ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সাম্প্রতিক রীতির অধিকাংশই পুঁজিবাদের বিবর্তন, প্রসঙ্গ মা দিবস

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৩, ১৩ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সাম্প্রতিক রীতির অধিকাংশই পুঁজিবাদের বিবর্তন, প্রসঙ্গ মা দিবস

হাসান মাহামুদ: বিজ্ঞানমনস্কতা থেকে যুক্তিমনস্কতা! কেউ কেউ এর পরের স্তরের নাম দিয়েছে ‘নাস্তিকতা’। এসব কি শুধুমাত্র এক একটি মতবাদ নাকি এক একটি আন্দোলন! মোটাদাগে তা গুরুগম্ভীর আলোচনার বিষয় হতে পারে।

গত কয়েক বছর ধরেই এই যুদ্ধ কিংবা বিতর্কটা চলছে প্রকাশ্যে, আপনার-আমার চোখের সামনে, চিন্তা-ভাবনার সীমারেখায়। তাই আমরা ইদানিংকালে ধর্মীয়বাদ, নাস্তিকতা– এসব নিয়ে বেশি আলোচনা দেখছি, আলোচনায় পড়ছি। অপ্রকাশ্যে কিংবা অপার্থিবভাবে যে ধারা বর্তমানে সবকিছুকেই করায়ত্ত করে নিচ্ছে, কিংবা অলক্ষ্যে সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছে তা হচ্ছে পুঁজিবাদ। বর্তমান যুগকে বলা হয়, তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। প্রযুক্তির এই বিকাশ জীবনকে অনেক বেশি আকর্ষণীয় এবং সহজ করেছে। এই তথ্যপ্রযুক্তিও কিন্তু পরিচালিত হচ্ছে পুঁজিবাদের ইশারায়, একই সঙ্গে পুঁজিবাদের লক্ষ্যে।

মানুষ যখন থেকে শিক্ষাগ্রহণ শুরু করেছে, তখন থেকে অলিখিতভাবে একটি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। আর তা হলো- কুসংস্কার দূর করার আন্দোলন। শান্তি, ভ্রাতৃত্ব ও একতা বজায় রেখে এবং আমাদের মৌলিক সংস্কৃতিকে প্রবাহিত রেখেই আমরা বলতে গেলে প্রতিনিয়তই কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জ্ঞানে কিংবা অজান্তে যুদ্ধ করে যাচ্ছি। যদিও মৌলিক সংস্কৃতির প্রবাহিত ধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে এখন নতুন একটি চ্যালেঞ্জ ও যুদ্ধের নাম বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। একে আধুনিক যুগের কুসংস্কার বললে হয়তো খুব বেশি ভুল হবে না। এই আগ্রাসনের প্রভাবে বহুযুগ ধরে প্রবহমান বাঙালি সংস্কৃতিতে এমন সংস্কার আমরা করে চলছি, যা আমাদের মূল্যবোধ, মানবিকতা এবং আমাদের সভ্যতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের পরিবর্তে তাকে ধ্বংস, ক্লিষ্ট ও বিদ্ধ করে চলছে। এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনও কিন্তু পুঁজিবাদেরই একটি অংশ।

পুঁজিবাদ নিয়ে এতো বেশি কথা বলার কারণটা পরিষ্কার করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের বয়স এখন মাত্র সাতচল্লিশ। দীর্ঘ সংগ্রাম ও যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি দেশ যখন স্বাধীনতা অর্জন করে, তখন সে দেশের সামনে সর্বাগ্রে যে চ্যালেঞ্জটি বড় হয়ে দাঁড়ায় তা হলো- অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। অর্থনৈতিক মুক্তির পর, ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলে স্বাস্থ্যগত ও শিক্ষাগত চ্যালেঞ্জ, অবকাঠামো উন্নয়ন, সংস্কৃতিকে অক্ষুন্ন রেখে বিশ্ববাজারে প্রতিনিধিত্ব করতে পারার সক্ষমতাসহ প্রভৃতি প্রয়োজনীয় চ্যালেঞ্জ অর্জন করতে পারা। আমরা এখন সেই স্টেজে বা পর্যায়ে রয়েছি। এ কারণে পুঁজিবাদের ধাক্কায় আমরা বেশি প্রভাবিত হচ্ছি। যার একটি বলিষ্ঠ উদাহরণ হচ্ছে- মা দিবস।

গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে ‘মা দিবস’ পালিত হচ্ছে। বর্তমানে বেশিরভাগ দেশেই মা দিবস হলো একটি সাম্প্রতিক রীতি। আমাদের দেশেই তাই। ‘মা দিবস’ বিষয়টিকে পুঁজিবাদের বিবর্তনের বলিষ্ঠ উদাহরণ বলার তিনটি কারণ বলা যেতে পারে। ধর্মীয়, ভৌগোলিক ও আদর্শিক।  প্রথমত, আমাদের এই অঞ্চল বিভেদহীন ধর্মীয় ভাবধারায় বিশ্বাসী একটি ভূ-খণ্ড। ধর্মীয় মতভেদের কারণে আমাদের এখানে খুনাখুনি হয়তো হয়েছে, কিন্তু ধর্মীয় একাত্মতার জন্য কখনো উচ্চবাচ্য হয়নি। অথচ, সেখানেই ইদানিং ‘মা দিবস’ পালিত হচ্ছে জাতীয়ভাবে, যেখানে ধর্মে মাকে সর্বোচ্চ মর্যাদাকর স্থানে অধিষ্ঠিত করে রেখেছে। এই বিষয়ে ইসলাম, হিন্দুসহ সব ধর্মেই মৌলিকভাবে মিল রয়েছে। মাকে ভালোবাসা আর তার প্রতি হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধার বিষয়টি পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলোতে অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

ভৌগোলিক কারণটি একটু মনস্তাত্ত্বিক ও সমাজব্যবস্থার রীতির সাথে সম্পৃক্ত। আমরা জন্মের পর থেকে বড়দের মুখে শুনে আসছি, বাবা-মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত, বাবা-মা’ই দ্বিতীয় স্রষ্টা, বাবা এবং মায়ের মধ্যে মা’কেই বেশি প্রাধান্য দিতে হয়, প্রভৃতি। এসব শুনতে শুনতে আমাদের মগজে বিশেষ করে মায়ের জন্য এমন একটি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার স্থান তৈরি হয়, সে আবেগের সাথে পৃথিবীর অন্য কোনো আবেগের মিল নেই। আবার ধরুন, ভারতবর্ষ শুরু থেকেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পরিচালিত। এ কারণেও মায়েদের প্রতিটি সন্তানের ভালোবাসাটা একটু আলাদা হয়। কারণ মায়েরা সবসময় শাস্তি দেওয়ার বদলে আদর দেওয়ার আচরণই করে থাকে। তাই সন্তান যদি পুরুষও হয়, তবু মা’কেই ভালোবাসে বেশি।

এখনো আমাদের অধিকাংশজনই বিশ্বাস করি, মায়ের প্রতি ভালোবাসা কখনো দিবস দিয়ে পূরণ করা যায় না। মায়ের জন্য ভালোবাসা প্রতিদিনের। অথচ এই অধিকাংশজনের আদর্শ মার খাচ্ছে, ঠিকই মা দিবস পালিত হচ্ছে আমাদের মতো দেশগুলোতে। সবচেয়ে কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে- এই পুঁজিবাদ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন কিংবা আধুনিকতার প্রভাব নিয়ে যতই কথা বলা হোক না কেন, এসবের কারণে যেসব বিষয়ের উদ্ভব বা প্রচলন হচ্ছে, সেসব বহাল তবিষতেই থাকবে। কারণ, এসবই বিশ্বায়নের চাহিদা। কথা হচ্ছিল সাম্প্রতিক রীতি নিয়ে। আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠাও একটি সাম্প্রতিক রীতি। একটু লক্ষ্য করুন, আজ থেকে বিশ বছর আগেও বাংলাদেশে মানুষ বৃদ্ধাশ্রম কনসেপ্টটা বুঝতো না। এখন বৃদ্ধাশ্রম একটি প্রয়োজনীয় স্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ দেশে একান্নবর্তী বা যৌথ পরিবারের সংখ্যা কমে যাওয়ার সাথে পারিবারিক বন্ধন নষ্ট হওয়ার পথে। তার উপর রয়েছে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার মাত্রাতিরিক্তি পেশাদারি মনোভাব ও সময়ের অভাব। আমাদের এক সময়ের সরল জীবন এখন কর্পোরেট কালচারে প্রবেশ করে যাচ্ছে। এখানে ‘মা দিবস’ শুধুমাত্র জাতীয়ভাবে ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোও মা দিবসের অফার দেয়, টেলিভিশন চ্যানেল মা দিবসের অনুষ্ঠান প্রচার করে, বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজ-ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান মা দিবসের অফার দেয়, গণমাধ্যমগুলোও মা দিবসের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ ও প্রচার করে।

ফলে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস, বিশ্ব খাদ্য দিবস, বিশ্ব প্রবীণ দিবস, বন্ধু দিবস, বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ দিবস, আন্তর্জাতিক বাস্তুহারা দিবস, আন্তর্জাতিক কবুতর দিবস, আন্তর্জাতিক বর্ণবৈষম্য দিবস, আন্তর্জাতিক নারী দিবস, সামাজিক ন্যায়বিচার দিবস, বিশ্ব জলাভূমি দিবস, পথশিশু দিবস, সর্বোপরি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস বা ভ্যালেন্টাইনস ডে- এসব খুব বেশি বছর আগের কথা নয়। অর্থ্যাৎ, এসবই অধিকাংশ দেশের সাম্প্রতিক রীতি। আর সাম্প্রতিক রীতি মানেই পুঁজিবাদ এবং আধুনিকতার প্রভাব। তেমনি ‘মা দিবস’ ও আমার-আপনার মননে-মগজে ঢুকে যাচ্ছে অলক্ষ্যে। অথচ, আমাদের উচিত ছিল মা দিবস উপলক্ষ্যে মায়েদের আত্মত্যাগ, মায়ের গুরুত্ব, একজন সন্তানের জীবনে মায়ের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আর্টিকেল প্রকাশ করা, তথ্যচিত্র প্রচার করা প্রভৃতি। আর সাধারণ মানুষ সর্ম্পকে বলা যায়- যেহেতু, মা’কেই আমরা সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি, মায়ের স্থানে কেউ আসতেও পারবে না। সেক্ষেত্রে মায়ের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে আমাদের কখনোই আপোষ বা সমঝোতা করবো না। একটি বিশেষ দিবসে তো মায়ের প্রতি ভালোবাসাকে আবদ্ধ করে রাখা যায় না। তবে মা দিবস নিয়ে আমাদের ভাবনাটা হতে পারে এমন- প্রতিদিনই আমরা মাকে ভালোবাসবো, আর বিশেষ দিনটিতে মায়ের প্রতি আধুনিকতার মোড়কে জড়ানো ভালোবাসাটাও দেখাবো। কারণ মায়েরা তো তিলোত্তমা। মায়ের প্রতি ভালোবাসাটা কিংবা ভালোবাসার উপলক্ষ্যগুলোও তাই তিলোত্তমাসম্ভব হওয়া বাঞ্ছনীয়।

লেখক: সাংবাদিক




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ মে ২০১৮/হাসান

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়