঠে এই মানদণ্ড যুক্তরাষ্ট্রে অনুসরণ করা হয়। বাংলার ক্ষেত্রে যদিও সে রকম কোন গৃহীত মানদণ্ড নেই, আমরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড আপাতত ব্যবহার করতে পারি। মিনিটে ৪০টি মানে সেকেন্ডে একটি শব্দেরও কম, এটি পারার কথা। পঞ্চম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী যদি অর্থ বুঝে মিনিটে ৬০-৬৫টি শব্দ পড়তে পারে, তাহলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সে প্রাথমিক পর্যায়ে পঠন-দক্ষতা অর্জন করেছে বলে ধরে নেওয়া হয়। আর বাংলায় যদি সে মিনিটে ৪০টি শব্দ না আটকিয়ে পড়তে পারে তাহলে ধরে নেওয়া হয় পঠন দক্ষতায় সে উত্তীর্ণ হয়েছে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মঞ্জুর আহমেদ তাঁর গবেষণা প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে, আমাদের শিশুদের মাতৃভাষা বাংলায় পঠন-দক্ষতা যাচাইয়ের এক সরকারি জরিপের ফল অনুযায়ী দ্বিতীয় শ্রেণির শিশুদের মাত্র ৩০ভাগ শিক্ষার্থী ঠিকভাবে বাংলা পড়তে পারে। মাতৃভাষায় পঠন-দক্ষতার গুরুত্ব এত বেশি কেন? কারণ যে শিশু মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারে, সে সহজেই ইংরেজি বা অন্য এক বা দুটি বিদেশি ভাষা শিখে নিতে পারে। কাজেই বিষয়টিকে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে।

লেখক: ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত, সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ এপ্রিল ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়