ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

মালয়েশিয়ায় দুষ্কর্মে বাঙালির বদনাম

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মালয়েশিয়ায় দুষ্কর্মে বাঙালির বদনাম

(ভিয়েতনামের পথে: ৩৯তম পর্ব)

ফেরদৌস জামান: তাড়াহুড়ো নেই, হাতে পর্যাপ্ত সময় আছে। তাছাড়া এই বিলাসবহুল এলাকা বা দালানকোঠা দেখে বেড়ানোর ইচ্ছাটাও অতো প্রবল নয়। ভাবলাম বাংলাদেশি পরিচ্ছন্ন কর্মীর সঙ্গে কিছুক্ষণ সুখ-দুঃখের আলাপ পারি। কিন্তু তার মধ্যে তেমন আগ্রহ দেখা গেল না। এখানে কাজ করতে এসে তারা দেশি মানুষের দেখা এতটাই পেয়ে থাকেন যে, নতুন কাউকে দেখলে কোনো উচ্ছ্বাস কাজ করে না। তবে তার কাছ থেকে একটি তথ্য পেলাম, পর্যটকদের জন্য টাওয়ারের উপর আরোহণের ব্যবস্থা আছে। সেক্ষেত্রে, জনপ্রতি একটি খরচা পরিশোধ করতে হয়। এক সাথে নির্দিষ্টসংখ্যক দর্শনার্থী জড়ো হলে দিক নির্দেশকের সাথে উপরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। উপরের সংযোগ সেতু দিয়ে এক ভবন থেকে অন্য ভবনে পরিভ্রমণের সুযোগ মেলে। নিঃসন্দেহে চমৎকার ব্যবস্থা, তবে তা আমাদের ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় হয়ে উঠল না। তবুও খোঁজখবর নিতে তো সমস্যা নেই। দুপুরের খাবারের বিরতির কারণে উক্ত ভ্রমণের ব্যবস্থা আপাতত বন্ধ। টাওয়ারের নিচে ছড়ানো কয়েক তলা ভবনজুড়ে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক নামকরা দোকানের শাখা নিয়ে বিপণি বিতান। ঘুরতে ঘুরতে এক কফি দোকানের ভিন্ন রকম পরিবেশনার বিষয়টি বেশ আকর্ষণীয় মনে হলো। ক্রেতার সামনেই যন্ত্রের মধ্যে কফি গোটা গুঁড়ো করে পরিবেশিত হচ্ছে। পাশেই বসার বন্দোবস্ত। প্রতি পেয়ালার মূল্য সাত রিঙ্গিত। বিক্রয়কর্মী জানালেন চাইলে কফি গোটা হাতে নিয়ে দেখতে কোনো সমস্যা নেই। অধিকন্তু, গুঁড়ো করার কাজেও হাত লাগানো যেতে পারে। এ ধরনের সুযোগ সবাইকে দেয়া হয় কি না জানি না। আমাদের আগ্রহের বিষয়টি আন্দাজ করে গুঁড়ো করার কাজে শরিক হতে তিনি একরূপ আমন্ত্রণই জানালেন। দারুণ ব্যাপার! আমন্ত্রণ না জানালেও ঠিকই ব্যবস্থা করে নিতাম। কোথায় যেন পড়েছিলাম, পর্যটনকে অধিক অর্থবহ ও সফল করার খাতিরে কফি বাগান ঘুরে দেখার পর চোখের সামনে প্রস্তুত করা কফি পরিবেশন করা হয়। এটা সম্ভবত ভারতের কোনো রাজ্য বা মালয়েশিয়াতেই হয়ে থাকবে। এত বড় অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ না পেলেও আপাতত যা পেয়েছি তা হাত ছাড়া করার পাত্র আমি নই। গাঢ় খয়েরি রঙের কফি গোটা, যন্ত্রের মধ্যে ছেড়ে দিতেই নিমিশে গুঁড়ো হয়ে গেল। তারপর অন্য আরেক যন্ত্রে ঢেলে দিলে কিছুক্ষণ পর পেয়ালায় নেমে এলো দুই পেয়ালা তরল কফি। আমাদের চেয়ারে গিয়ে বসতে বলা হলো। একটি পরিবেশন পাত্রে পাশাপাশি কফি পেয়ালা এবং বাদামী রঙের চিনি এনে অতি যত্নে সামনে রাখলেন। টাটকা কফির সুবাসে মন চনমনে হয়ে উঠল। মুখে এক চুমুক দিতেই মাথা যেন চক্কর দিয়ে উঠল! একি! শখ করে কি খেতে এলাম। এতটাই তিতা যে, ইচ্ছামতো চিনি যোগ না করলে নিশ্চিত ভেগে আসতে হতো। নিজ হাতে প্রস্তুত করা কফি, চুমুকে চুমুকে প্রশান্তির ধারার মতো পেটে চালান হয়ে গেল।
 


টাওয়ারের অপর পাশে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর এখান থেকে বিদায়। বেশ রোদ উঠেছে। দু’এক জনের কাছ থেকে জেনে নিতে নিতে এগিয়ে যাচ্ছি বাস স্ট্যান্ডের দিকে। সেখান থেকে চায়না বাজার যাওয়ার বাস মিলবে। কুয়ালালামপুরের ছোট ছোট রাস্তা প্রদক্ষিণ শেষে পেয়ে গেলাম বাস স্ট্যান্ড। এরই মধ্যে বৃষ্টি শুরু হলো। সমস্ত লোক এসে জড়ো হলো স্ট্যান্ডের ছোট্ট ছাউনির নিচে। এদের মাঝ থেকে কিছু লোকের আচরণে মনে হলো তারা আরাম করে দাঁড়াতে পারছে না। খেয়াল করে দেখলাম এজন্য আমরা দায়ি নই তো? হ্যাঁ, ঠিকই। আমরাই তাদের আরামহীনতার কারণ। আমাদের শরীর থেকে নিশ্চই এমন কোনো বদ গন্ধ বেরুচ্ছে না যে, এতো ছোট জায়গার মধ্যেও কিঞ্চিৎ সরে দাঁড়ানোর চেষ্টা তারা করবে! গতরাতে আঁতরের দোকানে বসে এসব নিয়েই কথা হচ্ছিল। একটা সময় ছিল স্থানীয়দের কাছে বাঙালি বলতে সম্মান ভালোবাসার পাত্র, যার ফলোশ্রুতিতে বহু মালয় নারী বাঙালি পুরুষের জীবন সঙ্গী পর্যন্ত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু নারী প্রতারণার শিকার হয়। অল্পদিন আগেও নাকি শোনা গেছে সন্তানসম্ভবা অনেক নারীকে রেখে দেশে পালানোর ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। এছাড়াও অন্যান্য দুষ্কর্মে বাঙালির সম্পৃক্ততার ফিরিস্তি আরও দীর্ঘ। আঁতরের দোকানের আলোচনা যদি সিকি ভাগও সঠিক হয়ে থাকে তাহলে বাঙালি হিসেবে এটা বোধ হয় আমার প্রাপ্য। গোলাপি রঙের বাস এলো, সকলের সাথে আমরাও উঠে পরলাম। আমার আর কিছু ভালো লাগছে না। মানুষের স্বাভাবিক আচরণকেও অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। বসার জায়গা পেয়েছি জানালার পাশে। পথের বিচিত্র রূপ দেখে দেখে চলা আমার অভ্যাস। এই মুহূর্তে সবকিছু অর্থহীন মনে হচ্ছে। বাস থেকে নেমে সামান্য দূরেই চায়না বাজারের মুখ। প্রতিটি দোকানে চাইনিজ পণ্যের স্তূপ। ঠিক যেন মালয়েশিয়ার বুকে এক টুকরো চীন। গলির দু’পাশে দোকান। মাথার উপর ফানুস আকৃতির লাল কাপড় ঘেরা বাতি দিয়ে সাজানো। রাতের বেলায় এই বাজারের যে আলাদা এক রূপ ফুটে ওঠে তা সহজেই আন্দাজ করা যায়। কিন্তু সেই রূপ আর জনসমাগম দেখার সুযোগ এবং ইচ্ছা কোনটাই আমাদের নেই। ইন্দোনেশিয়ার ফ্লাইট সন্ধ্যা ছয়টা পাঁচ মিনিটে। আপাতত বিমান বন্দরে যেতে পারলেই মুক্তি। তারপরও বাজারে যেহেতু ঢুকেছি চাইলেই তো কয়েক সেন্ডের মধ্যে বেরিয়ে পরা যায় না। গলির এক মাথা থেকে অপর মাথায় পৌঁছতে এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেল।
 


এতক্ষণ ভেবেছিলাম পাসার সেনি বাস টার্মিনালের আশপাশেই আছি। কিন্তু না, উড়াল রেলে যেতে হবে বাস টার্মিনাল। এখন একটু তাড়া অনুভব করছি। পাসার সেনি গিয়ে সেখান থেকে বাসে বিমান বন্দর যেতে হবে। টার্মিনালে গিয়ে টিকিট সংগ্রহ করে এমন কাউকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি যিনি সহজেই বিস্তারিত বলে দিতে পারবেন। সামনেই একটি বাসের বাক্সে ব্যাগ-বোচকা ঢোকানো হচ্ছে। পাশে দাঁড়ানো লোকটিকে দেখে অনুমান করা যায় তিনি দক্ষিণ ইন্ডিয়ান। সুজিত গিয়ে মাত্র জানতে চেয়েছে, ভাই বিমান বন্দরের বাস কোনটি? প্রতি উত্তরে তিনি যেভাবে এবং যা বললেন তা লিখতে আমার লজ্জা হচ্ছে। এমন ব্যবহারের হেতু কী হতে পারে তার হদিস করতে পারলাম না। আমরা তো তাকে ভরসার পাত্র ভেবে নিয়েছিলাম। তাছাড়া তিনি আমার জন্মভূমির সহোদর ভাই ইন্ডিয়ার সন্তান, দুজনের শরীর যে মাটিতে গড়া তার মধ্যে খুব একটা ফারাক নেই, যে বাতাসে তার প্রাণ জুড়ায় সেই একই বাতাসে আমারও বেঁচে থাকা। এইতো মাত্র কয়েক দশক আগে সে, আমি একই পরিচয়ে পরিচিত ছিলাম! যাক সে কথা, হয়তো কোনো দুশ্চিন্তায় ছিলেন তাই এমন করে ফেলেছেন। এদিকে বাক্সে ব্যাগ ঢোকানো শেষ। চালক ইঞ্জিনও চালু করেছেন। ভাবলাম ব্যাগ সাথে করে ভেতরেই নেই। দরজায় মাত্র পা দিয়েছি অমনি চালক যে ব্যবহার প্রদর্শন করলেন তা দিয়ে একজন মানুষকে শুধুই অপমান করা বুঝায়। তিনি যেন আমাকে তাড়িয়ে দিতে চাইছেন এবং তার সাথে আমার জন্ম জন্মান্তরের শত্রুতা। কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না! অবাক হয়ে গেলাম ভেতরে বসা লোকেদের চেহারায় কোনো প্রতিক্রিয়া নেই, স্বাভাবিকভাবে বসে আছে। চালকের আসনে বসা লোকটি অন্য কেউ নন, কিছুক্ষণ আগে সুজিতের সাথে বাজে আচরণ করা আমাদের বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী। সে যে তার সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে তা বুঝিয়ে দেয়ার পর বাক্সে ব্যাগ রাখার ব্যবস্থা হলো। এত কিছুর পরও তার নিকট এমন ব্যবহারের কারণ জানার বড় ইচ্ছা হলো। কিন্তু আমার রুচিবোধ তাতে সমর্থন দিল না।
 


মালয়েশিয়া ভ্রমণের শুরুটা যেমন অপ্রীতিকর হয়েছে শেষটা তার চেয়ে এতটুকুও প্রীতিকর হয়ে উঠল না। পাসার সেনি থেকে বিমান বন্দর, এই পথে কত কিছু যে ফেলে এলাম তার ঠিক নেই। জানালা দিয়ে দেখা দূর দিয়ে উড়ে যাওয়া একটি পাখির সৌন্দর্য কি আমার ভালো লাগা অনুভূতির ঝুলিতে যুক্ত হতে পারতো না? অপমানে নিজের চারপাশ দিয়ে যেন জলীয়বাষ্পের এক ঝাপসা কুণ্ডলী পাকিয়ে ছিল, যা আমার  কাছ থেকে সারাটা পথের সৌন্দর্য আড়াল করে দিয়েছে। বিমান বন্দর পৌঁছে কাউন্টারে ব্যাগ জমা দিয়ে ভারি খাবার পাওয়া যাবে এমন কোনো রেস্টুরেন্টের খোঁজ করলাম। দুই কি তিন তলায় সুন্দর একটা রেস্টুরেন্ট। খাবারের তালিকায় অনেক কিছুর মাঝে সাদা ভাত আর মুরগির মাংসের তরকারির ছবি। কোনো কথা নেই, এ বেলায় আমরা ভাত-মাংস খাচ্ছি। তারপর কফি। খানিক পর যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে অন্যান্য যাত্রীদের সাথে বসে আছি বোর্ডিং পাসের অপেক্ষায়। সামনে এবং বামে কাচের দেয়াল। ওপারেই দাঁড়িয়ে আছে দুটি উড়োজাহাজ। আরও দূরে কয়েক মিনিট পরপর বিমান নামছে আর উঠছে। ভেতর থেকে কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না, যেন বাহণগুলো বোবা হয়ে গেছে। তাতে কি আমাদের পেছনে কয়েক আসন ব্যাবধানে সুললিত কণ্ঠে উচ্চাঙ্গের যে সুললিত ধারা বয়ে যাচ্ছে তা কিন্তু ঠিকই কানে আসছে। খেয়াল করে দেখি মাতৃভূমির সহোদরের নানান বয়সী সাত-আটজন সন্তান মুখোমুখি বসেছেন। ঠিক ওই জায়গাটিই উক্ত সুর লহরীর উৎসস্থল। অন্য যাত্রীরা চুপচাপ বসে আছে। যারাও বা কথা বলছে- নিচু স্বরে। কিন্তু তাদের এসবে বিকার নেই, যেন বাসার টেলিভিশন ঘরে বসে এই মাত্র বিরোধী দলের ভাষণ শুনলেন। (চলবে)

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়