ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বিশ্ব কাঁপছে বিশ্বকাপ জ্বরে

কমলেশ রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪৭, ১১ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিশ্ব কাঁপছে বিশ্বকাপ জ্বরে

কমলেশ রায় : রক্ষে নেই। কোনোভাবেই নেই। কেউই এর ছোঁয়া থেকে বাঁচতে পারছে না। বোধকরি বাঁচতে চাচ্ছেও না। হালে একখানা ‘অসুখ’ দেখা দিয়েছে। ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে। দুই গোলার্ধের সবখানে। সমান তালে, সমগতিতে। বিশেষ সতর্কবার্তা: ‘কেউ ভয় পাবেন না। মোটেই ভয় পাবেন না।’ কী সেই অসুখ? যেনতেন না, অসুখটা একেবারে খানদানি। আনন্দ-অসুখ। আর এতে কমবেশি সবাই ভুগছে। ভুগবে। এই অসুখের উপসর্গ নাকি জ্বরগোত্রীয়। মিষ্টি করে তাই আদুরে একটা নামে ডাকা হচ্ছে একে। তা নামখানা কী? আরে, বিশ্বকাপ জ্বর। জ্বরের সেরা জ্বর। বিশ্বকাপ জ্বর।

‘বিশেষ’ এই জ্বরের কোনো চিকিৎসা নেই। কোনো ওষুধেও তেমন কাজ হবে না। উপায় নেই, ভুগতেই হবে। ওষুধ খেলে ৩০ দিন। না খেলে একমাস। জ্বর-জ্বর ভাব শুরু হয়েছে আগেই। কাঁপিয়ে জ্বর শুরু হবে ১৪ জুন। হাড়-কাঁপুনি দিয়ে জ্বর ছাড়বে সেই ১৫ জুলাই। এই আনন্দ-অসুখে এখন কে না আক্রান্ত? এই জ্বরের কাঁপুনিই আলাদা। ছোকড়া কাঁপে, বুড়ো কাঁপে। তরুণী কাঁপে, বৃদ্ধা কাঁপে। গৃহকর্তা কাঁপে, গৃহবধু কাঁপে। জগতের সবাই কমবেশি কাঁপে। কী আছে এই বিশ্বকাপে? যাকে নিয়ে এত কাঁপাকাপি। চারপাশ উত্তেজনায় কাঁপছে থরথর।

বলি, কী নেই বিশ্বকাপে? আছে আনন্দ, আছে উত্তেজনা। আছে নৈপুণ্য প্রদর্শনের সুযোগ। দলবদ্ধ হয়ে চলার শপথ। আছে জয়ের তীব্র ক্ষুধা, প্রবল বাসনা। পরাজয় মেনে নেওয়ার মানসিকতা। আছে জীবনবোধের শিক্ষা। শান্তির বারতা। বিশ্বশান্তির ডাক। আর তাই সবার অজান্তেই এই বিশ্বকাপ সবাইকে এভাবে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে যায়। বেঁধে ফ্যালে এক বিনি সূতায়। দেখতে গোল। গোলকার। এই গোলের মহিমা অপার। এই গোল বাঁধায় গোল। ছাড়ায় গোল। এই গোল নিয়েই এখন যত গণ্ডগোল। তুমুল আলোচনা, বাকবিতন্ডা। কথার ফুলঝুরি। চায়ের কাপে ঝড়। ঘরে ঘরে। পাড়ায় পাড়ায়। গ্রামে গ্রামে। শহরে শহরে। বন্দরে বন্দরে। নগরে নগরে। দেশে দেশে। মহাদেশে মহাদেশে। ভৌগলিক সীমানা ছাড়িয়ে। তামাম বিশ্বজুড়ে। বিশ্বকাপ ফুটবল বলে কথা।  বিশ্বকাপকে ঘিরে কত ব্যবসা। কত বিনিয়োগ। ফুটবলের অদৃশ্য জাদুতে চাঙ্গা আর সচল হয়ে উঠেছে বিশ্ব অর্থনীতি। গোলাকার এই গ্রহের সব দৃষ্টি এখন রাশিয়ার দিকে। গোলাকৃতির ফুটবল নিয়ে মেতেছে পৃথিবী। উল্লাসে ফেটে পড়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে ফুটবল ভক্তরা। গোল! গোল!! কী দুর্দান্ত গোল!!!

আমাদের দেশেও কী কম উন্মাদনা বিশ্বকাপকে ঘিরে। একেবারে যাকে বলে সাজ সাজ রব। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার লালপুর এলাকায় চোখ আটকে যাওয়া কান্ড ঘটিয়েছেন জয়নাল আবেদীন টুটুল। পছন্দের দলের প্রতি ভালোবাসা জানাতে ছয়তলা ভবনের পুরোটাই রাঙিয়েছেন ব্রাজিলের পতাকার রঙে। এই ভক্তের ‘ব্রাজিল বাড়ি’ দেখতে যাচ্ছেন ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূত জোয়াও তারাবা। বরিশাল নগরের রাখাল বাবুর পুকুর এলাকায় ঘটেছে আরেক কাণ্ড। আর্জেন্টিনার পতাকার রঙে বাড়ি রাঙিয়েছেন জামাল মিয়া। মাগুরায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ জার্মান পতাকা বানিয়েছেন আমজাদ হোসেন নামের এক ফুটবলপ্রেমী। প্রিয় দলের প্রতি ভালোবাসা জানাতে চমকে দেওয়া কত কা-ই না করছেন সমর্থক-ভক্ত-অনুরাগীরা।

বাড়িতে বাড়িতে উড়ছে পতাকা। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল, মিসর, রাশিয়া, জাপান...। বত্রিশ দেশ, কত সমর্থক। আমাদের আকাশ এখন যেন একখণ্ড বিশ্বমানচিত্র। আমাদের বাতাসে বিশ্বকাপের আগমনী গান। তবে বাংলাদেশে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের সমর্থকই বেশি। পতাকা বিক্রেতাদের কাছ থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান সেরকমই সাক্ষ্য দেয়। জার্মানির সমর্থক আগের তুলানায় বেড়েছে বলে জানা গেছে।

পতাকা বিক্রেতার ওখানে দাঁড়িয়ে আছি। বললাম, বিক্রি কেমন? বিক্রেতা জানালেন : ‘বিক্রি ভালোই। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল বেশি। মাঝে-মধ্যে জার্মানি। দিনে হঠাৎ দুই-একটা স্পেন, ফ্রান্স, জাপান, পর্তুগাল...।’এরই মধ্যে মাঝ বয়স পেরুনো এক ভদ্রলোক এলেন। পতাকা দরদাম করলেন। আর্জেন্টিনা কত, ব্রাজিল কত? দুই ছেলের জন্য। দুই ভাই দুই দলে। টুকটাক কথাবার্তার একপর্যায়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘কবে যে বিশ্বকাপ এলে নিজের দেশের পতাকা কিনতে পারব!’ জবাবে আমি মাপা হাসি দিলাম। উনি অর্থটা বুঝতে পেরে বললেন, ‘ক্রিকেটে তো আমরা পেরেছি। তাহলে ফুটবলে নয় কেন? আগে আমাদের দেশে ফুটবলই সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ছিল।’ সব কথার কী জবাব দেওয়া যায়? নাকি সব কথার জবাব হয়? আবেগ আর বাস্তবতার পার্থক্য যে অনেক। যোজন যোজন দূর। হঠাৎই একটা সাক্ষাৎকারের কথা মনে পড়ল। অনেকদিন আগের কথা। সম্ভবত ১৯৯৪ সাল। তখনকার জনপ্রিয় এক নায়িকাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, এবারের বিশ্বকাপে আপনার প্রিয় দল কোনটি? চিত্রনায়িকা স্বদেশপ্রেম নমুনা দেখাতে ঘাড় নাড়িয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলেছিলেন: ‘অফকোর্স বাংলাদেশ।’ বলা বাহুল্য, উনার জ্ঞানের বহর দেখে সেই সময়ে সেই সাক্ষাৎকার পড়ে অনেকেই মুখ টিপে হেসেছিলেন।

তিন বন্ধু আড্ডা দিচ্ছে। আলোচনার কেন্দ্রে অবশ্যই বিশ্বকাপ। আর তিনজন তিন দলের সমর্থক। আজেন্টিনার সমর্থক বলল, ‘ব্রাজিলের অবস্থা হলো, আমার দাদী সুন্দরী ছিল ঠিক সেই রকম। আগে রূপ যৌবনের ছটা ছিল, এখন নেই।’ এরপর ব্রাজিলের সমর্থক চুপ থাকে কী করে, বলল, ‘বোকার মতো কথা বলো না। ব্রাজিল মানেই ধ্রুপদী খেলা। শৈল্পিক ফুটবল।’ মুচকি হেসে আর্জেন্টিনার সমর্থক বলল, ‘খেলার কথা আর বলো না বন্ধু। সাম্বা নাচ আর বক্ষবন্ধনীর জেল্লা ছাড়া ব্রাজিলের এখন আর আছেটা কী?’ ব্রাজিলের সমর্থক হালকা রেগে জবাব দিলো, ‘ফুটবল একজনের নয়, এগারোজনের খেলা, এটা মনে রেখো।’ মেসিকে নিয়ে খোঁচাটা স্পষ্ট টের পেল আর্জেন্টিনার সমর্থক। পাল্টা খোঁচা দিয়ে সে বলল, ‘ওহ্, রাখো তোমার নেইমার। নাম থেকেই তো বোঝা যায় ওর ঘটে কী আছে। নেইমার। একটু ভাগ করে বললে নেই মার। মানে মার নেই। পায়ে মার নেই যার, নেইমার।’ ব্রাজিলের সমর্থকও ছেড়ে দেওয়ার বান্দা নয়। সে বলল, ‘ব্রাজিলের এগারোজন খেলোয়াড় যখন মাঠে প্রজাপতির মতো ধ্রুপদী ফুটবল খেলবে তখন তাদের সামনে মেসিকে কী মনে হবে, জানো? মনে হবে মেসি নয়, মাছি। একটা মাছি।’ পরিস্থিতি উত্তপ্ত হচ্ছে দেখে এতক্ষণ চুপ করে থাকা তৃতীয় বন্ধু এবার মুখ খুলল। হালকা একটু কেশে নিয়ে সে বলল, ‘কেন যে তোমরা অযথা ঝগড়া করো। জার্মানিকে দেখে শেখো। আমার আর আমার দলের নীতিই হচ্ছে : কথা কম, কাজ বেশি। পুতুপুতু ফুটবল নয়, লম্বা পাসে খেলে। লম্বা রেসের ঘোড়া। গত বিশ্বকাপের কথা তোমাদের মনে নেই। ব্রাজিল বলো, আর্জেন্টিনা বলো, জার্মানির সামনে কিছু না। সামনে এলে সবাই তালগোল পাকিয়ে ফ্যালে।’ অন্য দুই বন্ধু তর্ক করবে কী, জার্মানির সমর্থকের কথার তোড়ে ভাষা হারিয়ে ফেলল। সেটা বুঝতে পেরে ওই দুজনের পেটে আলত করে খোঁচা দিয়ে তৃতীয় বন্ধু বলল, ‘বুঝেছো বন্ধুরা, চ্যাম্পিয়নরা এ রকমই হয়। একেবারে নাকাল করে ছাড়ে। তা তোমাদের কী মত ?’ মতামত তো পরের কথা। মোক্ষম খোঁচার পর সেদিন আর আড্ডাটা জমেনি, ভেস্তে গেছে।

অন্যসময় রোনালদোর নাম মেসির সঙ্গে সমান তালে উচ্চারণ হলেও বিশ্বকাপ এলেই তিনি কিছুটা পিছিয়ে পড়েন যেন। সেটা কী তার দলের কারণে? হয়ত। পর্তুগালের সমর্থক কম, তবে রোনালদোর ভক্ত অনেক। পছন্দের দল ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনা, কিন্তু রোনালদো প্রিয় খেলোয়াড়, এমন মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে কিন্তু অনেক। সালাহ, বেনজামা, সুয়ারেজের এ ধরণের ভক্তের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশ্বকাপ ঝড় বইছে। সমর্থকরা নিজ নিজ দলের পক্ষে যেন জান কোরবান করতেও রাজি। কেউ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান। নিজ দলকে বড় করে তুলতে কেউই পিছিয়ে থাকতে নারাজ। তাই চলছে সমর্থকদের যথাসাধ্য শো-ডাউন। শোভা পাচ্ছে অজস্র বাক্যবাণ। এক স্ট্যাটাসে ব্রাজিলের এক কট্টর সমর্থক (পেশায় উনি কলেজ শিক্ষক) লিখেছেন : ‘কৌতুক : শেরশাহ সর্বপ্রথম ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করেন। তাহার পূর্বে ঘোড়া ডাকিতে পারিত না। বাস্তবতা : ফুটবলে ম্যারাডোনা সর্বপ্রথম হাত দিয়ে গোল করা প্রচলন করেন। তাহার পূর্বাপর ফুটবল পায়েই খেলা হয়।’ নিচে অবশ্য কয়েকজন মন্তব্য করেছেন: ‘ঈশ্বরের হাতকে আপনি ম্যারাডোনার হাত বলছেন কেন?’

আমার স্নেহভাজন এক সাংবাদিক। ব্রাজিলের সমর্থক। তার ছেলে আবার আর্জেন্টিনার সমর্থক। এ তো দেখি ‘বাপ-বেটার যুদ্ধ’। একেবারে বাংলা সিনেমা। তো বাবা ছেলেকে মার্কেটে নিয়ে গিয়ে জার্সি কিনে দিলেন। আর্জেন্টিনার জার্সি। ছেলের আবদার বলে কথা। সুতরাং কিনতেই হবে। কোনো বাবার সাধ্য আছে , না কিনে দিয়ে পারবেন? বাবা-ছেলের ছবিসহ স্ট্যাটাস দিলেন ওই সাংবাদিকের পত্নী। তিনি লিখলেন : ‘ ব্রাজিল সমর্থকরা উদার হন। অন্যের সমর্থনকে শ্রদ্ধা করেন। পকেটের টাকা খরচ করে ছেলেকে (ঘরের শত্রু...) তার পছন্দের জার্সি কিনে দেন।’ পাঠক, আপনাদের কাছে আমার প্রশ্ন , বলুন তো ওই ভদ্রমহিলা কোন দলের সমর্থক? একটু ভাবুন, উত্তর পেয়ে যাবেন। ছেলে আর্জেন্টিনা। মেয়ে ব্রাজিল। লেখক বাবা তাদের জার্সি পরা ছবি দিয়ে লিখেছেন: ‘ আমার পরিবারে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা দুদলই আছে। ... এই দুই দলের খুনসুটি থামাতে আমার হাতে রেফারির বাঁশি নিতে হয়।’

ফেসবুকে একটা আহ্বানে চোখ আটকে গেল। দুই পথশিশু দাঁড়িয়ে আছে একটা পোস্টার হাতে। তাতে লেখা : ‘ভিনদেশী দলের পতাকা না কিনে, আমাকে একটি জামা কিনে দিলে কী হয়?’ আসলেই তো ভাববার মতো বিষয়। এবার বিশ্বকাপ আর ঈদ একসঙ্গে। আনন্দই আনন্দ। খুশিই খুশি। এই সময়ে আমরা যদি একটু বিবেচক হই, মন্দ কী। আমরা চাইলেই পথশিশুদের গায়ে নতুন রঙিন পোশাক চড়তে পারে। ওদের গায়ে রঙিন পোশাক প্রিয় দলের পতাকার চেয়ে কম ঝলমল করবে না। ওরা আনন্দে পতাকার চেয়ে বেশি পতপত করে উড়বে। পছন্দের দলের জার্সিও তো কিনে দেওয়া যেতে পারে; কোনো পথশিশুকে কিংবা অস্বচ্ছল পরিবারের কোনো শিশুকে। বিশ্বকাপের আনন্দ তাতে আরও বাড়বে। দ্বিগুণ কিংবা তার চেয়েও বেশি হয়ে ধরা দেবে। আমাদের সুমতি হোক। আমরা মিলে-মিশে আনন্দ উদযাপন করতে শিখি। ধর্মীয় উৎসব কিংবা বিশ্বকাপ আমাদের কাছে এই গভীর বার্তা নিয়েই হাজির হয়।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যসেবক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ জুন ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়