ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মুনাফায় ভেসে যাওয়ার জন্য রমজান আসেনি

জাফর সোহেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৫৩, ৯ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুনাফায় ভেসে যাওয়ার জন্য রমজান আসেনি

জাফর সোহেল: সিয়াম সাধনার মাস রমজান আমাদের মাঝে এসেছে রহমত আর নাজাতের অহবান নিয়ে। আমরা এই মাসে যে যার মতো মহান আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিনের রহমত লাভ এবং কৃত অপরাধের পাপ থেকে নাজাত লাভের আশায় ইবাদত বন্দেগি করি। যতটা সম্ভব অন্যায় থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করি। নিজের কোনো চারিত্রিক ত্রুটি থাকলে তা মেরামতেও অনেকে রমজান মাসকে বেছে নেই। ধর্মীয় বিষয়ে যাদের আরেকটু ভালো মনোযোগ আছে তারা পরকালের  জন্য এবং আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ পাবার জন্য ইবাদত-বন্দেগি করি। এক মাস রোজা রেখে একেবারে শুদ্ধ জীবনের প্রতিশ্রুতি আল্লাহর কাছে এবং নিজের কাছে রাখি। সমাজের বেশিরভাগ মানুষ যদি এভাবে রমজানকে উসিলা করে হলেও সৎ পথে থাকার চেষ্টা করি বা মনস্থির করি, অন্যায় থেকে দূরে থাকার শপথ নিই, তাহলে সমাজে অন্যায়-অবিচার কমে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে, বিশেষ করে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীর কাছে রমজান সত্যিকার অর্থে কতটা স্বমহিমায় হাজির হয় কিংবা রমজানকে তাঁরা কতটা রমজানের মতো করে নিতে পারেন তা প্রশ্নের উদ্রেক করে।

রমজান বলে, তুমি সংযমী হও। এই সংযম কেবল খালি পেটে দিন পার করার নাম নয়। মাথায় টুপি পরা আর মসজিদে যাওয়া-আসার নাম নয়। সংযম দেখাতে হয় জীবনের সব ক্ষেত্রে- পথে-ঘাটে, আচার-আচরণে, অফিসে-দোকানে, ব্যবসা-বাণিজ্যে। আমরা কিছু মানি, কিছু মানি না। রমজান তো কেবল এই বছর দেখছি এমন নয়, প্রতিবছরই দেখে আসছি- রমজান এলেই একটা হাহাকার শুরু হয় বাজার নিয়ে। এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী (তারাও মানুষ, তারাও রোজা রাখেন) হুটহাট করে পণ্যের দাম এতটা বাড়িয়ে দেন যে, বাজারে একটা আগুনে পরিস্থিতি তৈরি হয়। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রোজা শুরুর এক সপ্তাহ আগে থেকেই সিন্ডিকেটের কারসাজি শুরু হয়ে যায়। রমজানে যেসব পণ্যের চাহিদা বেশি সেগুলোর দাম কোনো যুক্তি ছাড়াই বাড়তে থাকে। আমার কাছে বিস্ময় লাগে, কারা এটা করেন? তারা কি মুসলিম নন? তারা কি রমজানের সংযম কী তা জানেন না? ব্যবসায়ীকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য, মুনাফায় ভেসে যাওয়ার জন্য কি রমজান আমাদের মাঝে হাজির হয়েছে? পত্রিকায় এসেছে, মধ্যপ্রাচ্যসহ বেশিরভাগ মুসলিম দেশেই রমজান উপলক্ষে পণ্যের দাম কমে। কেবল বাংলাদেশই ব্যতিক্রম! এখানে কেবল বাড়ে না- দ্বিগুণ, তিনগুণ, বহুগুণ বাড়ে।

অর্থনীতিতে বলা আছে, সরবরাহ বেশি থাকলে বাজারে পণ্যের দাম কমবে। কিন্তু বাংলাদেশে যথেষ্ট সরবরাহ থাকার পরও লাগামহীন দাম বাড়ার খবর বলছে গণমাধ্যম। রমজানের অন্তত ১৫ দিন আগে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, এ বছর রমজানে বেশি চাহিদা থাকে এমন সব পণ্যের যথেষ্ট মজুদ আছে। অতএব এবার দাম বৃদ্ধি পাবে না। যারা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন ঢাকার দুই সিটি মেয়র। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা ঠিকই নিজেদের ইচ্ছামতো দ্রব্যের দাম বাড়িয়েছেন। বাড়তি দামে অন্য বছরের মতোই এবারও মানুষ হাঁসফাঁস করছে।

প্রতিবছর রমজান এলে যেন এই বাস্তবতা বেশি করে সামনে হাজির হয়। বাংলাদেশের বাজার বোঝার বোধহয় কারও কোনো উপায় নেই। অদ্ভুত এই ব্যাপার অনেকটা মেনে নিয়েছে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ। বলা যায় মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। যে কর্তৃপক্ষ বাজারকে দিব্যদৃষ্টিতে দেখার কথা, তারা বছরের অন্য সময় যেমন দেখে না, রমজানেও দেখে না। যদিও তারা বলে, তারা দেখে। দেখলে তার ফল কই? বেগুনের দাম তো ঠিকই দ্বিগুণ বেড়েছে। ছোলা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, খেজুর প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে। এই দাম বৃদ্ধি কেবল এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যেই হয়েছে। স্বাভাবিক হিসাবে কখনোই এক সপ্তাহে পণ্যের দাম এতটা বাড়ে না। তাহলে কথিত মনিটরিং কর্তারা কোথায় আছেন? তাদের এত এত হুমকি ধামকি উপেক্ষা করে কী করে বাজারে দামের এমন বলগা ঘোড়া ছোটে? তাদের হাতে কি লাগাম আছে?

কেবল রমজান শুরু হলো। মাসজুড়ে যদি এই অবস্থা থাকে তাহলে দেশের নিন্মমধ্যবিত্ত এবং নিন্মবিত্ত মানুষ কী করে বাজারে যাবেন আর কী করে একটু ভালো মনে রমজানটা পার করবেন? রমজানে তারা খাদ্য-পানীয় নিয়ে চিন্তা করবেন কখন আর ইবাদত বন্দেগি করবেন কখন? নাকি গরিব বলে তাদের রমজান অন্যদের চেয়ে আলাদা? দামের এই অস্থিরতা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে তো গরিব খেটে খাওয়া মানুষের ওপর। রমজান সবার জন্য হলেও সবার সামর্থ্য সমান নয়। গরীব ও নিন্মবিত্ত মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় রাষ্ট্র কী ব্যবস্থা নিচ্ছে? টিসিবি নামে সরকারি যে প্রতিষ্ঠান এমন সময়ে প্রান্তিক মানুষদের জন্য কম মূল্যে পণ্য বিক্রি করার কথা, তাদের তৎপরতাও সেই অর্থে চোখে পড়ছে না। গরিব মানুষ কোথায় থাকে, রমজানে তাদের কী কী পণ্য কম মূল্যে পেলে সুবিধে হয়- এই তথ্য কর্তৃপক্ষের অজানা থাকার কথা নয়। কথা হলো আন্তরিকতার; কথা হলো ইতিবাচক মানসিকতার। এই দুটি বিষয় কেন জানি আমাদের কর্তৃপক্ষগুলোর মধ্যে সবসময়ই কম থেকে গেল। কোনো বছর এই সংবাদ দেখলাম না যে, এবার সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এমন সব উদ্যোগ ও ব্যবস্থা নিয়েছে যাতে গরিব ও নিন্ম আয়ের মানুষ স্বস্তিতে রমজান মাস পার করছে।

চিন্তা করা দরকার; একটু বেশি করে, একটু আন্তরিকভাবে। বাজারে যারা অহেতুক দাম বাড়ায়, পর্যাপ্ত মজুদের পরও কেবল মুনাফার লোভে যারা পবিত্র রমজান মাসেও অসাধু সিন্ডিকেট গড়ে তোলে, তাদের বিপক্ষে কঠোরতর ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এই ধরনের ব্যবস্থা নিলে সাধারণ মানুষ সরকারকে সাধুবাদ জানাবে। সরকার চাইলে বাজার নিয়ন্ত্রণে আনা অসম্ভব নয়। এরই মধ্যে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসন। এটি একটি স্বস্তিজনক খবর। তবে এটাই পর্যাপ্ত নয়, আমরা চাই, সরকার এমন কিছু করুক যা মানুষের কাছে দৃশ্যমান হবে। রমজানের দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় সপ্তাহে গিয়ে মানুষ যেন দেখতে পায় সরকারি পদক্ষেপে কিছুটা হলেও কাজ হয়েছে। আর আমাদের ব্যবসায়ী ভাইদের প্রতিও অনুরোধ, দয়া করে ব্যবসা করেন, ব্যবসার নামে ডাকাতি করবেন না। পবিত্র মাস রমজান এসেছে সবার জন্য মঙ্গলের বার্তা ও ক্ষমার সুযোগ নিয়ে। মুনাফায় ভেসে যাওয়ার জন্য এই রহমত ও নাজাতের মাস আসেনি। আপনাদের সংঘবদ্ধ উপায়ে দাম বৃদ্ধিতে অবস্থাপন্ন মানুষদের হয়ত খুব একটা সমস্যা হয় না, তাদের নানারকম অর্থের উৎস আছে। কিন্তু যাদের সামর্থ্য নেই, যারা নিন্মবিত্ত, গরিব, যারা দিন আনে দিন খায় তাদের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। তারা রোজায় বিশেষ খাবার নয়, প্রয়োজনীয় খাবার কিনতেই হিমশিম খায়। ভোক্তার সংখ্যায় কিন্তু এই মানুষগুলোই বেশি। বিনা কারণে অহেতুক মূল্য বৃদ্ধি তাদের জন্য অভিশাপ হয়ে আসে। মানুষকে এভাবে বিপদে ফেলার নাম ব্যবসা নয়। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই তিনি সীমা লঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না’।

লেখক: সাংবাদিক, আরটিভি




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ মে ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়