ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

কলিন্দা কিতারোবিচ: চাঁদেরও কলঙ্ক আছে

কমলেশ রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২৭, ২৩ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কলিন্দা কিতারোবিচ: চাঁদেরও কলঙ্ক আছে

|| কমলেশ রায় ||

‘রূপ দেখে বলব কী / ভাষা খুঁজে পাই না।’ - বিশ্বকাপ শেষ হলেও রেশ কাটেনি। এমন আবহে গানের এই লাইন দুটো কাকে মনে করিয়ে দেয়? কার চেহারা ভেসে ওঠে চোখের সামনে? এখনও ধরতে পারেননি? তাহলে আরেকটু খোলাসা করা যাক। এই যে হঠাৎ বিশ্বজুড়ে ক্রোয়েশিয়ার সমর্থক বন্যার পানির মতো ফুলে ফেঁপে উঠল, সেটা কার জন্য? এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন। বুঝবেনই তো। চাঁদপনা এমন মুখ পৃথিবীর কজন প্রেসিডেন্টের আছে? নেই, হয়ত একেবারেই নেই। আর এই কারণেই ক্রোয়েশিয়ার কোলিন্দা গ্রাবার কিতারোবিচ এখন বিশ্বের সবচেয়ে ‘আবেদনময়ী’ প্রেসিডেন্ট।

যার যত আবেদন, গণমাধ্যমের আলো তার উপর তত বেশি। তবে বেশি আর্কষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার কুফলও আছে। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে অনেক সময় সাপ বেরিয়ে যায়। সুন্দর চেহারার আড়ালে থাকা অনেক অপ্রিয় সত্য সামনে চলে আসে। তখন ধরা পড়ে যায় ‘চাঁদের কলঙ্ক’। কোলিন্দার ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটেছে।

প্রতি বছরই কোনো না কোনো কারণে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন কোলিন্দা। গত বছর মার্কিন প্রেসিডেন্টের পোল্যান্ড সফরের সময় তিনি ও ট্রাম্প একসঙ্গে ফ্রেমবন্দি হন একাধিকবার। সেখানে তার চাহনি নিয়ে খুব চর্চা হয়। বছর দুয়েক আগে বিকিনি পরা একটি ছবি ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়। ছবিটি কোলিন্দার বলেই ধরে নিয়েছিলেন অনেকে। পরে দেখা যায় ছবিটি আসলে তার নয়। কোকো অস্টিন নামে এক মার্কিন মডেলের ছবি সেটা! আর এবছর তো বিশ্বকাপের ‘সেরা ফ্যান’ হিসেবে বিশ্বব্যাপী সাড়া ফেলেছেন ক্রোয়েশিয়ার এই ‘বারো নাম্বার খেলোয়াড়’। ব্যাস, এটুকুই ? না, ব্যাপারটা এখানেই শেষ নয়। অপ্রিয় প্রশ্ন হলো, আমরা কতটা জানি তার অতীত?

রূঢ় হলেও সত্য, কোলিন্দা কিতারোবিচের রয়েছে রক্তাক্ত অতীত। তার দলের নাম ক্রোয়েশিয়া ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন, সংক্ষেপে এইচডিজেড। এই দলটি আসলে ক্রোয়েশিয়ার  ফ্যাসিবাদী ‘উসতাসা’ আন্দোলনের ফসল। আরও স্পষ্ট করে বললে উত্তরাধিকারী। ক্রোয়েট ‘বিশুদ্ধতা’ রক্ষা করতে গণহত্যাকে সমর্থন করত এই ফ্যাসিবাদীরা। যুগোস্লাভিয়ার সার্ব, মুসলমান, ইহুদি ও রোমা জিপসিরা হয়েছিল সেই গণহত্যার শিকার। ১৯২৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত হাজার হাজার ভিন্নমতাবলম্বীর প্রাণ যায় এদের হাতে। হিটলার ও নাজিদের সহযোগী ছিল এরা (১৯৪১-৪৫)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে এরা ছিল জার্মানি ও ইতালির যুদ্ধজোটে। ক্রোয়েট ফুটবলপ্রেমীরা আজও স্লোগান দিতে গিয়ে বলে : ‘ফর দ্য হোমল্যান্ড- রেডি!’  জানেন কী, উসতাসা আন্দোলনের শপথ ছিল এটাই!

আর এইচডিজেড কে গড়েছিলেন জানেন? কমিউনিস্ট যুগোস্লাভিয়া ভাঙার অন্যতম হোতা ফ্রানজো ট্রডাম্যান গড়েছিলেন দলটি। তিনি এই কারণেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিলেন।

এবার কোলিন্দার রাজনীতিক হয়ে ওঠার জমজমাট গল্প শোনা যাক। পেশা জীবনে তিনি ছিলেন কূটনীতিবিদ। যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনকালে স্বামীকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। এই অনিয়ম করার পর ধরা পড়েন তিনি। পরে পদ ছেড়ে ন্যাটো দফতরে যোগ দেন। তার কাজ ছিল আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীর ইমেজ বৃদ্ধি আর সেনাদের মনোবল বাড়ানো। উল্লেখ্য, আফগানিস্তানে ছিল ক্রোয়েট সেনারাও। এই সময়েই কোলিন্দা যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ব্যবসায়ী ডেভিড রকিফেলোর প্রতিষ্ঠা করা ট্রাইলেটারাল কমিশনের সদস্য মনোনীত হন। ন্যাটো আর ট্রাইলেটারাল কমিশনে কাজে গিয়ে তিনি মার্কিন প্রশাসনের খুবই কাছে চলে যেতে পেরেছিলেন। এর ফলশ্রুতিতেই তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ সুগম হয়।

ফুটবলপ্রেমী হয়ে ওঠার পেছনেও কাহিনি আছে। বিগত নির্বাচনে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট পার্টির চেয়ে মাত্র ১ শতাংশ ভোট বেশি পেয়ে জয়লাভ করেছিলেন কোলিন্দা। ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে আগামী নির্বাচনে ব্যবধান বাড়াতে হবে। আর এই কাজে তিনি ক্রোয়েশিয়ার ফুটবল দলের অর্জন ও সুনামকে ব্যবহার করতে চাইছেন। রাজনৈতিক ক্যারিয়ার দীর্ঘ করতে বিশ্বকাপ চলাকালে তাই তাকে ছুটতে হয়েছে গ্যালারিতে। গ্যালারি থেকে ড্রেসিং রুমে। মেতে উঠতে হয়েছে ফুটবল উত্তেজনায়।

ক্রোয়েশিয়া ফুটবল দলের বিরুদ্ধেও উগ্র জাতীয়তাবাদিতার অভিযোগ নতুন নয়। ২০০৬ সালে তো ইউরোপীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন ক্রোয়েশিয়াকে বহিষ্কার করতে চেয়েছিল। অভিযোগ উগ্র জাতীয়তাবাদিতা এবং ক্রোয়েট দর্শকদের বর্ণবাদী আচরণ। এর আগে ২০০৪ সালে একই অভিযোগে ক্রোয়েশিয়ার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনকে জরিমানা করা হয়। ফুটবলার ও দর্শকদের এই মনোভাবকেও পুঁজি করতে চাইছেন কোলিন্দা। তিনি নিজেই এখন উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রতীক। পুতিনের পাশাপাশি যিনি ট্রাম্পের সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চান।  শুধু তাই নয়, নিজেকে তিনি পপশিল্পী মার্কো পারকোভিচের ভক্ত বলে পরিচয় দেন। ক্রোয়েশিয়ার এই শিল্পীর বিরুদ্ধে তরুণদের উগ্র জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করার অভিযোগ রয়েছে। সুইজারল্যান্ডে তো তার গান নিষিদ্ধই করা হয়েছে।

সত্যি, অস্বীকার করার জো নেই, বর্ণময় এক চরিত্র এই লাস্যময়ী প্রেসিডেন্ট। বিশ্বকাপ ফাইনাল দিনটির কথা মনে করুন। হঠাৎ আসা বেরসিক বৃষ্টিকেও যেন একহাত নিলেন কোলিন্দা। বাদলধারাকে ভালোবাসায় বরণ করলেন। পরাজয়ের ব্যথা বুকে লুকিয়ে ভিজলেন হাসিমুখে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই সবাইকে আলিঙ্গন করলেন। যাতে পক্ষ, বিপক্ষ কিংবা নিরপেক্ষ কোনো ভেদই ছিল না। তার উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়েছেন সবাই। বিশেষ করে গোল্ডেন বল বিজয়ী ক্রোয়েশিয়ার অধিনায়ক লুকা মদরিচকে যেভাবে তিনি অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখলেন তা অনেকদিন দাগ কেটে থাকবে ফুটবলমোদীদের মনে। ভালোবাসা ছড়িয়ে দিয়ে বিশ্বকাপের শেষ মঞ্চের সর্বশেষ দৃশ্যেও তিনি মন জয় করে নিলেন তামাম দর্শকের। কী নিখুঁত আচরণ! আপাত দৃষ্টিতে আবেগী, অগোছালো, কিন্তু আসলে চূড়ান্ত গোছানো। হেরে গিয়েও কী করে জিততে হয় এটা তার চেয়ে আর কে ভালো জানে?ৎ

সংক্ষেপে কোলিন্দা গ্রাবারের কিছু ব্যক্তিগত তথ্য জানা যাক। তিনি জন্মেছেন ১৯৬৮ সালের ২৯ এপ্রিল, ক্রোয়েশিয়ার রিজিকা এলাকায়। তখন ক্রোয়েশিয়া ছিল যুগোস্লাভিয়ার অধীনে। তিনি জ্যাকব কিতারোভিচকে বিয়ে করেন ১৯৯৬ সালে। দুই সন্তানের জননী ৫০ বছর বয়সী এই সুদর্শনা। বড় মেয়ে ক্যাটরিনার বয়স সতের। আর ছেলে লোকার জন্ম  ২০০৩ সালে। ২০১৫ সালে ক্রোয়েশিয়ার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট (তালিকায় চতুর্থ) নির্বাচিত হন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। ক্রোয়েশিয়ান ছাড়াও ইংরেজি, স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ ভাষায় তিনি কথা বলতে পারেন। এছাড়া জার্মান, ফ্রেঞ্চ ও ইতালিয়ান ভাষা বুঝতে পারেন।

কোলিন্দা সমকামীদের বিয়ের পক্ষে ক্রোয়েশিয়ায় আইন জারি করেছেন। গণমাধ্যমে তিনি প্রকাশ্যে এ বিষয়ে বলেন, ‘আমার ছেলেও যদি সমকামী হয় তবে আমি তাকে সাধুবাদ জানাব।’

সাধারণের মতো থেকেও কী করে অসাধারণ হয়ে ওঠা যায় সেই গোপন সূত্রটা কোলিন্দা ভালো মতোই জানেন। শাণিত মস্তিষ্কে হিসাব কষে চলেন তিনি। বিশ্বকাপ চলাকালে ক্রোয়েশিয়া থেকে আর পাঁচজন সাধারণ নাগরিকের মতোই তিনি ইকোনমি ক্লাসের টিকিট কেটেছেন। সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গেই উড়ে এসেছেন রাশিয়ায়। আর পাঁচজন ফুটবল সমর্থকের মতোই লাইনে দাঁড়িয়ে সংগ্রহ করেছেন বিশ্বকাপের ফ্যান আইডি। তারপর সটান স্টেডিয়ামে। প্রিয় দলের জয়ে তার উচ্ছ্বাসও ছিল আর পাঁচজন সাধারণ সমর্থকের মতোই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেইসব ছবি শেয়ার করেছেন তিনি নিজেই। মনে রাখতে হবে, তিনি একাধারে ক্রোয়েশিয়ার প্রশাসনিক প্রধান, সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক, আবার ফুটবলপ্রেমীও। অথচ আর পাঁচজন রাষ্ট্রপ্রধানের মতো ভিভিআইপি বক্সে বসে খেলা দেখতে পছন্দ করেন না। এ বিষয়ে তার বক্তব্য, ‘আসলে ভিভিআইপি বক্সে বসে খেলা দেখলে প্রথাগত পোশাক পরতে হয়। দলের হয়ে গলা ফাটাতেও সমস্যা হয়, তাই স্টেডিয়ামে বসেই খেলাটা উপভোগ করতে চাই আমি।’ এটা কী শুধুই ফুটবলীয় আবেগ? না, নেপথ্যে রয়েছে অনেক হিসাব-নিকাশ (আগেই উল্লেখ করা হয়েছে)। গণমাধ্যমের সিংহভাগ প্রচারের আলোটুকু কেড়ে নিয়ে পরিবেশ-পরিস্থিতির এমন কৌশলী ব্যবহার সাধারণ কারও পক্ষে সম্ভব?

রাশিয়ায় গিয়ে কোলিন্দা কূটনীতি করেছেন যথেষ্ট সূক্ষ্মভাবে, ফুটবলকেন্দ্রিক  উত্তেজনার সুনিপূণ মিশেলে। বাঘা বাঘা রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদেরকে ক্রোয়েশিয়ার জার্সি ধরিয়ে দিয়েছেন তিনি। এই তালিকায় আছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মেকেও উপহার দিয়েছেন ক্রোয়েশিয়ার জার্সি। বিশ্বকাপের মাঝে অনুষ্ঠিত ন্যাটোর সম্মেলনে গিয়ে জার্সি উপহার দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে।

বিশ্বকাপ মঞ্চে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোর সঙ্গে কোলিন্দার অতি আন্তরিক আচরণ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশংসার পাশাপাশি নানা বাঁকা কথাও শোভা পাচ্ছে। এই দুই প্রেসিডেন্টের বিশেষ একটি ছবি দিয়ে লুগিও রিবা নামের এক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট লিখেছেন, ‘আন্টি শান্ত হোন, এখানে কিন্তু পাঁচ সহস্রাধিক ক্যামেরা আছে।’ অনেকে এককাঠি বাড়িয়ে লেখেন, ‘কিউট কাপল ’। ডেইলি মেইল পত্রিকা লিখেছে, ‘দুই প্রেসিডেন্টের এমন মাখো-মাখো রসায়নে ম্যাক্রোর ৬৫ বছর বয়সী স্ত্রী ব্রিজিত মনোক্ষুণ্ন হয়েছেন। যদিও তিনি তার ক্ষোভের বিষয়টি কারও কাছে প্রকাশ করেননি।’ শ্রদ্ধেয় এক গুণীজন আলাপ প্রসঙ্গে একদিন বলেছিলেন, ‘শোনো বাছা, একটা কথা সারাজীবন মনে রেখো। কোনো রূপবতী যদি একইসঙ্গে গুণবতী হয়, তাহলে সেই নারী হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। চাইলেই সে বিশ্বজয় করতে পারে। শ্রদ্ধা করার পাশাপাশি এদের সম্পর্কে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।’

ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট কোলিন্দার বেলায় কথাটা কতটা খাটে কে জানে? বিষয়টা বিশ্ববাসীর কাছে হয়ত যথাসময়ে স্পষ্ট হবে। আপাতত অনেকেই কোলিন্দা নামের এক ক্রোয়েট সৌরভে বুঁদ হয়ে আছেন। 

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যসেবক




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ জুলাই ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়