ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

এই দেশ কি রমা চৌধুরীকে মনে রাখতে পারবে?

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:২১, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এই দেশ কি রমা চৌধুরীকে মনে রাখতে পারবে?

রমা চৌধুরী

 

|| অজয় দাশগুপ্ত ||

মুক্তিযুদ্ধ এখন একটা বিপণনের বিষয়। বিশ্বাস না হলে দেশের দিকে তাকান। নিজেই উত্তর খুঁজে পাবেন। এই যে রমা চৌধুরীর বিদায় দেখুন কি কাণ্ড! তার মৃত্যুর পর মিডিয়ায় চোখ বুলালে মনে হবে, জীবদ্দশায় তিনি কতই না আনন্দ আর ভালোবাসায় ছিলেন। আসলে কি তাই? আমি নিজে দেখেছি তার কষ্ট ও বেদনা কত প্রচণ্ড ছিলো। এরা আমাদের দেশের সেই মানুষ যাদের ত্যাগ ছাড়া এ দেশের জন্মই হতো না। কিন্তু সব ফাঁকা বুলি। সব লোক দেখানো। তার কষ্টের জীবন আর দুঃখ নিয়ে কথা বাড়াতে চাই না। একদিন যারা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছিল তারাই আজ মায়াকান্না কাঁদছে। এটাই অপমানের। আমাদের দেশ ও সমাজ কতটা নষ্ট হয়েছে তার একটা বড় চিত্র আছে এতে।

রমা চৌধুরীর জীবিত ছেলেটি এখন মিডিয়ায় এসে কান্নাকাটি করছে। কারণ তার জানা আছে, এখন স্পর্শকাতর সময়ে ভালো করে অভিনয় করতে পারলে কিছু নগদ জুটবে। এটাই আমাদের দেশের বাস্তবতা। এখন আওয়ামী লীগ, বিএনপি এমনকি রমাদির বইয়ের টাকা শোধ না করা একজন আলোচিত রাজনীতিকসহ অনেকেই ঝাঁপিয়ে পড়ে দেখাবেন কে কতটা করতে পারেন। এই ছেলে সে সুযোগ নেয়ার জন্য তৈরি। অথচ জীবদ্দশায় মায়ের খোঁজ সে নেয়নি। অথচ যে নিয়েছিল, সে জন্মসূত্রে মুসলিম। আলাউদ্দিন খোকন নামের এই লোকটি সারাজীবন রমাদিকে সহায়তা করে গেছেন। গাঁটের টাকা বা টাকা যোগাড় করে তার বই বের করে দিয়েছেন। মা ডাকা আর মা মানা দুটি ভিন্ন বিষয়। এই মানুষটি মেনেছিলেন। তাই কখনো রমাদির অমর্যাদা হতে দেননি। আজ তিনি পাদপ্রদীপের আলোয় নেই। বরং বলে দিয়েছেন কিছু দিলে ছেলেকে দেয়া হোক। কে বলে আমাদের সমাজে সব মন্দ? সব ভেসে গেছে খারাপের বন্যায়? এই মানুষটি প্রমাণ করে দিয়েছেন ধর্ম-বর্ণ বা জাত এগুলো বিষয় না। বিষয় না সাম্প্রদায়িকতা। দেশে যখন ধর্ম আর আচার মিলে সর্বগ্রাসী মানুষ; একে অপরকে সেভাবে দেখার কারণে বন্ধুত্ব আত্মীয়তা এমনকি সম্পর্ক প্রায় নষ্টের পথে তখন আলাউদ্দীনের মতো কিছু মানুষই আলোকবর্তিকা।

কই আমরা কেউ তো পারিনি। কেউ তো এগিয়ে এসে দিদির জীবনে দাঁড়ায়নি। কারণ সবার একটা হিসেব নিকেশ আছে। কতটা করলে কতটা লাভ বা লোকসান। সে হিসেবের বাইরে সবাই পা রাখতে পারে না। ফলে মুক্তিযুদ্ধ বা যুদ্ধ বিষয়ক গল্প যতটা কাজে ততটাই পিছিয়ে আমরা। একটা দেশে মুক্তিযুদ্ধ বা তার ইতিহাস কখন বেগবান হয়? কখন সত্যিকারের পথ খুঁজে পায়? বঙ্গভবনের দরবার হল ও কার্নিভাল হলের মাঝখানের কড়িডোরে যদি চোখ রাখেন দেখবেন সেখানে বাঙালি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিকপাল হিসেবে সব মিলিয়ে প্রায় ২৫ জন বিখ্যাত মনীষীর ছবির পোর্ট্রেট টাঙানো। কিন্তু এ ছবিগুলোয় অনুপস্থিত বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। প্রদর্শিত ছবিগুলো দেখে মনে হয়েছে শুধুমাত্র ১৯৪৭ সালের আগে ও পরের মনীষীদেরই বাঙালির ইতিহাসের অন্যতম ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এমনকী এ সময়ের বিখ্যাত কাউকেই রাখা হয়নি এখানে। যেমন ছবির সারিতে নেই, অতীশ দীপঙ্কর, নেই বিশ্ববিখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন বোস বা জগদীশচন্দ্র বসুর পোর্ট্রেট। কবিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, কায়কোবাদ ও জসীম উদ্‌দীনের পোর্ট্রেট থাকলেও নেই বাংলা ভাষার অন্যতম কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বা জীবনানন্দ দাশের পোর্ট্রেট। নারীদের মধ্যে বেগম রোকেয়ায় পোর্ট্রেট স্থান পেলেও নেই প্রীতিলতার পোর্ট্রেট। তিতুমীরের পোর্ট্রেট থাকলেও নেই মাস্টারদা সূর্য সেনের পোর্ট্রট।

এটুকু পড়ে আপনার কি মনে হয় যে, আসলেই আমরা একটি অসাম্প্রদায়িক জাতি? বা যারা এখন মসনদে তারা আসলেই অসাম্প্রদায়িক? যদি তারা তা হতেন এ খবর কি তাদের অজানা? জানার পরও তারা কোনো অ্যাকশানে যায়নি। কারণ তারা ভালো জানে, এ দেশের আমজনতাকে খুশী রাখতে হলে মুখে যা বলেন কাজে তা করা যায় না। বা করবেন না।  এরপর আপনি কীভাবে নিশ্চিত যে রমা চৌধুরী এদেশের ইতিহাসে জায়গা পাবেন? আমি খেয়াল করে দেখেছি ইতিহাস গান কবিতায় ঈশা খান বা তিতুমীরকে নিয়ে কথা থাকলেও বাস্তবে সূর্য সেন বা প্রীতিলতা নাই। কেন নাই? অথচ বাকী দুজন নন এরাই আমাদের ভূমির সন্তান। কিন্তু জন্ম বা জন্মভূমির চাইতে সম্প্রদায়গত পরিচয় বড় হয়ে উঠলে তখন তো তারা থাকবেন না এটাই স্বাভাবিক। একই কারণে বরিশালের জীবনানন্দ কিংবা বাংলার অতীশ দীপংকর বা সত্যেন বোস নাই। কারণ মন থেকে হয়তো আমরা তাদের নিজেদের মানুষ মনে করি না। বলবেন তো যে রবীন্দ্রনাথ আছেন কি করে? মূলত তিনি এবং নজরুল দুজনই ওপার বাংলার সন্তান। কেউ আমাদের ভূমিতে জন্মাননি। তাতে তাদের গৌরব বা সম্মান কোনটার কোনো লাভ লোকসান কিছু নাই। কিন্তু তাদের ছাড়া আমাদের চলে না। আর তারা এত ব্যাপক আর এত আলোময় না থাকলে আমরাই অন্ধকারের জীবে পরিণত হয়ে পড়ি। তাই হয়তো তাদের এড়িয়ে যাওয়ার উপায় থাকে না।

এভাবে আর যাই হোক ইতিহাস বা শুদ্ধতা রাখা যায় না। তাই তা নেইও। আজ বীরাঙ্গণা রমা চৌধুরীকে নিয়ে যারা ফেনা তুলছেন তারা বাসায় ফিরে হয়তো ঠিক উল্টো কিছু বলছেন। কেউ বলবেন ঠিক হয়েছিল। পাকি সৈন্যরা গনিয়তের মাল ভোগ করে অন্যায় কিছু করেনি। আর একদল বলবেন, তাদের ভাবলেই গা ঘিনঘিন করে, তবু যেতে হয় বলে যাওয়া। এই হিপোক্রেসী আমাদের জাতিকে দিনদিন ক্লীব আর দুর্বল করে তুলেছে। এভাবে তাই কাউকে না যায় সম্মান জানানো না করা যায় অসম্মান।

এদেশের ইতিহাসে একাত্তর যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, ঠিক ততটাই তাকে টেনে নামাচ্ছি আমরা। দেখুন চোখ খুলে প্রধানমন্ত্রী তাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন বলে তিনি লাইম লাইটে কিছুটা এসেছিলেন। তারপর? যে কপাল সেই মাথা। দু লাখ টাকা দেবার পর আর কেউ কোনো খোঁজ নিয়েছিল? দেশে এত মুক্তিযুদ্ধপ্রেমিক, সরকারী দলে এত মহান সব একাত্তরবিদ, চাটগাঁয় এত সুশীল, এত এত বুদ্ধিজীবী কেউ তার খবর রাখেনি। যখন তিনি নাই তখন লাল সবুজে ঢেকে শোক প্রকাশ। জানি লাল সবুজ তাকে ভালোবাসে। কেউ পরিয়ে না দিলেও এই জাতীয় পতাকা নিজ থেকেই তাকে জড়িয়ে নিতো। প্রকৃতি বা সময় আমাদের মতো বেঈমান না। তাদের কাছেই এদের আসল আশ্রয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চেতনা ও ইতিহাস ধীরে ধীরে একা হয়ে পড়ছে। এরা একেকজন চলে গেলে আমাদের সেসব মানুষদের আর কেউই থাকবে না যারা এদেশের জন্ম আর ইতিহাস দেখেছিলেন। যারা নিজেরা ইতিহাস হয়েছিলেন সম্ভ্রম বা জীবন হারিয়ে। যারা সম্ভ্রম হারিয়ে আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেলেন তাদের আমরা ঠিকভাবে দেখে রাখি না। রমা চৌধুরী তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত প্রেমিকেরা কি ইতিহাসকে আগলে রাখতে আবারো ঐক্যবদ্ধ হতে পারবেন এদেশে?




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়