ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বাজেট: যাহা বায়ান্ন তাহাই তিপ্পান্ন

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৮, ১৪ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাজেট: যাহা বায়ান্ন তাহাই তিপ্পান্ন

|| অজয় দাশগুপ্ত ||
বাজেট ঘোষণা এক ধরনের আনুষ্ঠানিকতা। মূলত সরকার ঠিক করে নেয় তারা কীভাবে দেশ চালাবেন। পাঁচ বছরের আর্থিক পরিকল্পনাকেই মূলত বাজেট বলি আমরা। বাংলাদেশে বাজেট একসময় ছিলো প্রহসন। এই কারণে যে, তখন দেশ ছিলো ব্যাকফুটে। আমাদের কপালে তকমা ছিলো গরিব দেশের। সে দেশে না ছিলো গণতন্ত্র, না কোনো জনশাসন। মূলত তখন ছিলো একনায়কতন্ত্র। সামরিক শাসকের অধীনে দেশ চলতো একজনের কথায়। একজনকে খুশী রাখার সেসব শাসন আমাদের কতটা নিচে নামিয়ে এনেছিল সেটা বুঝিয়ে বলার দরকার পড়ে না। আফ্রিকার দরিদ্রতম দেশ ইথিওপিয়া, লাইবেরিয়া, সিয়েরা লিয়নের সাথে আমাদের নাম উচ্চারিত হতো সে সময়। আজকের বাংলাদেশ সেসব অপবাদের বাইরে। ভেতরে বাইরে এক ধরনের স্বচ্ছলতা আর নিরাপত্তা এখন দৃশ্যমান। ফলে এখনকার বাজেটের আয়তন যেমন বড়, মানুষের আশা ভরসাও বড় বড়।

অর্থনীতি আমার বিষয় ছিলো। কিন্তু অর্থনীতি বোঝা কখনো হয়ে ওঠেনি। মূলত যাঁরা বড় বড় অর্থনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত তাঁদের কেউ মন্ত্রী হতে চাননি বা মন্ত্রী হয়ে বাজেট পেশ করেননি। তাদের কাজ বাজেট ঘোষণার পর সেসব নিয়ে গবেষণা করা আর কথা বলা।  আমার মতো সাধারণ মানুষের কলমে মূলত সেসব বিষয়ই আসে যা আমাদের দেশে বা দেশের বাইরে ভাবিত করে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কোনটা সত্য, কোনটা মেকী। রাজনীতি প্রায় মৃত। সমাজে তার কোনো প্রভাব নাই। আজকের মিডিয়াজুড়ে কোথাও প্রতিবাদের ছবি দেখিনি। প্রতিবাদ করতেই হবে এমন কথা নেই। এবং অন্যায্য প্রতিবাদের দরকারও নেই। কিন্তু একটা সময় ছিলো যখন ভালো হোক আর মন্দ হোক এক দল বাজেটকে শুভেচ্ছা জানাত। আরেক দল রাস্তায় নেমে বাজেটবিরোধী গরম গরম স্লোগান দিয়ে মানুষকে জানাতো- কোথায় কোথায় কী কী ভুল হয়েছে। সে প্রয়োজন এখন মিডিয়া পূরণ করে। সামাজিক মিডিয়া তো  আরো এককাঠি সরেস। এখানে ঘোষণার আগে যেমন বিশেষজ্ঞরা ওঁৎ পেতে বসে থাকে, ঘোষণার পর নেমে পড়ে তারা ব্যবচ্ছেদে।  তাই মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার আগে আসল তথ্য আর বাজেটে যাওয়া জরুরি।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৃহস্পতিবার সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন, তাতে মোবাইল সিম বা রিম কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে সেবার বিপরীতে সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছেন। ফলে মোবাইল ফোনে কথা বলা, এসএমএস পাঠানো এবং ডেটা ব্যবহারের খরচও বেড়ে যাবে। মোবাইল ফোন অপারেটররা বলছে, এর ফলে মোট বর্তমানে সেবায় ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং ১ শতাংশ সারচার্জ, ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং অন্যান্য মিলে মোট কর দাঁড়াবে ২৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়ালে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কেউ যদি ১০০ টাকার সেবা নিতে চান, তাহলে ৭৮ দশমিক ২৭ টাকার সেবা নিতে পারবেন। ২২ দশমিক ৭২ টাকা যাবে সরকারের পকেটে। এই যে খবরটা এটা অনেক জরুরি। কারণ মানুষ এখন ভাত ডালের পর মোবাইল নির্ভর। এই মোবাইল ও ইন্টারনেট না হলে তার জীবন অচল। শুধু বিনোদন বা আনন্দের জন্য না। প্রয়োজনেও তার ব্যবহার এখন অনিবার্য। আপনি একটা ট্যাক্সী ডাকবেন, উবার কল করবেন, পাঠাও আনবেন মোবাইল লাগবে। খাবার থেকে ঘুমানো সবকিছুতে এই জরুরি বিষয়ে মূলত ভালো কর আরোপ করার মাধ্যমে দুটি বিষয় পরিষ্কার। প্রথমত সরকার জানে কোথা থেকে রাজস্ব আনতে হবে। শেষত মানুষের মোবাইল ব্যবহার নিয়ন্ত্রণেরও এটা একটা পলিসি হতে পারে। তেমনি সিগারেট নিয়েও দেখলাম ট্রল হচ্ছে। আপাতত সিগারেট তেমন জরুরি বিষয় না।

মজার বিষয় এই বাজেট এত বড় এত বিশাল এত আয়োজন কিন্তু এর বাস্তবায়নের সময় কোথায়? আওয়ামী লীগ যদি আর একবার দেশ শাসনে না আসে কী হবে এই বাজেটের? তার কোনো নির্দেশনা বা সেফটি নেট দেখিনি। মূলত যেসব বড় বড় প্রজেক্ট আর উন্নয়ন প্রকল্প তার নিচে চাপা পড়ে আছে সাধারণ মানুষ।  দ্রব্যমূল্য বাতাসে বাড়ে না। এর কিছু কারণ থাকে। সে ছিদ্রগুলো বন্ধ করার নাম জনকল্যাণ। এগুলো সরকার ছাড়া কারো পক্ষে করা অসম্ভব। শেখ হাসিনার সরকার জনবান্ধব হওয়ার পরও সঠিক কিছু আছে বলে মনে হলো না। কৃষকদের সমস্যা নিয়ে দেশ যখন চরম উত্তেজনায় তখন এ বিষয়ে বাজেট হতে পারতো পথ নিদের্শক। তেমন কিছুও নেই। হয়তো বড় বড় বিষয়ের চাপে ঢাকা পড়ে গেছে কৃষি। একটা কথা বলা জরুরি, আগের বাজেটগুলোর তুলনায় এ বাজেট ভারসাম্যবাহী। চেষ্টা করা হয়েছে ব্যালেন্স রক্ষার। বাংলাদেশ এখন উন্নত দেশ হবার সংগ্রামে লিপ্ত।  তার দরকার সু-নিদের্শনা। সঠিক নেতৃত্ব। তাই খালি সমালোচনা করবো না। বলবো এই উচ্চাভিলাষী বাজেট বাস্তবায়িত হোক। বেশীরভাগ হলেও মানুষ উপকৃত হবে এমন ধারণা নিয়েই নিশ্চয়ই বাজেট হয়। সেটা না হলে মানুষ আর যাই করুক মনে জায়গা দিতে পারবে না। এবারের বাজেটের আকার যেমন স্মরণকালের সর্বোচ্চ, তেমনি ঘাটতির পরিমাণও সবচেয়ে বেশি। বাজেট প্রস্তাবে রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা কীভাবে অর্জিত হবে তা সুস্পষ্ট নয়। এই বিপুল পরিমাণ বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য বিশাল ঋণের বোঝা চাপানো হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃদ্ধির দাবি অগ্রাহ্য করা হয়েছে।

প্রবাসীদের ব্যাপারে সরকারের প্রণোদনা ভালো লেগেছে। এটা মানতে হবে বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড সোজা রাখায় এদের অবদান অনেক। বাজেট অনুযায়ী পাঠানো রেমিটেন্সের বিপরীতে বাড়তি টাকা দেয়ার ঘোষণা চমকপ্রদ। কিন্তু সে টাকার যোগান দেবে কারা? এখানে যে প্রশ্নটি থেকে যাচ্ছে তার মানে কি এই, গরিব আরো গরিব হবে, আর বড়লোক বা ধনীরা আরো ধনী? এই বৈষম্য বাংলাদেশসহ নানা দেশের প্রধান অন্তরায়। সাথে যোগ হয়েছে মধ্যবিত্তের সমস্যা। তারা না ধনী না গরিব! ফলে তাদের যাঁতাকল আরো কঠিন। এতসব সমস্যার সমাধানে কোনো ম্যাজিক বাজেট কারো হাতে নেই। তাই ধৈর্য ধরে থাকা আর ভালো কিছুর প্রত্যাশা বাদে বাকী কিছুই কাজ করবে না। বিশেষত দেশে যখন রাজনীতি নেই  তখন বলার চেয়ে যা পাওয়া যায় তাতে সন্তুষ্ট থাকাই উত্তম। জবাবদিহিতার বাজেট কোনোকালে দেখিনি। ফলে যেটুকু আশা তার দায় যাদের, তারাই পারেন একে সার্থক করতে।

লেখক: প্রাবন্ধিক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ জুন ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়