ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

জগন্নাথ হলের যে স্মৃতি হবো না বিস্মৃত

মাহমুদা খাতুন মালা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫৬, ১৫ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জগন্নাথ হলের যে স্মৃতি হবো না বিস্মৃত

মাহমুদা খাতুন মালা: স্মৃতি মানব মনের একটি অবিভাজিত অংশ। সুখ স্মৃতি মানুষকে আনন্দ দেয়। দুঃখ স্মৃতি কষ্ট দেয় বলে জ্ঞানত মানুষ তা মনে আনতে চায় না। কিন্তু যে স্মৃতি সকল দুঃখ-বেদনাকে অতিক্রম করে যায়, চাইলেই চাপা দেওয়া যায় না, তাকে কোন নামে অভিহিত করা যায়? সে স্মৃতির কোনো নাম থাক বা না থাক- ইতিহাসের কালো পাতায় লেখা হৃদয় বিদীর্ণ করা সেও এক স্মৃতি।

সেনিদও  প্রকৃতিতে শরৎ। তখনকার শরৎ মানেই ভালোমত শীতের আমেজ। সেই শীতের আমেজে সবাই মিলে কোনো অনুষ্ঠান উপভোগে যুক্ত হয় ভিন্ন মাত্রা। জগন্নাথ হলের লাউঞ্জে তখন আনন্দ আমেজ। ঘরোয়া সান্ধ্য বিনোদন বলতে তখন বিটিভিই ছিল একমাত্র মাধ্যম, যার শ্রেষ্ঠ বিনোদন উপকরণ নাটক। তখন সাপ্তাহিক নাটকের সাথে সবে উপযোগ ধারাবাহিক নাটক। তখন ‘ঢাকায় থাকি’ ধারাবাহিকের মুগ্ধতার আবেশ পেয়ে বসেছিল মানুষকে। সে আবেশে আবিষ্ট হয়ে ঘটা করে দ্বিতীয় ধারাবাহিক ‘শুক তারা’ দেখতে বসা। চলছিল ধারাবাহিকটির দ্বিতীয় পর্ব। রাত প্রায় ৯ টা বা তার কাছাকাছি। তখনই ঘটে যায় ইতিহাসের সেই হৃদয় বিদারক অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, শামসুননাহার হল, রোকেয়া হলের অবস্থান পাশাপাশি। প্রায় প্রতিবেশীর মতো।  রোকেয়া হলের লাউঞ্জে বসে নাটক শেষ করে আড়মোড়া ভেঙে সবে বাইরে বেরিয়েছি। ফায়ার বিগ্রেডের গাড়ির কর্কশ হর্ণ আর অ্যাম্বুলেন্সের সকরুণ আওয়াজ আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে শ্রবণেন্দ্রিয় যেন তছনছ করে দিচ্ছে। অজানা আতঙ্কে ঔৎসুক্য সবাই। দেশে তখন স্বৈরাচারী শাসন চলছে। কোথাও তো কোনো কিছুর ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে? যা ভাবা যায় না তাও হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে জানতে পারলাম, জগন্নাথ হলের ছাদ ধ্বসে অনেক ছাত্র মারা গেছে। আহত হয়েছে তারও কয়েকগুণ। বুক ভেঙে যাওয়া হৃদয় চূর্ণ করা সে খবর!

হলের নিরাপত্তা বাউন্ডারির মধ্যে থেকেও অনুভব করছি বাইরে ছেলেদের ছোটছুটি, আর্তনাদ আর রক্তের জন্য হাহাকার। তখন সন্ধ্যা ৬টার পরে মেয়েদের হলের বাইরে বেরুনোর নিয়ম ছিল না। ফটকে ছেলেদের রক্তের জন্য আকুতির কারণে রক্ত দিতে ইচ্ছুক মেয়েদের বাইরে বের হবার অনুমতি দিলেন প্রোভোষ্ট মহোদয়। পরে জেনেছিলাম ছাত্র, কর্মচারী ও বহিরাগতসহ সেদিন জীবন বিসর্জন হয়েছিল ৩৯ জনের। আহত হয়েছিলেন প্রায় ৩০০ জনের মতো। যদি না সেদিন নাটকের কারণে টিভি হল রুমে সবাই একত্রিত হতো তবে হয়ত এতগুলো জীবন একসাথে হারিয়ে যেত না। সেদিন স্তদ্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রকৃতি। ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারীসহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার হয়েছিল বাকরুদ্ধ। তাদের সাথে কেঁদেছিল সারা দেশ। দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক একজন সম্ভাবনাময় ছাত্র সে তো দেশের সূর্য সন্তান। তাদের এই অসহায় চলে যাওয়া কেউ কি পারে মেনে নিতে? সারা দেশে পালিত হয়েছিল শোক। এমনই একটি অধ্যায়ের অভিজ্ঞতা নিতে সেদিন প্রস্তুত ছিল না কেউ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুকে প্রতি বছর ১৫ অক্টোবর আসে এক মর্মান্তিক শোকের স্মৃতি হয়ে। কেমন করে ভুলব ঐ সন্তানদের। শরৎ আসে সারাদেশে কাশফুলের ঢেউয়ের দোলায় চেপে, শিউলীর লাল শুভ্র চাদর বিছিয়ে, ভোরের শিশিরে মুক্তোর হাসি ছড়িয়ে। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে জগন্নাথের আঙ্গিনায় শরতের কাশের দোলা আসে মর্মান্তিকতার আঘাত হয়ে। শিউলীর শুভ্রতার চাদর হয়ে যায় শবাচ্ছাদন। আর ভোরের শিশির কণাগুলো ঝরে পরে শুধুই বেদনার নীল অশ্রু বিন্দু হয়ে।





রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ অক্টোবর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়