ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

এ দেশেতে জন্ম যেন এ দেশেতেই মরি

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০৭, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এ দেশেতে জন্ম যেন এ দেশেতেই মরি

অজয় দাশগুপ্ত

কোনো এক ডিসেম্বরে আমি ফোন করেছিলাম ব্রুস উইলসনকে। ব্রুস তখন লন্ডনের এক নার্সিং হোমে। রোগশয্যায় থাকলেও তাঁর রসবোধের কমতি ছিলো না। নাম শুনে, পদবী শুনে বললেন, তুমি তো হিন্দু বৈদ্য সম্প্রদায়ের। আমি চমকে উঠেছিলাম। যেসব পরিচয় দেয়া এক ধরণের তুচ্ছতা তাও জানেন তিনি। আমার ফোন করার কারণ ছিলো এই মানুষটি ষোল ডিসেম্বরে রেসকোর্স ময়দানে হাজির ছিলেন। যুদ্ধের পুরো সময়টা মুক্তিবাহিনীর সাথে কাটানো ভদ্রলোক আত্মসমর্পণের খবর কাভার করতে গিয়েছিলেন তাদের সাথে। ‘মেলবোর্ন এজ’ পত্রিকার সাংবাদিক ব্রুস উইলসন  আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একজন সৈনিকও বটে। যিনি নয়মাস ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে আমাদের যোদ্ধাদের সঙ্গ দিয়েছিলেন, তাঁকে যোদ্ধা বলার বিকল্প কোথায়?

তিনি আমাকে এমন কিছু ঘটনার কথা বলেছিলেন যা ছিলো অশ্রুত। কাদের সিদ্দিকী তখনো বিতর্কিত কেউ নন। অথচ এই ভদ্রলোক আলাপে বারবার তার কথা এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। একসময় আমি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম কেন? হাসতে আসতে জানিয়েছিলেন, অতি আবেগের যোদ্ধা বা অতি উৎসাহী কাউকে তিনি তেমন গুরুত্ব দিতে রাজী নন। তখন না বুঝলেও এখন বুঝি কেন তিনি তা বলেছিলেন। আলাপের ফাঁকে তিনি এ কে খন্দকারের কথা বলছিলেন। তাঁর মতে এই মানুষটিই জানেন সত্যিকার ইতিহাস। যিনি সে সন্ধ্যায় উপস্থিত ছিলেন সেই মাঠে। জানি না আজ ব্রুস উইলসন বেঁচে আছেন কি না। মনে হয় না তিনি আর দুনিয়ায় আছেন। থাকলে তাঁকে একটা কথা বলতাম- সেই এ কে খন্দকারও আজ পথভ্রষ্ট। জানি না কোন কারণে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের লিজেন্ডরা এমন পথ হারিয়ে ফেলেন? অথচ একাত্তরের সেই দিনগুলোতে জাতি ঝলসে উঠেছিল খাপ খোলা তরবারীর মতো। আমাদের ভেতর তেমন কোনো বিভেদ বা অনৈক্য ছিলো না। ধীরে ধীরে আমরা এমন এক অন্ধকার জগতে প্রবেশ করেছি যেখানে বন্ধু-শত্রু একাকার। যেখানে আমরা সবাই আজ কোনো না কোনোভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।

বিজয় দিবসে আমি বালক ছিলাম। কিন্তু আমার বুদ্ধি বা বোঝার রাস্তা তখন খুলে গিয়েছে। একথা তাই নিশ্চিন্তে বলতে পারি বাঙালি আজ ভাবতেও পারবে না কেমন ছিলো সে সময়ের জনমত।  কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবিনি বঙ্গবন্ধুকে কেউ  বিতর্কিত করতে পারে। তাজউদ্দীন আহমদের মতো নেতা চলে যাবেন বিস্মৃতির আড়ালে। অথচ সেটাই সত্য। আরো নির্মম এই, খালেদা জিয়া একজন সেক্টর কমান্ডারের স্ত্রী হয়ে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর করুণ দিনে কেক কাটতে পারেন! ভাবিনি একজন সৈনিকের ঘোষণা উঠে আসবে স্বাধীনতার ঘোষণা হয়ে। এরপর আমাদের অতীতকে টেনে হিঁচড়ে নামানো হবে অন্ধকারের অতল গর্ভে। তাই তারুণ্যকে আমরা ঢালাও দোষারোপ করতে পারি না। কিন্তু এটা মানতেই হবে, তারা বিভ্রান্ত। শেখ হাসিনার পরপর  দুই দফা দেশ শাসনে মিডিয়া ও দেশজুড়ে অবারিত স্বাধীনতার ইতিহাস দেখার পর, জানার পরও অন্ধকার যায়নি। কেন? তবে কি এটাই মানতে হবে আমাদের ভেতর কোথাও কোন বড় ধরণের ত্রুটি ছিলো? না আমরা আসলে এই বিজয়ের এমন পরিণতি চাইনি? এখন এই প্রশ্নের উত্তর জানার সময় এসেছে।

কোনো জাতি সারাজীবন তার ইতিহাস নিয়ে যুদ্ধ করতে পারে না। তার সুবর্ণ অতীত বা গৌরবকে কেবল মুষ্টিমেয় মানুষ কলঙ্কিত করেছে এটা এখন মানা মুশকিল। ইতোমধ্যে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের এক বিরাট অংশের লেজও খসে পড়েছে। গজিয়েছে নতুন নতুন লেজ। যে লেজে পাকি গন্ধ। তাদের আচরণে দেশবিরোধিতা প্রকট। তাই জানা দরকার একি তাদের পাকিস্তান ভাঙার মনোবেদনা? না এর পেছনে আছে অন্য কোনো ইন্ধন। অনেকে বলেন, ভারত যেহেতু হিন্দুপ্রধান দেশ তার কাছে পাকিস্তানী বাহিনীর পরাজয় মেনে নেয়া বুকে শেলের মতো বিঁধে থাকে। কারো কারো মতে, দেশ স্বাধীনের পর ভারতের ভূমিকা দায়ী। অথচ এর একটাও যুক্তিতে টেকে না। কারণ দেশ স্বাধীনের পর ভারত যদি আমাদের ওপর ছড়ি ঘোরায় তা হয়েছে আমাদের দুর্বলতায়। রাজনীতিতে জাতীয় ঐক্য আর অসমঝোতার জন্য আমরা কোনো বিষয়ে একমত হতে পারি না। সেখানে ভারত একা না, মিয়ানমারও আমাদের ভুগিয়েছে। ভোগায়। কিন্তু তার বেলায় এমন উগ্রতা নাই আমাদের। মনস্তত্ব কি বলে জানি না, আমার ধারণা সাম্প্রদায়িকতা একটা বড় বিষয় হলেও এর পেছনে আছে ইন্ধন আর ষড়যন্ত্র। যা বিনা উস্কানিতেও দিনের পর দিন, বছরের পর বছর বয়ে চলেছে ধমনীতে।

আজকাল গণতন্ত্র আর মুক্তচিন্তার নামে বাঙালি কোন জগতে বসবাস করে বা তার মনে কী আছে জানা দুস্কর। একদিকে সংস্কার, আরেক দিকে বাড়াবাড়ি। সাথে জুটেছে বয়স হয়ে যাওয়া প্রবীণ নেতাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা। সব মিলিয়ে উইলসনের বাংলাদেশ, আমাদের এই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে শায়িত বীর মুক্তিযোদ্ধা বীরপ্রতীক ওডারল্যান্ডের বাংলাদেশ আগের জায়গায় নাই। আওয়ামী লীগ দেশ শাসনে থাকায় বিজয় দিবস ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়। অথচ দেশের বাইরেও তার ব্যবহার সীমিত।  যে উৎসবটি ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবার, যার উদযাপনে বাঙালির ঘরে ঘরে আনন্দ আর জয় ধরা দেবার কথা, তা হয় নিতান্ত দায়সারা গোছের। এতেই প্রমাণিত, আমরা বিজয় দিবস মানি। কিন্তু বিজয় মনের মধ্যে তেমন ধারণ করি না। করলে মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাস নিয়ে সকল বিতর্কের অবসান ঘটতো।

বড় মায়ার দেশ আমাদের। সমাজে এখনো মানুষের মনে মায়া আর ভালোবাসাই মূখ্য। দিনদিন নানা ঘটনায় টাল খাওয়ার পরও আমরা দেশপ্রেমী। আর কোনো জাতিকে আমি দুচোখের জলে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে দেখি না।  আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু দেশপ্রেমের কারণে ভালো করে সংসারও করতে পারেননি। আমাদের নেতা তাজউদ্দীন কিংবা সৈয়দ নজরুলেরা সেই কবে প্রাণ দিয়ে গেছেন। যখন তাদের পরিবারে সময় দেয়ার কথা তখন তারা পরপারে। আমাদের তরুণেরা ভাষার জন্য জান দিয়েছিলেন। আমাদের যুবকেরা স্বাধীনতার জন্য এক কাপড়ে দেশত্যাগ করেছিলেন। তারা জানতেন না কী হতে পারে? কীভাবে তারা পাক বাহিনীর মতো শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়বেন? তারপরও কেউ থেমে থাকেননি। বীরাঙ্গনারা ইজ্জত দিলেও সম্মান লুণ্ঠিত হতে দেননি। এই রক্তভেজা মাটি কারো দয়ার দান না। আমরা ছিনিয়ে নিয়েছি। আমাদের মুক্তি কোনো কাগুজে চুক্তিতে আসেনি। হায়েনার মুখ থেকে বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে আনতে জানা জাতি সামান্য কারণে, তুচ্ছ স্বার্থে দেশের বিজয়কে হেলা করবে এটা মানতে সত্যি দুঃখ হয়। 

সাগর যার বন্দনা রচে শত তরঙ্গভঙ্গে

আমরা বাঙালি বাস করি সেই বাঞ্ছিত ভূমি বঙ্গে

বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি

আমরা হেলায় নাগেরে খেলাই নাগেরি মাথায় নাচি।


জয় বাংলার অনন্ত উৎসে শুভ হোক বিজয় আমাদের।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ ডিসেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়