ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বাংলাদেশে মে দিবসের গুরুত্ব

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫৯, ১ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাংলাদেশে মে দিবসের গুরুত্ব

মাছুম বিল্লাহ : ২০১৯ সালে মহান মে দিবসের স্লোগান হচ্ছে Uniting Workers for Social and Economic Advancement. ১৮৮৬ সালের এই দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাদের আত্মদানের কথা স্মরণ করে এবং তাদেরকে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য প্রতিবছর দিনটি বিশ্বের দেশে দেশে পালিত হয়ে আসছে। ১লা মে শিকাগোতে শ্রমিকদের আত্মদানের মধ্য দিয়ে শ্রমিক শ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠার সূচনা হয়েছিল। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য শ্রমিকদের আত্মত্যাগের এই দিনকে তখন থেকেই বিশ্বে মে দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। শিকাগোসহ আমেরিকার বড় বড় সিটিতে এখনও শ্রমিকরা দিবসটি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে পালন করে। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশে শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষের অবদান অনস্বীকার্য। অসহনীয় পরিবেশে শ্রমিকদের প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা কাজ করতে হতো যা শুনলেই অবাক হতে হয়। সপ্তাহজুড়ে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙ্গে পড়ছিল আর শ্রমজীবী শিশুরা হয়ে পড়েছিল কঙ্কালসার। তখনই সহাসী শ্রমিকেরা দাবি তুলেছিলেন যে, পুরো  জীবন কিনে নেয়া যাবে না। তাদের স্বস্তি দিতে হবে, তাদের বাঁচতে দিতে হবে। কারণ তারা বাঁচলেই কল-কারখান বাঁচবে, মালিকরা বাঁচবে। মালিক-শ্রমিক একতাই হচ্ছে শিল্পোন্নয়নের মূলকথা। কিন্তু দেখা যায় শ্রমিক জীবনের সঙ্গে কান্নার নিবিড় সম্পর্ক। আর তাই মে দবিসের মূল কথাই হচ্ছে-সাম্যবাদ, শ্রমের অধিকার ও শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহম্মদ (দ:) শ্রমিকের পারিশ্রমিকের ব্যাপারে বলেছিলেন, ‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগে তার মজুরি দিয়ে দাও।’ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রমিকের মর্যাদার বিষয়টি এখানে সুস্পষ্ট।

শ্রমিক নেতারা কঠোর দমননীতির মুখোমুখী হয়েছেন। এমনই একজন ছিলেন জো হিল। অভিবাসী শ্রমিক ও সংগীত রচয়িতা জো হিলকে হত্যার অভিযোগে প্রাণদণ্ড দেয়া হয় ১৯১৫ সালে। ১৮৮৯ সালে জিম কোন্যাল লিখেন রেড ফ্লাগ নামে একটি গান। যার প্রথম চরণ হচ্ছে- জনতার পতাকা টকটকে লাল/ঢেকে রাখে শহীদের লাশ/ শক্ত শীতল তাদের দেহ/এই পতাকার প্রতি ভাঁজে/ হৃদয়ের রক্ত রাঙায় এই পতাকা।’ মানুষের বেদনার কথা উঠেছে এই বর্ণনার মধ্য দিয়ে । জন হেনরি মালিকের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে নিজের শ্রম আর ঘামে শ্রমিকশ্রেণির মাথা চির উন্নত করে গেছেন। পৃথিবীর শ্রমিকেরা যার জন্য বলতে পারেন, ‘নাম তার ছিল জন হেনরি, ছিল যেন জীবন্ত ইঞ্জিন’। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রমজীবী মানুষের কথা স্মরণ করে লিখেছেন, ‘সবচেয়ে কম খেয়ে, কম পরে, কম শিখে বাকি সকলের পরিচর্যা করে। সকলে চেয়ে বেশি তাদের অসম্মান, কথায় কথায় তারা রোগে মরে, উপোসে মরে, উপরওয়ালাদের লাথি-ঝাটা খেয়ে মরে। তারা সভ্যতার পিলসুজ, মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে উপরের সবাই আলো পায়, তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে।’ আজও কি এই অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে?

১৮৬০ সালে শ্রমিকরা তাদের মজুরি না কমিয়ে সারা দিন আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের জন্য দাবি জানান। এ জন্য তারা একটি সংগঠন তৈরি করেন। পরবর্তীকালে যার নাম হয় আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার। এই সংগঠন শ্রমিকদের প্রাপ্য মুজরি ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে অবিরত আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। এরপর ১৮৭১ সালের মার্চ মাস থেকে মে পর্যন্ত ফ্রান্সের প্যারিসে ভার্সাই-এর সেনাদলের সঙ্গে রাস্তায় রক্তাক্ত সংঘর্ষে পরাজিত হতে থাকে শ্রমিক অধিকারের এই আন্দোলন। এই সময় ফরাসি কমিউনিস্ট এবং পরিবহন কর্মচারী ইউজিন পেটিয়ে রচনা করেন বিশ্ব শ্রমিক আন্দোলেনর গান ‘ইন্টারনাসিওনালে’। ১৮৮৪ সালে সংগঠনটি দিনে কাজের সময় ‘আট ঘণ্টা’ নির্ধারনের জন্য মালিকপক্ষের কাছে সময় বেঁধে দেয়। সময় দেয়া হয় ১৮৮৬ সালের ১লা মে পর্যন্ত। বারবার মালিক পক্ষের কাছে দাবি জানানো হলেও একটুও সাড়া মেলেনি। পহেলা মে যতোই এগিয়ে আসছিল, দুই পক্ষের সংঘর্ষ ততই তীব্র হয়ে উঠছিল। পহেলা মে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় তিন লাখ শ্রমিক কাজ ফেলে রাস্তায় নেমে আসেন। আন্দোলন চরমে ওঠে ৩ মে সন্ধ্যাবেলা। শিকাগোর হে মার্কেট বাণিজ্যিক এলাকায় জড়ো হওয়া শ্রমিকদের থেকে দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন কিছু পুলিশ সদস্য। এমন সময় হঠাৎ আততায়ীর বোমা বিস্ফোরণে কিছু পুলিশ সদস্য আহত হন। পরে মারা যান ছয়জন। ফলে পুলিশও শ্রমিকদের ওপর আক্রমণ চালায় এবং এগারো জন শ্রমিক নিহত হন। পুলিশের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের হত্যামামলায় অভিযুক্ত করে ছয়জনকে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয়া হয়। কিন্তু এই মিথ্যা বিচারের অপরাধ শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে। ১৮৯৩ সালের ২৬জুন ইলিনয় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মিথ্যে ছিল ওই বিচার। পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের ‘দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ’-এর দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়। সেই থেকে পহেলা মে পালিত হয় শ্রমিকদের আত্মদান আর দাবি আদায়ের দিন হিসেবে। বর্তমানে বিশ্বের আশিটিরও বেশি দেশে মে দিবস মর্যাদার সাথে পালিত হয়।

মে দিবসের গুরুত্ব বাংলাদেশে একটু ভিন্নতর। একদিকে আমাদের উদীয়মান গার্মেন্টস শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ লেগেই আছে। সরকার যদিও দাবি করে যে, ২০১০ সালেই  গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি ৮২ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। ৪৫০টি ট্রেড ইউনিয়নকে রেজিষ্ট্রেশন প্রদনা করা হয়েছে, বিভিন্ন ট্রেডে ৬০ হাজার বেকার নারী পুরুষকে প্রশিক্ষণ, শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে, শ্রমজীবীদের অবসর গ্রহণের বয়স ৫৭ থেকে ৬০ বছর করা হয়েছে কিন্তু শ্রমিক অসন্তোষ কি থেমেছে? শ্রমিক অসন্তোষ আমাদের উদীয়মান গার্মেন্টস শিল্পকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। আমরা ভুলে যাইনি সেই ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধ্বসে পড়ার কথা, যা  দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ শিল্প দুর্ঘটনা। ছয় বছর অতিক্রান্ত হলেও এ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা এখনো নিশ্চিত হয়নি। নিহত ও আহতদের পরিবারবর্গের দুর্দশাও ঘোঁচেনি। শ্রমিকদের বঞ্চনার ইতিহসা নতুন নয়। দেশে দেশে যুগে যুগে নানাভাবে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকেছে শ্রমজীবী মানুষ। দিনরাত পরিশ্রম করেও তারা ঠিকমতো মজুরী পায় না। তার ওপর বেতন বকেয়া থাকা, কথায় কথায় শ্রমিক ছাটাই, লক আউট- এসব কারণেও শ্রমিকদের দুর্দশার সীমা থাকে না। কাজের পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত নয়। ঝুঁকিমুক্ত নয়। অথচ গার্মেন্টস শিল্পের ২৫ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ৮০ শতাংশই নারী শ্রমিক। তাদের জন্য নারী শ্রমবান্ধব পরিবেশ নেই অধিকাংশ গার্মেন্টস কারখানায়। তাদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত বাথরুম নেই, অগ্নিনির্বাপনের আধুনিক ব্যবস্থা নেই। এ ধরনের নিরাপত্তার ঝুঁকি রয়েছে এখনও বিশাল অঙ্কের গার্মেন্টস কারখানায়। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, গার্মেন্টস শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে শ্রমিকদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে, বাঁচতে হবে মালিকদেরও। তবেই দেশ এগিয়ে যাবে সমৃদ্ধির দিকে। সেই বাস্তব কথাটি কি আমরা বিশ্বাস করি? শুধু গার্মেন্টস নয় ৮০ থেকে ৯০ লাখ শ্রমিক কাজ করছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। তাদেরকে অমানবিক জীবন যাপন করতে হচ্ছে। নারীদের জন্য বাড়তি রয়েছে নারী নির্যাতন ও যৌন হয়রানি। দ্বি-পাক্ষিকভাবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে এগুলোর দ্রুত ও কল্যাণকর সমাধান প্রয়োজন।

শ্রমিকদের আন্দোলনের মাধ্যমেই দৈনিক কাজের সময় ১৬ ঘণ্টা থেকে নেমে আসে ৮ ঘণ্টায়। বিশ্বের সব দেশের শ্রমিকরা এর মাধ্যমে তাদের শ্রমের উপযুক্ত মর্যাদা পেতে শুরু করে। নিজেদের অধিকার আদায়ে তারা এগিয়ে যায় সামনে। মেহনতি মানুষ মুক্তি পেতে শুরু করে তাদের শৃঙ্খলিত জীবন থেকে। বিশ্বের ইতিহাসে সংযোজিত হয় সামাজিক পরিবর্তনের আর একটি নতুন অধ্যায়। কিন্তু শ্রেণি বৈষম্যের বেড়াজাল থেকে বিষয়টি কি পুরোপুরি মুক্তি পেয়েছে? ঝুঁকিপূর্ণ কাজে এখনও বিশ্বে প্রতিবছর বাইশ থেকে পঁচিশ হাজার শিশু প্রাণ হারায়।  নিরাপত্তার অভাবে আজও শত শত শ্রমিক অকালে মৃত্যুবরণ করে। শ্রমজীবী মানুষদের প্রকৃত মর্যাদা প্রদানের মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে মে দিবসের আসল উদ্দেশ্য, বিশ্বে বইতে পারে সাম্যবাদের সুবাতাস।

লেখক : শিক্ষা গবেষক ও বিশেষজ্ঞ



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ মে ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়