ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

কংগ্রেসের নেতৃত্ব সংকট এবং বিজেপি’র অগ্রযাত্রা

অলোক আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫১, ২০ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কংগ্রেসের নেতৃত্ব সংকট এবং বিজেপি’র অগ্রযাত্রা

অলোক আচার্য: মোদি ম্যাজিকে টানা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতের রাজনীতিতে নানা পরিবর্তন ঘটছে। মোদি ম্যাজিক বলতে দেশ পরিচালনায় মোদির দক্ষতা, বিরোধী দলে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব এবং সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দুত্ববাদ মোদির জয়ে ভূমিকা রেখেছে বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। ভারতের মতো বৃহৎ দেশে একটি রাজনৈতিক দলের যতটা গোছানো এবং অগ্রণী ভূমিকা পালন করা উচিত বিরোধী দলগুলো সেটা সঠিকভাবে করতে পারেনি। যে কংগ্রেসের বর্তমান সংকট নিয়ে আজ এত প্রশ্ন সেই দলের যাত্রা শুরু সেই ১৮৪৪ সালে। ১৭৫ বছর আগে যে দলটির যাত্রা শুরু সেই দলের আজ নেতৃত্ব সংকট বলা হচ্ছে। অথচ কত বড় বড় রাজনীতিবিদের হাত ধরে দলটি আজ দেশের মানুষের কাছে পৌঁছেছে-ভাবা যায়!

রাহুল গান্ধী যখন দলের হাল ধরেন তখন সময়টা ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। তবে সবাই ভেবেছিল তার হাত ধরেই কংগ্রেস আবার ভারতের রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়াবে। তবে একথা স্বীকার করতেই হয় যে, রাহুল গান্ধীর ভেতর এক ধরনের সরলতা রয়েছে। কিন্তু রাজনীতির মাঠ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে নেতার পরিচালন ক্ষমতা, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা, মানুষকে নিজের দিকে টানার ক্ষমতা ইত্যাদি আরও অনেক গুণ থাকা আবশ্যক। এনডিএ তার সরকার গঠনের প্রথম ১০০ দিনে ভারতের অর্থনীতিতে ব্যাপক সংস্কার আনার ঘোষণা দিয়েছে। ঠিক এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের জিএসপি সুবিধা বাতিল করছে। তবে জিএসপি বাতিলে ভারতের অর্থনীতিতে তেমন প্রভাব পরবে না বলেই বোদ্ধারা মনে করছেন। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেই জনগণের আশা আকাঙ্খা পূরণে পুরোদমে কাজ শুরু করেছে এনডিএ। বর্তমান মেয়াদে মোদিকে সত্যিকার অর্থে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। যার মধ্যে অন্যতম বেকারত্ব দূরিকরণ। কারণ মোদির সময়েই ভারতে বেকারত্ব ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে ফাঁস হওয়া সরকারি এক প্রতিবেদন দেখিয়েছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেকারত্বের হার ৬ দশমিক ১ শতাংশ ছিল যা গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। যদিও সরকারিভাবে এই প্রতিবেদন কখনোই প্রকাশ করা হয়নি। প্রকাশ হোক বা না হোক বেকারত্ব যে ভারতের মতো বৃহৎ দেশে বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এর পরেই দারিদ্র্য দূরিকরণ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০১৫ সালে ভারতের ১৭ কোটি ৬০ লাখ লোক চরম দারিদ্র্যের মধ্যে ছিল, মাথাপিছু ২ ডলারেরও কম আয়ে তাদের জীবন ধারণ করতে হয়েছে। দেশটির মোট জনসংখ্যার অর্ধেক দারিদ্র্য সীমার নিচে রয়েছে। দারিদ্র্য দূর করতে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি গত মেয়াদে দেশে কৃষি ও কৃষকদের অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। এবার কৃষকদের দিকে বিশেষ দৃষ্টি মোদি সরকারকে অবশ্যই দিতে হবে।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার হিড়িক লেগেছে। অপরদিকে কংগ্রেসে চলছে টানাপোড়েন। লোকসভা নির্বাচনে পরাজয়ের ধাক্কা সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে দলটি। রাহুল গান্ধী নিজের দুর্বলতা স্বীকার করে দলীয় প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগের ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। নির্বাচনের পর কংগ্রেসের সংসদীয় কমিটির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়েছেন সোনিয়া গান্ধী। তিনিই এখন দলনেতা ঠিক করবেন। তবে দলের এই পরিস্থিতিতে রাহুল গান্ধী ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে নিয়েছেন। বিজেপির সাথে তিনি প্রতিদিন লড়াই করার ঘোষণা দিয়েছেন। মূলত কংগ্রেসের এই পরাজয়ের পর দলের ভেতরে নেতা কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করা এবং সেইসঙ্গে রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান শক্ত করা এই দুই কাজই করতে হবে তাকে। রাহুল গান্ধী মনে করেন দল পরিচালনার ভার না থাকলে সেই কাজটা তার জন্য আরও সহজ হবে। সেইসঙ্গে তিনি মনে করেন নেহেরু-গান্ধী পরিবারের বাইরে কেউ দলের হাল ধরা প্রয়োজন। অবশ্য দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা তাকে বহুবার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তাছাড়া এটাও ঠিক- কংগ্রেসের অভ্যন্তরে কোন্দলের বিষয়টি এখন প্রকাশ্য। পাঞ্জাবে মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দর সিং ও মন্ত্রী নভজ্যেত সিং সিধুর দ্বন্দ্ব এরই মধ্যে প্রকাশ্যে চলে এসেছে। আবার তেলেঙ্গনা রাজ্যে কংগ্রেসের ১৮ জন বিধায়কের মধ্যে ১২ জন কংগ্রেস ছেড়ে টিআরএস-এ যোগ দিয়েছেন। একদিকে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের শোচনীয় পরাজয়, অন্যদিকে বিজেপির গতবারের চেয়ে আরও বেশি আসন নিয়ে শক্তিশালী অবস্থান। ভারতের ঐতিহ্যবাহী শক্তিশালী রাজনৈতিক দল কংগ্রেস আগেরবারের চেয়ে আটটি আসন বেশি পেলেও পার্লামেন্টে প্রধান বিরোধীদল হওয়ার মতো প্রয়োজনীয় আসন পায়নি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপি আধিপত্য বিস্তার লাভ করেছে। সেখানে তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে প্রতিযোগিতায় এবার বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। এবারের নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় বিজেপি ক্রমশই পশ্চিমবঙ্গে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রতি বিখ্যাত অভিনেত্রী অঞ্জু ঘোষের বিজেপিতে যোগ দেয়া নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গণে জোর আলোচনাও শুনেছি। মূলত তার নাগরিকত্ব নিয়ে এই বিতর্ক দানা বেঁধেছিল। দলের পক্ষ থেকে অবশ্য তাকে ভারতীয় নাগরিক বলেই দাবি করা হয়েছে। কংগ্রেস বা তৃণমূলের মতোই ভারতের একসময়ের রাজনীতিতে অতি গুরুত্বপূর্ণ বামপন্থিদের অবস্থাও সুবিধার নয়। এই নির্বাচনে তারা দুই শতাংশ ভোটও পায়নি। দিন যত যাচ্ছে মানুষের সাথে দলগুলোর এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। অথচ তৃণমূলের আগ পর্যন্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গে টানা প্রায় তিন দশক ক্ষমতায় ছিল সিপিআইএম-এর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার। অমিত শাহ, মোদির বিজেপি ক্রমশই নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করছে। বিপরীতে বিরোধী দলগুলো বেশ কঠিন সময় পার করছে।

মোদিকে ফোকাস করে বিজেপির যে রণকৌশল ছিল তাতে আপাতত সফল তারা। ভারতের জনগণ মোদির ওপরই আস্থা রেখেছেন। নির্বাচনের আগে যদিও মোদির ব্যর্থতার ফিরিস্তি সামনে এসেছিল তারপরও সেদেশের মানুষ মনে করে মোদির হাতেই ভারত নিরাপদ। তাছাড়া হিন্দুত্ববাদী বিষয়টি তো সামনে আছেই। নির্বাচনের আগে পাকিস্তানের বালাকোটে বিমান হামলা মোদিকে বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে বলেই মনে করা হয়। ক্ষমতায় আসার পরেই মীমাংসাযোগ্য সব সমস্যা সমাধানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান মোদিকে চিঠি দিয়েছেন। তবে মোদি এখন পর্যন্ত তাতে সাড়া দেননি। পাকিস্তানের বালাকোটে বিমান হামলার পর দলটির নেতারা দাবি করেছিল ভারত এখন শক্ত ও নিরাপদ নেতৃত্বের হাতে রয়েছে। সব সমস্যার সমাধান হিসেবে মোদিকেই বেছে নিচ্ছে দলটি। নির্বাচনের ফলেও তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিজেপির বিগত শাসনামলে বৈশ্বিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তারা মোটামুটি সফল বলা যায়। মহাকাশসহ প্রযুক্তি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। তারা মূলত মোদি ম্যাজিকেই ভরসা রাখতে চান। দুর্বলতার সাথে সাথে মোদি কিছু সুবিধাও পাবেন। কারণ ভারতের অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ভারত বিশ্বের ষষ্ঠ অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে এবং চলতি বছর ব্রিটেনকে পেছনে ঠেলে দিয়ে পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে বলে আভাস দিয়েছে। কংগ্রেস যখন পরাজয়ের হিসাব নিকাশ কাটিয়ে উঠে নিজের ঘর গোছাতে ব্যস্ত থাকবে। ততক্ষণে মোদির হাত ধরে ভারত নতুন যাত্রায় এগিয়ে যাবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ জুন ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়