ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

উপকূলের পথে

জলবায়ু পরিবর্তন, ছোট দ্বীপে বড় ধাক্কা

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৪৯, ১০ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জলবায়ু পরিবর্তন, ছোট দ্বীপে বড় ধাক্কা

রফিকুল ইসলাম মন্টু, সন্দ্বীপের উড়িরচর ঘুরে : জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা ছোট্ট দ্বীপ উড়িরচরে। জলোচ্ছ্বাস, জোয়ারের প্রভাব, লবণাক্ততার প্রভাব বেড়েছে। একইসঙ্গে পানি সংকটও তীব্র আকার ধারণ করেছে। অতিকষ্টে এ অঞ্চলের কৃষক জমিতে ফসল ফলালেও অধিকাংশ সময় তা ভেসে যায়; কিংবা লবণাক্ত পানিতে নষ্ট হয়। একদিকে ভাঙছে দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব দিক, অন্যদিকে নেই বেড়িবাঁধ। ফলে হাজারো সংকটের মাঝে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত সমস্যা এখানকার মানুষদের সারা মৌসুমই ঝুঁকির মধ্যে রাখছে।

চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের দ্বীপ উড়িরচরের নাম দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বর্হিবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে ১৯৮৫ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের কারণে। ওই প্রলয়ে দ্বীপটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ১৯৮২ সালের দিকে কেবল বসতি শুরু হওয়া দ্বীপে প্রথম ধাক্কা দেয় ঘূর্ণিঝড়। স্থানীয় বাসিন্দাদের দেয়া তথ্যমতে, এরপর থেকে বিভিন্ন সময় এ দ্বীপের ওপর দিয়ে দুর্যোগ দুর্বিপাক বেড়ে যায়। জলবায়ু পরিবর্তন এলাকার মানুষ না বুঝলেও তারা পরিবর্তন বোঝেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন, জানালেন বয়সী বাসিন্দারা। 

সন্দ্বীপের কালাপানিয়া, কোম্পানিগঞ্জের ক্লোজারঘাট, চট্টগ্রামের কুমিরা কিংবা সুবর্ণচরের চরলক্ষ্মী, যে কোন ঘাট থেকে উড়িরচরে আসার পথেই পরিবর্তনের চিত্র চোখে পড়বে। বর্ষায় বাড়িঘর ডুবে থাকার দৃশ্য আর শুকনোয় ভাঙনের দৃশ্য পরিবর্তনের প্রমাণ দেয়। দ্বীপে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়বে আরও নানাবিধ পরিবর্তন। আর এইসব পরিবর্তনের ভেতর দিয়েই এই অঞ্চলের মানুষ বেঁচে আছেন। অধিকাংশ মানুষ কৃষি কাজের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় পরিবর্তন তাদের জীবন ওলটপালট করে দেয়। একবার ফসল মার খেলেই বিপদ।



নূর জামাল (৫৫)। উড়িরচরের ৫ নাম্বার ওয়ার্ডের বাসিন্দা। জানালেন, দ্বীপের চারদিকে বেড়িবাঁধ না থাকায় ফসল ঘরে তোলার আগেই ডুবে যায়। যেমন গত আমন মৌসুমে এটা হয়েছে। জোয়ারে অস্বাভাবিক পানি এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে ফসল। দুই একর জমিতে আমন ধান ফলিয়েছিলেন তিনি। স্বাভাবিক সময়ে এই জমিতে অন্তত ৭০ মণ ধান পাওয়ার কথা থাকলেও পেয়েছেন মাত্র ৩০ মণ। ধানের দাম পেয়েছেন মাত্র ২৪ হাজার টাকা। অথচ, তার দুই একর জমি আবাদে খরচ হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। ধান আবাদে তিনি লোকসান দেন প্রায় ১৬ হাজার টাকা। দ্বীপের মানুষেরা এক ফসলে মার খেলে অন্য ফসল দিয়ে পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। নূর জামাল ধানে মার খেয়ে রবি মৌসুমে ৮ শতাংশ জমিতে আবাদ করেছিলেন ক্ষিরা। কিন্তু বরি মৌসুমে আবার লবণ পানি এসে ফসল নষ্ট করে। বেশ কয়েক বছর লবণের কারণে তিনি রবি আবাদ করতে পারেননি।

দ্বীপের ৬ নাম্বার ওয়ার্ডের বাসিন্দা কৃষক আকবর হোসেন (৩২)। নিজের এবং বর্গা জমি মিলিয়ে ১০ একর জমিতে আমন আবাদ করেন। কিন্তু প্রায় প্রতিবছরই ফসল ভেসে যায় জোয়ারের পানিতে। ফসল ভালো হলেও ধান পাকার আগেই আসে দুর্যোগ। গত আমন মৌসুমে দ্বীপের সব কৃষক লোকসান গুনেছে। একই তথ্য দেন দ্বীপের বিভিন্ন এলাকার কৃষক। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, দ্বীপের জমি উর্বর হলেও নানামূখী দুর্যোগের কারণে এখানে ফসল আবাদে বহুমূখী সমস্যা দেখা দেয়। ক্ষেতে পোকা লাগলেও প্রতিকার পাওয়া যায় না। কারণ এখানে নেই কৃষি বিভাগের সহায়তা। আমন, ইরি ছাড়াও শিম, বেগুন, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, আলু, মুলা, ক্ষিরা, কপি, মরিচ, টমেটো, করলা, সরিষা, সয়াবিন, গম, সূর্যমূখী, ক্যাপসিকামসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল আবাদ হয়। কিন্তু দিনে দিনে কৃষিতে আসছে নানা ধরনের সমস্যা। ফসলের রোগবালাই, গবাদিপশুর রোগবালাই হলেও কোনো প্রতিকার মেলে না।

কৃষকেরা জানান, কৃষিঋণ পাওয়া দ্বীপের কৃষকের কাছে ভাগ্যের ব্যাপার। কৃষি ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা ঋণ পাওয়া যায়। কিন্তু সে সংখ্যা শতকরা ১০ ভাগের বেশি হবে না। যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে দ্বীপ থেকে উপজেলা সদরে গিয়ে ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ সম্ভব হয় না। দ্বীপে বেসরকারি ঋণদানকারী সংস্থা থাকলেও চড়া সুদের কারণে সেদিকে কৃষকের আগ্রহ কম। ঋণের পাশাপাশি রয়েছে ভালো বীজের অভাব। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে যে বীজ দেয়া হয়, তা সর্বোচ্চ ১০ জনের বেশি কৃষক পান না। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, দ্বীপের দক্ষিণাংশে ভাঙনের তীব্রতা ব্যাপক। ৭, ৮, ৯ নাম্বার ওয়ার্ড সামান্য পরিমাণ অবশিষ্ট আছে। ৪, ৫, ৬ নাম্বার ওয়ার্ডও অনেকটাই ছোট হয়ে এসেছে। ফলে এই তিনটি ওয়ার্ডের বসতি ক্রমেই ঘন হয়ে আসছে। ভাঙন শুরুর আগে এখানকার মানুষের মাঝে যে স্থিরতা ছিল, তা এখন আর নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বছরে বছরে স্থানান্তর করতে হচ্ছে বাড়ি।



ক্ষয়ে যাওয়া ৭ নাম্বার ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবুল কাসেম, ৬২। মূল বাড়ি ছিল সন্দ্বীপে। ১৯৮৪ সালের দিকে এখানে আসেন। সন্দ্বীপে নদী ভাঙনে বাড়ি বদল করেছেন ৩ বার। এখানে এসেও দু’বার বদল করেছেন। এখন আবার বদল করতে হবে। নদী এতটাই নিকটে এসেছে, এবারের বর্ষায় তার এই বাড়ি থাকবে কিনা শঙ্কা রয়েছে। আরেকজন হুমায়ূন কবির (৪৮)। বাড়ি ছিল সন্দ্বীপের ডিগগার পাড়। দ্বীপে এসে তাকেও দু’বার বাড়ি বদল করতে হয়েছে। এখন আবার বদলের সময় এসেছে।    

ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) আবদুর রহিম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দ্বীপের ফসল এবং গবাদিপশুর ব্যাপক ক্ষতি হয়। গবাদিপশু মারা যায়। ধান আবাদে ক্ষতি হয়েছে। শুকনো মৌসুমে দ্বীপ একেবারেই পানিশূন্য হয়ে পড়ে। আবার কখনো লবণাক্ত পানি আসে। ফলে কোনো শস্য আবাদ করা যায় না। বলা যায়, এখানে ৬ মাস মিঠা পানি, ৬ মাস লবণ পানি থাকে। বর্ষা শেষ হলেই লবণের প্রভাব বাড়ে। কিছু এলাকায় গাছপালা মারা যায়। অনেক এলাকায় ভাঙনের তীব্রতা বাড়ে। তিনি বলেন, দ্বীপ ইউনিয়ন হিসাবে এখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে বরাদ্দ আসে না। যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হলে কৃষিতে এখানে রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। সার ওষুধ যেমন পাওয়া যায় না, তেমনি প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবেলা করে ফসল আবাদ করে কৃষকেরা পান না ন্যায্যমূল্য। ফসল রক্ষা করতে হলে, জনজীবনে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে দ্বীপের চারিদিকে বেড়িবাঁধ দিতে হবে। বাঁধ হলে জোয়ারের পানি আর লবণাক্ততার গ্রাস থেকে রক্ষা পাবে ফসল।  




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ এপ্রিল ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়