ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

বাংলাদেশে গণহত্যা এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অপেক্ষা

অলোক আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫১, ২৫ মার্চ ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাংলাদেশে গণহত্যা এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অপেক্ষা

অলোক আচার্য : নির্বিচারে পরিকল্পিতভাবে কোনো জাতিকে হত্যা করে স্বার্থ হাসিল করাকে ‘গণহত্যা’ বলে। পৃথিবীর ইতিহাসে বহু গণহত্যার নজির রয়েছে। ভয়ঙ্কর সে হত্যায় বহু নিরীহ নির্দোষ মানুষের প্রাণ গেছে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানি জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের প্রক্রিয়া চলাকালে পাকিস্তানি সেনারা ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ঝাপিয়ে পরে। সেই রাত ছিল সত্যিকার অর্থেই কালরাত, বিভীষিকাময়। তারা বাঙালি নিধনে মেতে উঠেছিল। তারা চেয়েছিল পৃথিবীর মানচিত্র থেকে আমাদের চিহ্ন একেবারে মুছে দিতে। এক রাতেই তাদের হাতে মারা গিয়েছিল লাখো নিরস্ত্র মানুষ। এই জঘণ্য হত্যাকাণ্ড পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান অস্বীকার করেছে। ওই রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তৎকালীন ইপিআর সদর দপ্তর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে বাঙালিদের ওপর বন্দুক ও কামান নিয়ে হামলা চালায়। এই নির্মম গণহত্যা চালিয়েছিল ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নাম দিয়ে। অতর্কিত আক্রমণ করে পাকিস্তান বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলনকে চিরদিনের জন্য থামিয়ে দিতে চেয়েছিল। 

১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত রেজ্যুলেশন ২৬০(৩) এর অধীনে গণহত্যা বলতে বোঝানো হয়েছে এমন কর্মকাণ্ড যার মাধ্যমে একটি জাতি বা ধর্মীয় সম্প্রদায় বা নৃতাত্তিক গোষ্ঠিকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস নেয়া হয়েছে বা হচ্ছে। ২৫ শে মার্চ রাতের এবং পরবর্তী নয় মাসের গণহত্যাকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা হিসেবে আজও স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। আমাদের উচিত ছিল আরও জোরালোভাবে গণহত্যার স্বীকৃতির বিষয়টাকে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে তুলে ধরা। কারণ সেই কালরাতেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযানে অন্তত এক লাখ মানুষ প্রাণ হারান বলে বিভিন্ন তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। এর পরবর্তী নয় মাসে আরও প্রায় ৩০ লাখ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। জানা যায়, অস্ট্রেলিয়ার ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী শুধামাত্র পঁচিশে মার্চ রাতেই বাংলাদেশে প্রায় এক লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যা গণহত্যার ইতিহাসে এক জঘন্যতম ঘটনা। মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চললো মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করলো ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট লুট আর ধ্বংসের নেশায় তারা মেতে উঠল। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুনতাড়িত শ্মশান ভূমি।

এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয়, ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল’। পৃথিবীর কয়েকটি দেশে ঘটে যাওয়া গণহত্যার মধ্যে রুয়ান্ডা, দারফুর, বসনিয়া, কম্বোডীয়া, হলোকাস্ট ও ন্যানকিং এবং আর্মেনীয় গণহত্যা ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য। দারফুর গণহত্যাকে একুশ শতকের নৃশংসতম গণহত্যা হিসেবে ধরা হয়। আর্মেনিয়া, রুয়ান্ডা, সিয়েরা লিওনের মত ছোট ছোট দেশ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও ২৫ শে মার্চ ১৯৭১ সালে ঘটা বাঙালিদের ওপর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি। এ স্বীকৃতি আদায়ে গতিও নেই। জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস পালন করা হওয়ার সাথে সাথে এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে সচেষ্ট হয়েছে সবাই। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য প্রথম ধাপ হিসেবে বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস করাতে হবে। একটি বিরাট হত্যাযজ্ঞকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে কর্তৃপক্ষকে আরও বেশি উদ্যোগী হতে হবে। ২০১১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৯ তম অধিবেশনে আর্মেনিয়ার প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’  পালনের ঘোষণা করা হয়। এ প্রস্তাবে সমর্থন দেয় বাংলাদেশসহ ১৯৩টি সদস্য দেশের সদস্যরা। উল্লেখ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তুর্কিরা আর্মেনীয়দের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। তিন বছর ধরে চলা এই গণহত্যায় সেদেশে ১৫ লাখ মানুষ মারা যায়। সে সময় আর্মেনিয়ার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৩৪ লাখ। আর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মাত্র নয় মাসেই ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করে রক্তের নদী বইয়ে দিয়েছিল। কি নিষ্ঠুর এবং নির্মম সেই হত্যাযজ্ঞ! যাই হোক, আমাদের আর ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের সুযোগ নেই। আমাদের এ স্বীকৃতি আদায়ের দাবি তোলা বেশি দেরি হয়ে গেছে। আরও আগে আমাদের এই দাবী উত্থাপন করা প্রয়োজন ছিল।

এত বড় একটি হত্যাযজ্ঞ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি না পেলে তা হবে আমাদের ব্যর্থতা। মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ইতিহাসের এক গৌরবমণ্ডিত অধ্যায়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে মুক্তি পেয়ে বাঙালিরা মূলত আরেকটি অত্যাচারের অধীনে চলে গিয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তান শুরু থেকেই বাঙালিদের তাদের প্রাপ্য অধিকার দিতে চায় নি। তাদের লক্ষ্যও ছিল সেই ব্রিটিশদের মতোই। বাংলার মানুষ নয়, সম্পদের প্রতিই ছিল তাদের লোভ। ফলে অধিকারের জন্য বরাবরই বাঙালিকে লড়তে হয়েছে, জীবন দিতে হয়েছে। ৭০ এর নির্বাচন ছিল বাঙালির দাবি আদায়ের শেষ পদক্ষেপ। তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের পর বাঙালি বুঝে গিয়েছিল পাকিস্তানিরা তাদের অধিকার কখনোই এমনি এমনি মেনে নেবে না। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ করে যে রক্তের নদী বইয়ে দেয় তা শেষ হয় দীর্ঘ নয় মাস পর। অনেকেই মনে করেন, ২৫ মার্চের গণহত্যা শুধু এক রাতের হত্যাকাণ্ড ছিল না, এটা ছিল মূলত বিশ্ব সভ্যতার জন্য এক কলঙ্কজনক জঘণ্যতম গণত্যার সূচনা মাত্র। এত বড় একটি হত্যাযজ্ঞের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে আমাদের আরও বেশি উদ্যোগী হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধকালীন আমাদের মিত্র দেশগুলোর সাথে আলোচনা করে এগুতে হবে। ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করার সুযোগ আমরা হারিয়েছি কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে ২৫ শে মার্চ এবং পরবর্তী নয় মাসের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ মার্চ ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়