ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বিলেতের আকাশে স্থায়ী মেঘ ও আমাদের সেমিফাইনাল স্বপ্ন

জাফর সোহেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৪১, ১৫ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিলেতের আকাশে স্থায়ী মেঘ ও আমাদের সেমিফাইনাল স্বপ্ন

বৃহস্পতিবার বিলেতে বিশ্বকাপের ম্যাচ ছিল মাত্র একটি। সেটিও হজম করল বৃষ্টি! মাঠের দর্শকের চাইতেও টিভি পর্দার দর্শকেরা নিশ্চিতভাবেই এতে বেশি হতাশ। মাঠে খেলা দেখতে যাওয়ার জন্য যারা টিকেট কেটেছিল আইসিসি তাদের টাকা ফেরত দেবে। কিন্তু প্রাচ্য থেকে প্রাশ্চাত্য শত কোটি মানুষ যে রোমাঞ্চের অপেক্ষায় বসে ছিল তাদের সেই অপূরণীয় আক্ষেপের বদলে কী দেবে আইসিসি? বিশ্বকাপের মতো আসরে রিজার্ভ ডে’র ব্যবস্থা করা হলো না কেন? এখন চলছে সেই সমালোচনা। ফিফার কাছ থেকে কিছু শেখার কথা বলে ক্যারিবীয় ভাষ্যকার মাইকেল হোল্ডিং বোধকরি কম কথাই শুনিয়েছেন এই সংস্থাকে। উচিত ছিল সব ভাষ্যকার মিলে টুর্নামেন্ট ও আইসিসিকে বয়কট করা। আম্পায়াররা একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিলেও নাকি সমালোচনা করা যাবে না! মামার বাড়ির আবদার। তিন মোড়লের সংস্থা বলে এদের যে লোকে গালমন্দ করে, তা তো আর এমনি এমনি নয়!

খেলা হচ্ছে এমন একটি দেশে যেখানকার আকাশ এমনিতেই ছিঁচকাঁদুনে- চিরদিনের সর্দি! যখন তখন আকাশ ফুটো হয়ে পানি পড়ে। সেখানকার বাসিন্দারা বর্ষাতিকে বানিয়ে ফেলেছেন নিজেদের শরীরে নিত্যব্যবহার্য পোশাকতুল্য পণ্য। এমনকি সকাল বেলা আকাশে গনগনে রোদ থাকলেও লোকে ছাতা হাতে বের হয়। কারণ, বৃষ্টি সেখানে এতই বেলাজ, কখন অতিথি হয়ে হাজির হয়ে যায় ঠিক নেই! তো এইরকম একটি দেশে আপনারা একটা খেলা খেলতে চান যেটির আবার সম্বন্ধ কেবল রোদের সঙ্গে; বৃষ্টির সঙ্গে চিরদিনের আড়ি। সেখানে বিকল্প ব্যবস্থা রাখা দরকার ছিল। অথচ কোনো ব্যবস্থাই রাখলেন না! ভারতীয়রা দেখলাম বৃষ্টির দুঃখ ভুলতে চাইছে অভিনব কিছু ট্রলে ভর করে। একটাতে দেখা গেল বিরাট কোহলি আর কেন উইলিয়ামসন টস করছেন জল ভরা মাঠে; টস জিতে কোহলি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আগে সাঁতার কাটার! অনেকে আবার ক্রিকেটে ওয়াটার পোলো সিস্টেম চালু করতে বলেছে আইসিসিকে!

এদিকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ম্যাচে একটি পয়েন্ট হারানোর শোকে কাতর বাঙালি মনের দুঃখ মনে রেখে গত কয়েকদিন ভিন্ন প্রসঙ্গে ডুব দিতে চায় মনে হলো! পাকিস্তান সাপোর্ট করা না করার রাজনীতি ফেসবুকে টাইগারদের নিয়ে দুঃখের আর সমালোচনার পাঁচালির জায়গা কিছুটা দখল করেছে দেখলাম। এতে কিছুটা হলেও দুঃখ-কষ্ট হ্রাস পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে। মাশরাফি-তামিমদের মুণ্ডুপাত ছেড়ে বৃহস্পতিবার দিনভর বাজেট, সিগারেট, শুল্ক, মোবাইল ফোন, দাম কমল, দাম বাড়ল, সাংবাদিকের বেতন-ওয়েজবোর্ড- ইত্যকার নানা বিষয়ে মতামত প্রদানে ব্যস্ত দেখা গেছে সবাইকে।

টাইগার সমর্থকদের এই আপাত প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার পেছনেও বড় ভূমিকা রেখেছে বিলেতের বৃষ্টি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচ ভাসিয়ে নিয়ে আমাদের সমর্থকদের একটা গ্যাপ দিয়েছে সে। কিছুটা দ্বিধায়ও ফেলে দিয়েছে বটে। এখন তারা কি টাইগারদের সমালোচনা অব্যাহত রাখবে, নাকি বৃষ্টিতে এক পয়েন্ট পাওয়াকে সেলিব্রেট করবে, নাকি নিশ্চিত পয়েন্ট হারানোর জন্য দুঃখ করবে- ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না! কিন্তু ফেসবুক তো আর অচেতন করে রাখা যাবে না, সেখানে চেতনার চর্চা করে যেতেই হবে। সেই চর্চা আপাতত বাজেট নিয়ে হচ্ছে।

১৭ তারিখে আবার মাঠে নামবে টাইগাররা। দিন আছে হাতে দুটি। অন্য সব প্রসঙ্গ পেছনে ফেলে আবার টপে উঠে আসবে ক্রিকেট, টাইগার, সেমিফাইনাল প্রসঙ্গ। এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কী করবে- এমন প্রশ্নের আলোচনা যখন থেকে শুরু তখন থেকেই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ হলো ‘সেমিফাইনাল’! বাংলাদেশ সেমিফাইনালে যাবে, যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আশা করা যায়, অমুক অমুক দলকে হারাতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ যদি বলে বাংলাদেশ সেমিফাইনালে যাবে না- লোকে মারও দিতে পারে! আবার কেউ যদি বলে, সেমিফাইনালে বাংলাদেশ যাবেই- তাকেও ‘বেশি বোঝে’ বলে সমালোচনা করবে! এখন আমি যদি বলি, বাংলাদেশ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়নও হতে পারে, তাহলে কী হবে? লোকে ফেসবুকে একটা ট্রায়াল করে আমাকে পাগল হিসেবে রায় দিয়ে পাবনায় পাঠাতে সরকারের কাছে আবেদন জানাবে!

তারপরও ঝুঁকি নিয়ে আমার বলতে ইচ্ছে করছে, এইরকম একটি পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশ সেমিফাইনাল নয়, ফাইনালও খেলতে পারে এমনকি কাপও জিততে পারে! এটা আমি বলতে পারি, কারণ ক্রিকেট খেলা তার প্রকৃতি দিয়েই এটা বলার সাহস আমাকে দিচ্ছে। প্রথমত হলো, ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা, যেকোনো দিন যেকোনো কিছু হতে পারে। তারপর কথা হলো, এখনকার বাংলাদেশ ক্রিকেটীয় শক্তিমত্তার বিচারে এই মুহূর্তে অন্য যেকোনো দলের কাছাকাছি মানের। অর্থাৎ দলটি অস্ট্রেলিয়া হোক, ইংল্যান্ড হোক কিংবা ভারত-পকিস্তান হোক- প্রত্যেককেই হারানোর বাস্তবিক সামর্থ্য আছে বাংলাদেশের।

হেরে যাওয়া ম্যাচটাকেই দেখি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যে ম্যাচে আমরা হেরেছি, সেই ম্যাচে কি আমরা আমাদের সামর্থের পুরোটা অনুবাদ করতে পেরেছি? কেউ কি সেটা বিশ্বাস করবে? মোটেই না। একজন সাকিব যেখানে সেঞ্চুরি তুলে নিতে পারে, সেখানে একজন মুশফিক, একজন তামিম বা একজন সৌম্যও যে শতক হাঁকাতে পারে তা তো সত্য। এই সত্য যদি মানি, তার মানে দাঁড়ায় আমরা সেরাটা খেলতে পারিনি। হেরে গেছি এজন্যেই।

প্রতিপক্ষ খারাপ খেলা লাগবে না, আমরা যদি আমাদের সেরাটা দিতে পারি- যেকোনো দলকেই আমরা হারাবো। সামর্থের এই জায়গাটুকুর ওপর আমাদের বিশ্বাস আগে দৃঢ় করতে হবে। কদিন আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ গিয়ে তাদের মাটিতে তাদেরকে হরিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে নিজেদের ওপর এই আস্থা ও বিশ্বাস ছিল বলেই। দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলকেও হারিয়েছি এই বিশ্বাসের বলেই। ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কাকে তো এখন যখন তখন যেকোনো দিন আমরা হারাই। এটা কেবল দেশের মাঠে নয়, বিদেশেও করা যায়।

একটা বিষয় ক্রিকেটের পাঁড় সমর্থকও মানেন, খেলা যাদের মাঠে হয় তারা মনস্তাত্বিকভাবে এগিয়ে থাকে। এজন্য যার যার দেশের মাটিতে সবারই সাফল্য বেশি। বাংলাদেশও ঘরের মাঠে টানা ৬টা সিরিজ জিতেছে। হোয়াইট ওয়াশ করেছে বড় বড় দলকে। এখন বিশ্বকাপটা হচ্ছে একটা দেশের মাটিতে, সেটা ইংল্যান্ড। সুতরাং ইংলিশরা ছাড়া দুনিয়ার সব ক্রিকেট শক্তিই কিন্তু পরের মাঠে খেলছে। সবার জন্যেই সমান সুযোগ এখানে আছে। আমাদের কোচ স্টিভ রোডস একজন ইংরেজ। গতকাল তিনি বলেছেন, বিশ্বকাপে বাংলাদেশ নয়, বড় দলগুলোই এখন বাংলাদেশকে ভয় পাচ্ছে। সুতরাং মাঠে নামার আগে মনস্তাত্বিক দিক থেকে এখন টাইগাররাই এগিয়ে আছে।

গত কয়েক বছরের বাংলাদেশকে একটু পেছন ফিরে দেখলে গাণিতিকি হিসাবেও সব প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জয়ের সম্ভাবনাটা থাকবে ফিফটি-ফিফটি। সেই সম্ভাবনারই প্রতিফলন ঘটেছে প্রথম তিন ম্যাচের দুটিতে। একটিতে তো খেললাম স্বাগতিকদের সঙ্গে। ঐ ম্যাচ বাদে বাকি দুটি ম্যাচ দেখুন- দুটিতেই দুর্দান্ত খেলেছে টিম মাশরাফি। সাউথ আফ্রিকাকে হারিয়েছে আর নিউজিল্যান্ডকে প্রায় হারিয়েছে! অর্থাৎ এখন পর্যন্ত ফিফটি-ফিফটি চান্সের অর্ধেক বাংলাদেশের পক্ষে গেছে, অর্ধেক অন্যদের পক্ষে গেছে। তাহলে হিসাব মতো বাংলাদেশের নয়টি ম্যাচের সাড়ে চারটি টাইগারদের পক্ষে যাওয়ার আশা অতি বাস্তব! এরমধ্যে দেড় ম্যাচ আমাদের হয়েছে। বাকি পাঁচ ম্যাচের তিনটি যদি আমাদের হয় তাহলে সেমিফাইনালের পথে অন্য সবার মতোই আমাদের সম্ভাবনার গাড়িও চলমান থাকবে। নিট রানরেটসহ বিরুদ্ধ কিছু সমীকরণের মারপ্যাঁচে পড়ে হয়ত আমরা লাইনচ্যুত হতে পারি; তবে এও সত্য, ভাগ্যের সহায়তা পেলে সাড়ে চারকে পাঁচ বা সাড়ে পাঁচ ম্যাচ জয়ে রূপান্তর করতেও পারি! তাহলে কী হবে? বাঙালি সেমিফাইনাল খেলবেই। আর সেমির প্রতিপক্ষ যদি স্বাগতিকরা না হয় অর্থাৎ ইংল্যান্ড না হয় তাহলেও সেই ফিফটি-ফিফটি চান্সের সমীকরণটা সামনে চলে আসবে। সেখানে জিততে পারে যে কেউ!

বাকি হিসাবটা আমি আর মেলাবো না! সমর্থক বলেন, পূজারী বলেন- এই দলটির জন্য দুনিয়ার সমস্ত বাংলাদেশি মনে মনে প্রার্থনা করে বলেই বিশ্বাস করি। মুখে যত বিষই তাদের থাক, অন্তরে থাকে ভালোবাসার বৃষ্টি। একবার ফাইনালে উঠে গেলে কোটি কোটি অন্তরের ভালোবাসার বৃষ্টিতে স্নাত হয়ে সোনালি কাপটা মাশরাফির হাতে উঠে গেলেও বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। আমি আশাবাদী। আপনারাও আশাবাদী হোন। খারাপ খেললে মুখে কিছু বলতে চাইলে বলুন, কেউ বাধা দেবে না; তবে মনে মনে জোড়হাতে প্রার্থনা করুন, করুণাময় যেন টাইগারদের সহায় হয়, ভাগ্যদেবী যেন তাদের একটু বর দেয়। তাহলেই হবে।

লেখক: সাংবাদিক, আরটিভি




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ জুন ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়