ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সমাজ কাঠামোয় নারীর যাপিত জীবন

মাহমুদা রিদিয়া রশ্মি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫১, ১৯ মার্চ ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সমাজ কাঠামোয় নারীর যাপিত জীবন

মাহমুদা রিদিয়া রশ্মি : ‘স্বামীর সেবা সাঁঝের বাতি/ডাক বলেন্ডু লক্ষ্মীর ঝাঁপি’- খনার প্রবাদটির অর্থ: স্বামী সেবা ও সন্ধ্যায় পূজা অর্চনায় নিবেদিত নারীই কেবল লক্ষ্মী। খনা তার সময়কার সমাজের কঠিন চিত্রটি তুলে ধরেছিলেন যেখানে নারীকে অতি নগণ্যচিত্তে উপভোগ করা হতো। খনাও এ উপভোগ্য পণ্যের তালিকা থেকে বাদ পড়েননি। প্রাণত বিশ্বাস করা হয় শিক্ষা সমাজ সংস্কার ও নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সংশোধন ঘটায়। বহু বছর পূর্বে শিক্ষার অভাবে সমাজে নারীর উপর নিপীড়নমূলক কু-সংস্কার, প্রথা চাপিয়ে দেয়া হতো। খনার লোকাচারটি শিক্ষা বিস্তারহীন অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজের হলেও আধুনিক শিক্ষিত সমাজে কি এমনটি হয় না? অবশ্যই হয়। তবে তা কালের নিয়মে প্রথাতেই।

প্রথা হচ্ছে সমাজ কর্তৃক সৃষ্ট ও বিনা দ্বিধায় পালিত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, নিয়ম-কানুন, বিধি-নিষেধ, বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ড যা সুদীর্ঘকাল থেকে চলে আসছে। প্রথার অন্তঃকোষে বিদ্যমান বৈষম্য বায়বীয় গতিতে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করছে। তা দূরীকরণে ফলপ্রসূ কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি। গুটিকয়েক প্রতিবাদী মানবিকগণ বৈষম্য দূরীকরণে আপ্রাণ চেষ্টা করলেও কাঙ্খিত ফলাফল দৃশ্যমান নয়। কারণের ব্যাখ্যায় বলাবাহুল্য যে, সমাজ নিজেই বৈষম্য সৃষ্টিকারী। আধুনিক সমাজেও নারীরা জেন্ডারিং মুক্ত হতে পারেনি যেখানে চেনার উপায় হিসেবে মানব শিশুকে জন্মাবস্থায় বিভাজন করা হয়।

উপমহাদেশের প্রখ্যাত নারী অধিকার নেত্রী কমলা ভাসিন ‘জেন্ডার প্রসঙ্গ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন: ‘নারী- পুরুষের মধ্যে বিরাজমান বাস্তবতাকে বোঝার জন্য একটি বিশ্লেষণ টুল বা হাতিয়ার হলো জেন্ডার। জন্মের পর ভিন্ন শারিরীক গঠন বৈশিষ্ট্যের দুটি শিশুকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মোড়কে গড়ে তোলাই হলো জেন্ডারিং বা লিঙ্গায়ন প্রক্রিয়া।’ ‘সমাজে নারীর অধঃস্তনতার জন্য নারী দায়ী এবং বিদ্যমান নারী পুরুষের পৃথক বৈশিষ্ট্য, ভূমিকা ও মর্যাদা জৈবিক কারণে সৃষ্ট’- বদ্ধমূল ধারণাটি নারীর প্রতি খাটো দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। ফলে বেড়ে ওঠা থেকে বিদ্যালয় পর্যন্ত এমনকি বৈবাহিক জীবনেও একজন নারী বিভিন্ন বাধা, বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হয়।

বিদ্যালয়ে পা দিয়েই জেন্ডারিং বৈষম্যের মুখোমুখি হয় একজন মেয়ে। জেন্ডারিং ও বৈষম্য কনসেপ্টের ব্যাখ্যায় বলা বাহুল্য যে, মেয়েদের প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়েই মাধ্যমিকের গণ্ডিতে অবশ্যই ওড়না পরতে হবে। অপরদিকে  পাঠ্যক্রমে ছেলেদের কৃষিশিক্ষা ও মেয়েদের গার্হস্থ্য অর্থনীতি পড়ানো হয়। সমস্ত গৃহস্থালীর কার্যক্রম পাঠ্যতালিকার বিষয়বস্তু। এতে একজন মেয়ে মানসিকভাবে এই শিক্ষাই নেয় যে, সারাজীবন তাকে শ্বশুড়ালয়ে পতি সেবা করতে হবে।
বিয়ে। চুক্তি। দেনমোহর। পারস্পারিক সম্পর্কযুক্ত তিনটি শব্দের মধ্যে নির্যাতন ও লাঞ্ছনার গন্ধ পাওয়া যায়। সামাজিক রীতিতে দেনমোহর বিনিময় প্রথায় নারীকে পুরুষের হাতে তুলে দেয়া পূণ্য মনে করেন পরিবার প্রধান। সম্পর্ক হয় মননে, অনুভূতিতে, সম্মানে, ভালোবাসায়। সম্পর্কে থাকে না কোনো ভৌগলিক সীমারেখা। দেনমোহর ভাইরাসে আমি, আপনি প্রতিটি নারীই আক্রান্ত। বিনিময় প্রথায় দুই, পাঁচ বা দশ লক্ষ টাকায় কখনই সম্পর্ক মূল্যায়িত হয় না সেই সাথে নারীরা পায় না যথেষ্ট সম্মান। টাকা যদি হয় সম্পর্কের পরিমাপক তাহলে বলতে দ্বিধা নেই যে, ফরমালিন দিয়ে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা সম্ভব কিন্তু তা প্রাণান্তর বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়। প্রথাগুলো ক্যাকটাসের ন্যায় নারীদের দেহমনে রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে। কোনো নারী এ ভয়ঙ্কর প্রথাগুলো ভাঙ্গতে গেলেই সমাজের দৃষ্টিতে তিনি খারাপ।

সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী এমনকি শাহবাগে গলা ফাটিয়ে অধিকার আদায়ে চিৎকার করা বা কলম ধরার মত সাহস থাকলেও আমরা নারীরা পারিনি দেনমোহর প্রথার কালো অধ্যায়ের অবসান ঘটাতে। নিজেকে ভালো মেয়ে প্রমাণের দাবিতে বিনিময় প্রথার সমঝোতার স্বারকলিপিতে স্বাক্ষর করে এমনকি নির্দিষ্ট অর্থ গ্রহণের মাধ্যমে নারীরা বিয়ের পিঁড়িতে বসে। ‘বসে’ শব্দটি এজন্য বলা সমাজের দৃষ্টিতে পুরুষেরা বিয়ে করে এবং নারীরা বিয়ে বসে। গরীবের বউ সবার ‘ভাউস’।অর্থাৎ ভাবী। অর্থাৎ মায়ের নীতিতে না দেখে ভাবীদের এমন দৃষ্টিতে দেখা হয় যেন যেকোন প্রয়োজনে পুরুষরা নারীদের ব্যবহার করতে পারবে। তাদের চোখে ভাবী একটি ‘সেক্স’ ফ্যান্টাসি জাতীয় শব্দ। ভাষাগত জায়গাতেও যেন নারীদের খাটো রাখা হয়।

নাড়ীর সম্পর্ক ছিন্ন করে শ্বশুড়ালয়ে পা দিয়েই একজন নববধূ বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয়। এক হাত লম্বা ঘোমটা দেয়ার ক্রটি বিচ্যুতি হলেই চুলচেরা বিশ্লেষণ করে শ্বশুড়ালয়। সমস্ত গৃহস্থালির কাজ শেষে একজন অসুস্থ গৃহবধূর বিশ্রাম নেয়াটা বড় মাপের অন্যায় বিবেচনায় আনে পরিবারটি। ‘নতুন বউ শুধু ঘুমাই’ এমন অভিযোগও কানে আসে। এটি একটি উদাহরণ হলেও এমন মন্তব্য অহরহ দেখা যায়। শ্বশুড়ালয়ে  একজন নারী কোনো কাজের প্রশংসা পাবার পরিবর্তে অবহেলিত হয় বেশী। পারিবারিক ইস্যুতে নিজের বা সন্তানের সিন্ধান্তটুকু নেবার অধিকারও থাকে না এমনকি শত মানসিক নির্যাতন সহ্য করে একজন নারী কখনই প্রতিবাদ করতে পারে না। মাপকাঠিতে ন্যায় অন্যায় বিবেচনা না করেই পুরুষতান্ত্রিকতার জৌলুসে একজন সহযোদ্ধাও বিভিন্ন পারিবারিক ইস্যুতে নারীকে ভুল বুঝতে শুরু করে।

লেখনীতে পরিবার তথা সমাজে নারীর অবস্থান তুলে ধরতে গিয়ে বারংবার উপলদ্ধি হয়েছে পুরুষতান্ত্রিকতার সমাজে নারীদের সম্মানের সাথে বেঁচে থাকাটা চ্যালেঞ্জিং। কিছু শিক্ষিত নারীরা মর্যাদকর অবস্থানে থাকলেও, বেশীরভাগ অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত পর্যায় সারনীতে অবস্থান করছে, পাচ্ছে না কোনো বেনিফিট। যেখানে পুরুষরা সহজেই সম্পদের ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ, স্বাধীন জীবনযাপন, সহজে কাজের সুবিধা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ পায় যার কোনটাই নারীরা ভোগ করতে পারে না।

লেখক: এম.ফিল শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ মার্চ ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়