ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

চিকিৎসা বন্ধের আলটিমেটাম গ্রহণযোগ্য নয়

রিয়াদ খন্দকার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:০৬, ৯ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চিকিৎসা বন্ধের আলটিমেটাম গ্রহণযোগ্য নয়

রিয়াদ খন্দকার : আমাদের দেশে এখনো মানুষ চিকিৎসককে 'ডাক্তারবাবু', 'ডাক্তারসাব', 'ডাক্তারসাহেব' বলেই ডাকেন।  কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে তাদেরকেই সর্বোচ্চ শিক্ষিত, ভদ্র ও মার্জিত পেশাজীবি হিসেবে দেখা হয়। হয়ত পেশাটি জন্ম -মৃত্যুর সাথে সম্পর্কিত বিধায় জনমনে তা ঈশ্বরতুল্য। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই চিকিৎসকরা এখন নিজেরাই নিজেদের ঈশ্বর ভাবতে শিখে গেছেন! একটি হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠায় চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতাল মালিকরা অনির্দিষ্টকালের জন্য সেবা বন্ধ করে দিয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে একটি গণতান্ত্রিক দেশে এমন স্বৈরাচারী মানসিকতার একটি গোষ্ঠী বেড়ে উঠছে আমরা কেউ তা খেয়ালই করিনি।

সম্প্রতি চট্টগ্রামে সাংবাদিক কন্যা রাইফা খানের মৃত্যুতে সিভিল সার্জন গঠিত তদন্ত কমিটি হাসপাতাল ও চিকিৎসকের অবহেলায় শিশু রাইফার মৃত্যু হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে। বিধি অনুযায়ী হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে। ফলশ্রুতিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মোতাবেক  র‌্যাব অভিযান চালিয়ে হাসপাতালটির ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে, এ সময় চিকিৎসকদের প্রতিনিধি হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন প্রতিনিধিও ছিলেন। কিন্তু এর প্রতিবাদে অভিযুক্ত হাসপাতালটির মালিক ডা. লিয়াকত আলী খান প্রাইভেট হসপিটাল অ্যান্ড ল্যাব ওনারস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার সুবাদে চট্টগ্রামে সকল বেসরকারি হাসপাতালে সেবা বন্ধের ঘোষণা দেয়। এই ঘোষণা ধৃষ্টতা ছাড়া আর কি হতে পারে? কয়েকদিন আগেও অভিযুক্ত ডাক্তারদের থানায় নিয়ে আসার কারণে চট্টগ্রামে ডাক্তারদের একজন নেতা রাজনীতিকদের স্টাইলে থানায় বসে হুমকি ধামকি দিয়ে বলেছেন, সাংবাদিকদের সন্তানদের চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে দেয়া হবে। আবার এই তোলপারের মাঝে কিছু কাঁচা চুলের চিকিৎসক সোস্যাল মিডিয়ায় মেডিক্যাল সায়েন্সের ভাষায় বিভিন্ন লজিক দিয়ে বিষয়টি জাস্টিফাই করার চেষ্টা করলেন। মাছি মারা কেরানী টাইপ বিদ্যা জাহির করে সাংবাদিকদের ঢালাওভাবে অশিক্ষিত মূর্খ বলে গালিও দিলেন তাদের অনেকে। এর মানে কী চিকিৎসকদের অপকর্মের কোনো বিষয় ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, তাদের কোনো দোষ বিবেচ্য হবে না। ফেইসবুকে এই কাঁচা চুলের চিকিৎসকরা দায়িত্ব জ্ঞানহীনভাবে বলছেন: 'আপনারা যেহেতু এতোই বুঝেন নিজেদের চিকিৎসা নিজেরাই করান'। তাদের এই কথা মত এখন সবাই যদি নিজেদের চিকিৎসা নিজেরাই করেন বা পাশের দেশে ঢুঁ মারেন তাহলে তো চিকিৎসকরাই না খেয়ে মরবেন! এমনই এক অদ্ভুত চিন্তাধারায় বেড়ে উঠছে এই প্রজন্মের চিকিৎসক সমাজ।

আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, কথায় কথায় চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে দেবার এই লাইসেন্স চিকিৎসকদের কে দিয়েছে? এই উপমহাদেশে এটি সেবা থেকে কবে যে ব্যবসা এবং রাজনীতিতে পরিণত হলো আমরা জানতেই পারলাম না। তারা জানে না শুধুমাত্র গলার ব্যথাজনিত কারণে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া একটি শিশুর ইনজেকশন পুশের সাথে সাথেই মৃত্যুর কারণ বুঝার জন্য পিএইচডি করতে হয় না। এখন কী তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে লিখতে হলে একজন সাংবাদিককে মেডিকেল সায়েন্স মুখস্ত করে তারপর রিপোর্ট লিখতে হবে। কী অসম্ভব সব যুক্তি!  আমি বুঝি না এই তরুণ ডাক্তারদের পাঠ্যসূচীতে কী 'সাংবাদিক ঠেকাও' বিষয়ক কোনো কোর্স আছে? তাহলে তারা এ বিষয়ে এতো এক্সপার্ট কীভাবে হলেন? 

চিকিৎসকদের চিকিৎসা সেবা বন্ধের আলটিমেটাম রোধ করতে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় সুনির্দিষ্ট কোনো আইন, নীতিমালা বা নির্দেশনা প্রয়োজন। আমাদের দেশে শুধুমাত্র 'মেডিকেল শপথ' নির্দেশনা হিসেবে আছে। কিন্তু ইউরোপে এটা আইন করা হয়েছে এবং তা বাধ্যতামূলক। চিকিৎসাবিদ হিপোক্রিটাস যে শপথনামা তৈরি করেছিলেন তার একটি বাক্য এ রকম: ‘এই শাস্ত্র আয়ত্ত করার অধিকার কেবল তাদেরই যারা এই শাস্ত্রের নীতি মান্য করার প্রতিশ্রুতিতে স্বইচ্ছাতে আবদ্ধ’। ফলে বর্তমানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পলিটিক্যালি মোটিভেটেড চিকিৎসক এই শাস্ত্র আয়ত্ত করার অধিকার হারিয়েছে। নচিকেতা নিশ্চয়ই এমন কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার সাক্ষী হয়ে রাগ করে লিখে ফেলেছিলেন 'কসাই জবাই করে প্রকাশ্য দিবালোকে ওদের আছে ক্লিনিক আর চেম্বার, ও ডাক্তার'। প্রতিষ্ঠা পাওয়া এই উপমা নিয়ে আমার আগেও আপত্তি ছিলো এখনো আছে।

বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা বা গুটিকয়েকের জন্য গোটা একটি পেশাকে বাজেভাবে উপস্থাপন অনুচিত। কারণ এই পেশাতে দেবতুল্য মানুষের অভাব নেই।  এমন একজন স্বনামধন্য চিকিৎসক আছেন ফেসবুকে। তার কবিতা বা গদ্য পড়লে আক্ষেপ হয়, তিনি শুধুমাত্র ডাক্তার হয়েছেন বলেই জাতি একজন তুখোর লেখককে হারালো। অন্যদিকে এমনও একজন জনপ্রিয় চিকিৎসক আছেন  যিনি একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন, রিয়াদ কর্মজীবনে এতো টাকা উপার্জন করেছি, কীভাবে খরচ করবো বুঝতে পারছি না।' এমন মানুষগুলোর সামনে বসলেই রোগ অর্ধেক চলে যায়।  কিছু ব্যবসায়িক, রাজনীতিবাজ চিকিৎসকের জন্য গোটা পেশাটিই আজ জনগণের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছে।  প্রতিটি পেশায় ভুল হতে পারে।  তবে যদি কোনো চিকিৎসক ভুল করেন তাহলে ভুলের পরিমাণটি জনগণের টলারেন্স সীমা অতিক্রম করবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ বিষয়টি মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত।  যারা এই পেশায় এসেছেন তারা বিষয়টি জেনে বুঝেই এসেছেন। শুধু বইয়ের মুখস্ত পড়া প্রেসক্রিপশনে উগরে দেওয়া মানেই চিকিৎসা নয়, কাঁচা চুলের ডাক্তারদের রোগীর মনস্তত্ত্ব বুঝার জ্ঞান থাকতে হবে। মেডিকেল শিক্ষা কারিকুলামে বিহেভিরিয়াল সায়েন্স এবং সোশ্যাল সায়েন্স বিষয়াবলী কি অন্তর্ভুক্ত করা আছে? বা বিচ্ছিন্নভাবে থাকলেও তা কি পর্যাপ্ত? বা বর্তমান দেশের মেডিকেল শিক্ষা হবু ডাক্তারদের সামাজিকীকরণে কতটা ভূমিকা রাখছে? বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা জরুরী।

কয়েকটি পেশা আছে যার দক্ষতা জেনারালাইজ করা খুবই কঠিন। এর মধ্যে একটি হলো সাংবাদিকতা।  দেখা গেলো সারাদিন পাড়ার মোড়ের দোকানে চা খাওয়া পরিচিত বখাটে ছেলেটি হঠাৎ করে পলিটিক্যাল তদবিরে সাংবাদিক হয়ে প্রেসকার্ড গলায় ঝুলিয়ে অফিসে এসেছে দোয়া নিতে।  কিন্তু স্বভাব তার মোটেও বদলায়নি। এদের হাতে এই ইন্ডাষ্ট্রি তো দুরের কথা দেশ জাতি ও সমাজ কেউ নিরাপদ নয়।  আমাদের পেশায় এমন অনেক দুর্বলতা আছে স্বীকার করছি। কিন্তু তাই বলে গোটা সাংবাদিক সমাজকে তাচ্ছিল্য করার মত মস্ত বড় শিক্ষিত কিন্ত চিকিৎসকরা নন।  চিকিৎসা পেশায় তো অভিজ্ঞতার দরকার হয়।  তারা তো সর্বনিম্ন এমবিবিএস পাস। তাদের অভিযোগ পেশ করার জন্য দেশে আইন আছে, আদালত আছে।  কিন্তু জরিপে দেখা গেলো এ যাবত যতগুলো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে, সেখানে হাসপাতালের ভেতরে সাংবাদিকরা চিকিৎসকদের হাতে আক্রান্ত হয়েছে। একজন এমবিবিএস পর্যায়ের শিক্ষিত ব্যক্তি কীভাবে শারীরিকভাবে আক্রমণ করে। নৈতিকতার সর্বনিম্ন পর্যায়ে না যাওয়া পর্যন্ত তা সম্ভব না।  চিকিৎসা পেশায় স্পষ্টত বলা হয়েছে চিকিৎসা সংক্রান্ত যে কোনো বিষয় রোগী, সমাজ, রাষ্ট্র, আদালত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সাংবাদিকদের তা জানাতে হবে। হতে পারে তা রাষ্ট্রীয় বিষয়, ব্যক্তিগত বিষয়। তবে সাংবাদিকদেরও আরও সচেতন হতে হবে।  অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় সাংবাদিকরা কোনো কিছু না বলে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছবি তুলে ফেলেন। এগুলো অনেক ক্ষেত্রে উস্কানিমূলক হয়ে যায়। এ বিষয়গুলো নিয়েও সাংবাদিকদের আরও নিয়মতান্ত্রিক ও সতর্ক হতে হবে। চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুল হলে অবশ্যই তার বিচার হতে হবে।  চিকিৎসা বন্ধের আলটিমেটামের ছুতো থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে, কোনো অবস্থাতে কোনো সংঘর্ষ মেনে নেওয়া যাবে না।  সে যে পর্যায়ের ডাক্তার হোক আর নেতা হোক।

লেখক: বিভাগীয় সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ জুলাই ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়